ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

আলী যাকের

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

প্রকাশিত: ০৭:৩৩, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

(পর্ব-১৮) সময়ের আবর্তে স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে আসে এটাই স্বাভাবিক। নাটক শুরু করেছিলাম ৪৫ বছর হয়ে গেল। পেছন ফিরে তাকালে মনে হয় এত সেই দিনেরই কথা কেবল। এরই মাঝে কত উত্থান-পতন, কত বৈচিত্র্যময় ঘটনাবলীর সমাবেশ ঘটেছে যার সবিস্তারে বর্ণনা দেয়াও এখন আর সম্ভব নয়। এই চার দশকোর্ধ্ব সময়ে কখনও এমন গেছে যে নিজের পেশা ছাড়াও সৃজনশীল কাজের চাপে নিঃশ্বাস নেবার সময় পাইনি। আবার কখনও কখনও একেবারে বন্ধ্যা সময় কেটেছে আমার। যতদূর মনে পড়ে, আমার অকিঞ্চিৎকর নাট্যকর্মের জীবনে ’৮০র দশক ছিল সবচেয়ে ব্যস্ত সময়। ওই সময় সবচেয়ে বেশি অভিনয় করেছি মঞ্চে। বেশ কিছু নাটকের রূপান্তর করেছি। নির্দেশনা দিয়েছি। কিছু বিদেশী নট এবং নির্দেশকের সাহচর্য পেয়েছি। তাদের নির্দেশনায় অভিনয় করেছি আবার যৌথভাবে অভিনয় কর্মশালাতে অংশগ্রহণ করেছি। তবে এই কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছিল ’৭০-এর দশকের শেষ থেকে। স্মর্তব্য, তখন ব্রেশটের কয়েকটি নাটকের রূপান্তর, নির্দেশনা এবং অভিনয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম আমি। বস্তুতপক্ষে আমার দল, নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের উদ্যোগেই ব্রেশটের নাটকের সঙ্গে পরিচিত হয় বাংলাদেশের দর্শক প্রথমবারের মতো। এছাড়াও ব্রেশটের অনুসারী কার্ল স্যুখমায়ারের নাটকও আমরা ওই ’৮০র দশকেই মঞ্চে নিয়ে আসি। এই সময় মার্কিন এবং ইউরোপীয় নাটক, নির্দেশক এবং নাট্যকারদের সঙ্গে সম্যক পরিচয় ঘটে আমাদের। মনে আছে সপ্তাহে প্রায় প্রতি সন্ধ্যাতেই আমরা মিলিত হতাম মহড়া কক্ষে যেখানে অভিনয়, নির্দেশনা, নাট্যতত্ত্ব আলোচনা নিয়েই সময় কাটত আমাদের। তবে এগুলো সব সময়ই যে খুব গভীর-গম্ভীর বাগাড়ম্বরে পর্যবসিত হতো তা নয়। প্রত্যেক শিল্পীরই নিজস্ব জীবনে কিছু রম্য বিষয় থাকে যা চাট্নির মতন কাজ করে ওই সব সান্ধ্য সম্মিলনে। সেই সবও অলংকৃত করত আমাদের সন্ধ্যাগুলোকে। প্রসংগত আমার শিল্পকর্ম চর্চা সম্বন্ধে কিছু কথা বলা সঙ্গত বলে আমি মনে করি। আমাকে প্রায়ই এই বিষয়ে লিখতে বলা হয় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা থেকে। বিষয়টা এই ধরনের শিরোনামে উল্লেখিত হয়, যেমন- ‘আমি ও আমার শিল্পকর্ম’ অথবা ‘আমার শিল্পকর্মের গতিপ্রকৃতি’ ইত্যাদি প্রভৃতি। এই ধরনের আহ্বান পেলেই মনে হয় যেন কলম ধরলেই তরতরিয়ে বেরিয়ে আসবে লেখা। কয়েক মিনিটে পাতার পর পাতা ভরে উঠবে শব্দে শব্দে। কিন্তু বিষয়টা যত সহজভাবে ভাবা যায়, তত সহজ নয়। একজন মানুষ কিভাবে সৃজনশীল কর্মকাণ্ঠে আগ্রহী হয়, তার কাজে অনুপ্রেরণা হিসেবে কী কাজ করে সে সম্বন্ধে বলা মুশকিল। তাছাড়া মেধার ব্যাপারটা তো রয়েছেই। শিল্প চর্চা নিঃসন্দেহে মেধা উদ্বুদ্ধ কর্মকা-। একেবারে কোন চিন্তা ভাবনা ছাড়া মেধাভিত্তিক কোন কাজ করা প্রায় অসম্ভব। অতএব ইচ্ছে, পরিশ্রম এবং মেধার সংমিশ্রণ বোধ করি যে কোন শিল্পকর্মের কাজে সবচেয়ে বড় উপাদান হিসেবে মূল্যায়িত হতে পারে। আরও একটি বিষয় আছে। যেটি আমরা ভুলে যাই, সেটি হচ্ছে কল্পনা করার শক্তি। ইংরেজীতে যাকে ঢ়ড়বিৎ ড়ভ রসধমরহধঃরড়হ বলা হয়ে থাকে। একবার নিউইয়র্ক শহরের বিখ্যাত সেন্ট্রাল পার্ক উদ্যানে একটি জলায় শ্বেতপদ্ম দেখেছিলাম আমি। দেখে সম্মোহিত হয়েছিলাম। এবং জলার ধারে ঘাসের ওপর বসে পড়েছিলাম। স্থির দৃষ্টি ছিল ওই পদ্ম ফুলের দিকে। কিন্তু আমার ভেতরে তখন জন্ম নিচ্ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি দৃশ্য। আমি দেখতে পাচ্ছিলাম আমার গ্রামের পদ্ম পুকুর। কোন এক শরতকালের সকালে ফুটেছিল অসংখ্য শ্বেতপদ্ম তাতে। মৌমাছি গুনগুন করছিল পদ্ম ফুলের ওপর। মাথার ওপর নীল আকাশ দিয়ে ভেসে যাচ্ছিল সাদা মেঘ। আমি সম্মোহিত হয়ে ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমি দেশ থেকে ১৩ হাজার মাইল দূরে বসে। কল্পনা প্রবণ মনের এ ধরনের অসংলগ্ন এবং প্রায় অবাস্তব চিন্তা করতে কোনই অসুবিধা হয় না। পরিস্থিতি যাই হোক না কেন। ব্যক্তিগতভাবে আমার অবস্থা তো একটু ভিন্ন ছিলই। সেই বাল্যকাল থেকেই আমি পূর্ব-বাংলার ছোট ছোট শহরে মানুষ হয়েছি। সেই সব জায়গায় বিস্তীর্ণ প্রান্তর ছিল, খর¯্রােতা নদী ছিল, বিশাল সব বৃক্ষের বাগান ছিল, আদিগন্ত ব্যাপৃত জলাভূমি ছিল। অতএব, কল্পনা ছিল বাধা-বন্ধনহীন। সেই বিচিত্র সব দৃশ্যগুলো বুকের মধ্যে আঁকা হয়ে গেছে। সেগুলোই এই এত বছর পরেও বুকের মাঝ থেকে উঁকি-ঝুঁকি দেয়। বাস্তবতা যাই হোক না কেন! অনেকেই বলেন, জীবন এমন কঠিন এখন যে কবিতাকে ছুটি দিতে হয় বাধ্য হয়ে। কল্পনাকে জলাঞ্জলি দিতে হয় নিষ্ঠুরভাবে। জীবন উদভ্রান্ত হয়ে যায় বাস্তব সংঘাতে। হয় তো বটেই! কিন্তু এরও মাঝে কেন যেন আমি ফিরে ফিরে যাই বাল্যকাল, কৈশোর কিংবা তারুণ্যের উন্মেষকালে। আমি নিশ্চিত যে সুকান্ত চট্টোপাধ্যায় অতি অল্প বয়সে চলে না গেলে তাঁর সেই বিখ্যাত কবিতার লাইন, ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়’ নতুন করে লিখতেন। আর দশটি বছর বেঁচে থাকলে উনি অনুধাবন করতে পারতেন যে, কোন জীবনে কোন কিছুই চিরায়তভাবে গদ্যময় নয়। ক্ষুধার মধ্যেও কিন্তু মানুষের কাব্যময়তা কিংবা সুকুমার চিন্তা সম্পূর্ণভাবে লোপ পায় না। প্রসঙ্গত হুমায়ূন আহমেদের একটি নাটকের সংলাপ মনে পড়ছে। সংলাপটি ছিল অনেকটা এই রকম, ‘একজন ক্ষুধার্ত বাঙালী মাঝি, যার শরীর চলছে না, এতই সে দুর্বল, চাঁদনি রাতে নৌকা নিয়ে বিল পাড়ি দেয়ার সময় সব ভুলে গিয়ে উদাত্ত কণ্ঠে সে গান ধরল। বিহ্বল করা প্রেমের গান।’ এটা খুব স্বাভাবিক। ওই যে কল্পনার কথা উল্লেখ করলাম তা পূর্ণাঙ্গ হয়ে ওঠে, পত্রপুষ্পে পল্লবিত হয় আমাদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। আমি ব্যক্তিগতভাবে কল্পনা করার শক্তিমত্তা কিংবা ক্ষমতা সম্বন্ধে সচেতন হয়েছি অভিনয়ের জগতে আসবার পর। একজন অভিনেতাকে ক্রমাগতভাবে কল্পনাশক্তির প্রয়োগ করতে হয়। আমি যখন দেওয়ান গাজীর কিস্সা নাটক করি তখন দেওয়ান গাজী হিসেবে আমার চরিত্রের যে সামগ্রিক চেহারা সেটি সম্পূর্ণ বদলে যায় যখন আমি ম্যাকবেথ কিংবা গ্যালিলিও নাটকে অভিনয় করি। দেওয়ান গাজী আমার সম্যক পরিচিত এক ব্যক্তি। যাকে আমি হয়ত দেখেছি নিকট কিংবা দূর থেকে এই বাংলায়, গ্রামে, গঞ্জে বিভিন্ন জায়গায়। গ্যালিলিও সেই ষষ্ঠদশ শতাব্দীর অংক শাস্ত্রবিদ/ দার্শনিক। আর ম্যাকবেথ শেক্সপিয়ার রচিত একটি কাল্পনিক চরিত্র যিনি ছিলেন স্কটল্যান্ডের রাজাদের একজন। এসব চরিত্রে কখনই কল্পনাশক্তি ব্যবহার না করে অভিনয় করা সম্ভব নয়। যখন আমি গ্যালিলিও কিংবা ম্যাকবেথ করি, মঞ্চের ওপরে, তখন ভুলে যাই যে আমি বাংলাদেশের আলী যাকের। কেবল এই কারনে ওই নাটকগুলোর ইতিহাস, ভৌগোলিক অবস্থান, সংশ্লিষ্ট সকল চরিত্র, ঘটনা বিন্যাস, মানসিকতা, দর্শন ইত্যাদি নিয়ে আমাকে লেখাপড়া করতে হয় এবং ভাবতে হয়। তাহলেই কেবল নাটকের সত্য বাস্তবের সত্যকে স্পর্শ করে। এবং আমি একজন অভিনেতা হিসেবে শিহরিত হই। আমি মঞ্চ থেকে যা বলি সেটাই আমার কাছে সত্য বলে প্রতিপন্ন হয়। এই কল্পনা বিষয়টি এত ব্যাপক এবং বর্ণময় যে এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা করা চলে। আলোচনা করা চলে। এ নিয়ে বারান্তরে বিশদ লেখার ইচ্ছে রইল। আপাতত এখন এই টুকুই।
×