ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

ফেসবুক প্রেম কিংবা পৌরাণিক বাস্তবতা

প্রকাশিত: ০৯:৩৩, ৩ মে ২০১৯

ফেসবুক প্রেম কিংবা পৌরাণিক বাস্তবতা

পাবানার মানসিক হাসপাতালের আউট ডোরে প্রায়ই একজন মানসিক রোগীর সঙ্গে দেখা হয় আমার। এক আত্মীয়কে দেখতে যাওয়ার সুবাদে দু’চারটে কথাও হয় মাঝে মধ্যে। নাম মনির হোসেন মনু। কিন্তু তাকে সবাই ডাকে ‘আশা পাগল’ বলে। আশা মাঝে-মধ্যে সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মতোই সব প্রশ্নের জবাব দেয়। হঠাৎ করে কেউ বুঝতে পারবে না যে একজন মানসিক রোগী ও। তবে হাঁটাচলার সময় তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আশা হাঁটাচলা করে অনেকটা সেলুটের ভঙ্গিতে। অর্থাৎ তার বাম হাতটা থাকে জামার পকেটের পর আর ডানটা কপাল ঘেঁষে। আউটডোরে যত মানসিক রোগী আছে সবার মধ্যে ব্যতিক্রম হলো আশা। সে কথা বলে শুদ্ধ বাংলায়। কথাবার্তায় মনে হয় সে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত। আশা নামের এক মেয়েকে ভালবাসতো সে। একথা সবাই জানে তবে এ পর্যন্তই; এর চেয়ে বেশি কিছু কেউ বলতে পারে না। সেদিন হঠাৎ করেই প্রেমিকা আশাকে আবিষ্কার করি তার বুক পকেট থেকে। আগেই বলেছি বামহাতটা সব সময় তার বুক পকেটের পর থাকে। একদিন কৌতূহল বশত আমি বলি, ‘আশা; তোমার পকেটে কি আছে, একটু বলবে কি?’ ও জানালার কাছে থেকে হঠাৎ দূরে সরে গিয়ে বলে,‘ আয়েশা আমার আর্কেডিয়া! আমার গ্যালাটিয়া ’প্রথমে ওর কথার মাথামু-ু কিছুই বুঝতে পারি না। বলি, আশা; কি যে বলো, বোঝা যাচ্ছে না কিচ্ছু। যদি একটু দেখাও জিনিসটা কি? -না-না-না; দেখাবো না! আয়েশা আমার গ্যালাটিয়া। মাথা নাড়তে নাড়তে ক্রমশ দূরে সরে যেতে থাকে ও। -আশা যদি দেখাও তবে ওর কাছে তোমাকে আজই নিয়ে যাব। আমি একটু কৌশল অবলম্বন করি। কৌশলে ফল হয়। আশার আশপাশে একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে নিয়ে জানালার কাছে চলে আসে। বুক পকেটে থেকে দ্রুত ছবিটি বের করে জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে আমার চোখের সামনে তুলে ধরে। একজন নারীর ছবি। ছবিতে মেয়েটি আহা মরি সুন্দরী বলে মনে হয় না। আমি ছবি থেকে মুখ তুলে বলি, ‘তুমি মেয়েটিকে খুব ভালোবাসো, না?’ আশা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। -মেয়েটিও তোমাকে খুব ভালোবাসে বুঝি! -তাতো জানি না।’ আশা মাথা নেড়ে বলে। -তবে...? ‘আমি আমার প্রেমিকা ভালোবাসি আমাকে না-ভালোবাসার জন্য কেননা-ভালোবাসায় কোনো কোনো স্বার্থপরতা নেই।’ হঠাৎ আশা একটি কবিতার লাইন আওড়ায়। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘তুমি কবিতাও জানো?’ -শুধু জানি না; লিখিও। -আরেকটা কবিতা শোনাও দেখি? -আর মনে নেই। -আচ্ছা; তুমি সেই মেয়েটির ঠিকানা বলতে পারবে? -আমি তো ওকে সরাসরি দেখিনি কোনোদিন। -বলো কি! -হ্যাঁ। ও আমার মিতা; ফেসবুক মিতা। আয়েশা, আমার গ্যালাটিয়া। আশা ঘাড় নাড়ে আর বলে। -তারপর? +তারপর আর কী; ওর সাথে আমার বিয়ে -এইতো সামনের শুক্রবার। আয়েশা আমার গ্যালাটিয়া। ছবিটি বুক পকেটে রেখে বামহাত দিয়ে চেপে ধরে সচরাচর চলার ভঙিতে মাথা নাড়তে নাড়তে চলে যায় আশা। দর্শকের মধ্য থেকে একজন বলে, ‘মিথ্যে কথা! মেয়েটির সঙ্গে দীর্ঘ তিন বছর ফেসবুক প্রেম ছিল ওর। একসময় বিয়েরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল মেয়েটি। হঠাৎ একদিন সব বন্ধ হয়ে যায়। -ঠিকানা অনুযায়ী তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি? -বাড়ি ছিল পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলায়। ঠিকানাটা ফেক ছিল। আশা আবার কাছে আসে। আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘পিগমিলিয়ন সেও তো এনেছিল গ্যালাটিয়ার বুকে প্রাণের স্পন্দন।’ কিসের জোরে? ভালোবাসার জোরে। আমিও ওকে পাবো এই ভালোবাসার জোরে।’ -আশা তোমার এই অন্ধবিশ্বাস ঝেড়ে ফেলো মন থেকে। তাহলে শিগগিরই সুস্থ-স্বাভাবিক হয়ে উঠবে তুমি। আমি ওকে বুঝাতে চেষ্টা করি। ‘অন্ধবিশ্বাসেই ভালোবাসা আসে। পুষে রাখি তাই বুকে বিশ্বাসে সত্যিকারের ভালোবাসা হতে পারে। তোমার বিশ্বাসে-আমার বিশ্বাসে।’ আশা একটি ছড়া কাটতে কাটতে জানালার ধার থেকে সরে যেতে থাকে ক্রমশ।
×