ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৫ জুন ২০২৫, ১১ আষাঢ় ১৪৩২

আশরাফ উদ্দীন আহ্মদ

মাহমুদুল হকের ‘কালো বরফ’

প্রকাশিত: ০৭:১২, ২৯ জুন ২০১৮

মাহমুদুল হকের ‘কালো বরফ’

মাহমুদুল হক (১৯৪১-২০০৮) এর জন্ম পশ্চিমবঙ্গের উত্তর-চব্বিশ পরগনার বারাসাতের কাজীপাড়ায়। ছোটগল্পের মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যাকাশে উদয় হলেও, তার ঝোঁকটা বরাবরই উপন্যাসের প্রতি ছিলো সে কথা অনস্বীকার্য। আমরা জানি তার প্রথম উপন্যাস ‘যেখানে খঞ্জনা পাখী’ পরবর্তী নামকরণ (অনুর পাঠশালা) রচিত হয় (১৯৬৭) যা গ্রন্থাকারে (১৯৭৩) প্রকাশ, কিন্তু এক সাক্ষাৎকারে মাহমুদুল হক নিজেই জানিয়েছেন,‘ দ্রৌপদীর আকাশে পাখি’ উপন্যাসটি তার প্রথম রচিত, কিন্তু সিনেমা পত্রিকা ‘রূপছায়া’তে দুটো কিস্তি ছাপার পর কি এক অজানা কারণে আর বের হয়নি, এবং যেহেতু তিনি সম্পূর্ণ উপন্যাসটি পাঠিয়েছিলেন তাই পরবর্তীকালে দেখা যায় পত্রিকাওয়ালারাও সেই পা-ুলিপিটি হারিয়ে ফেলে’। ‘জীবন আমার বোন’ রচনাকাল (১৯৭২) গ্রন্থাকারে প্রকাশ (১৯৭৬) পাঠকনন্দিত উপন্যাস, মুক্তিযুদ্ধের উত্তাপস্পন্দিত সময়স্রোতের তা-ব-গর্জন এ উপন্যাসের সীমিত পরিসর ক্যানভাসে হয়ে উঠেছে জীবন্ত। উপন্যাসের সর্বত্রই মাহমুদুল হকের ভূমিকা নির্মোহ দর্শকের মতোই। ‘কালো বরফ’ এর রচনাকাল (১৯৭৭) কিন্তু প্রকাশকাল (১৯৯২) উপন্যাসটি বাংলাভাষার একটি উপন্যাসের সর্বত্রই মাহমুদুল হকের ভূমিকা নির্মোহ দর্শকের মতোই। ‘কালো বরফ’ এর রচনাকাল (১৯৭৭) কিন্তু প্রকাশকাল (১৯৯২) উপন্যাসটি বাংলা ভাষার একটি দুর্লভ রচনা, ভাব-ভাবনায় বিষয়-বৈচিত্র্যে স্বতন্ত্র ভাষারীতির ব্যবহারে, কাহিনীর মেজাজ-স্বর এবং গভীরতায়, কখনো ইঙ্গিতধর্মী বাক্য ও উপমায় তিনি সফলতার শীর্ষে পৌঁছে গেছেন। এক সাক্ষাৎকারে মাহমুদুল হক নিজেই স্বীকার করেছেন, পছন্দের লেখা উপন্যাস ‘কালো বরফ’। কারণ হিসাবে, বাহুল্যহীন-মেদহীন ঝরঝরে একটা উপন্যাস, বেশ কমপ্যাক্ট আর গোছানো লেখা, মাহমুদুল হক স্বীকার না করলেও বলতেই হয়, আত্মজৈবনিক অনেকটাই এবং সম্ভবত সমস্ত পাঠকই উপন্যাসটিকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে। জীবন ভাবনার গভীরতা, প্রত্যক্ষণের নিজস্বতা এবং অনন্য রচনাশৈলীর নির্মাতা ছিলেন তিনিÑস্বদেশ-স্বকাল এবং ঐতিহ্য তার শিল্পভূমি। ‘কালো বরফ’ উপন্যাসে দেশভাগের পটভূমি ব্যাপকভাবে উঠে আসলেও লেখকের কাছে ছিচল্লিশের দাঙ্গা এবং সাতচল্লিশের দেশবিভাগ প্রাসঙ্গিক বলে কখনোই মনে হয়নি। উপন্যাসে তাই আমরা দেখি শেকড় হারাবার বেদনায় তিনি বিমর্ষ, বারংবারই ঘুরে ফিরে দেখাতে চেয়েছেন তার ছিঁড়ে যাওয়ার রহস্য। রহস্য প্রাসাদের সদর কপাটও উন্মুক্ত করে দেন মাহমুদুল হক, দেশভাগের রক্তক্ষরণের ভাষিক শিল্পরূপ প্রকাশিত হয়। শৈশব-কৈশোর তাড়িত এক ব্যক্তির স্বাতন্ত্র সত্তা উন্মেচিত হয়েছে। সেটা তার একেবারে নিজস্ব, এখানে অন্য কেউ নয়, তার বুদ্ধি-যুক্তি একান্ত তারই মতো করে। হাসান আজিজুল হক এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘তুমি যেখানে বড় হয়েছো, সারাজীবন তার যে দুর্দমনীয় আর্কষণ, কখনো সেটাকে অস্বীকার তো দূরের কথা, কখনোই তুমি এটার হাত থেকে নিস্তার পাবে না, তোমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াবে, বিশেষ করে সেখান থেকে তুমি যদি অন্যত্র সরে যাও’। হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ-দাঙ্গা দ্বেষ-ক্ষোভ এবং মিলন তার কাছে বড় বেশি স্বাভাবিক সামাজিক-রাজনৈতিক দ্বৈরথ। তার কাছে মুখ্য বিষয়টা হলো শেকড়হারা-বাস্তুছাড়া-শৈশবের জীবনহারা মানুষদের কেউ-কেউ অনিকেত বোধে আক্রান্ত হয়ে বয়ে বেড়ায় গভীর অসুখের অস্থিরতাকে, আর তাই দেখি আবদুল খালেককে, কখনো গিরিবালা, কখনো মাধুকে খুঁজতে। জীবন-রহস্যের জটিল দৃশ্যায়ন দেখতে পাওয়া যায় এ উপন্যাসে। তখন মনে হয় সত্যিই মানুষের জীবন কতটা কঠিন। মাহমুদুল হকের ‘নিরাপদ তন্দ্রা’ রচনাকাল (১৯৬৮) এবং প্রকাশ (১৯৭২) উপন্যাসটি কথাশিল্পী দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় পাঠ করেন এবং আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ‘লেখকের গদ্যশৈলী আর ঘটনা বর্ণনার নির্মোহভঙ্গি কত স্বাভাবিক, এ লেখকের মধ্যে মহৎ গুণাবলী আছে, তিনি যদি লিখে যান তাহলে বাংলাসাহিত্যে একটি নতুন পথ পাবে, গদ্য এবং বিষয়ের মধ্যে মানবিক গুণের এমন যুগ্ম মিলন সহসা ঘটে না।‘ জীবনের জটিলতা-সংগ্রাম-বেঁচে থাকার আর্তি-নিত্যসঙ্গী যৌনতার কদর্য ও কুৎসিত বহিঃপ্রকাশ জীবনের পরিধিকে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর করে দেয়। যৌনতাকে ঘিরে পুরুষের মনোবিকাশ, লালসারও বিশ্বস্ত প্রতিফলন হয় নিরাপদ তন্দ্রায়। জগদীশ গুপ্ত ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় হিংসা-লালসা-ঈর্ষা ও নারীকে ভোগ করবার সংঘর্ষে লিপ্ত মানুষের নানা সার্থক চিত্রায়ণ ফুটে ওঠে, বাংলা উপন্যাসে এই ধারায় মাহমুদুল হকও বিশিষ্ট হয়ে উঠেছেন নিরাপদ তন্দ্রার অতলস্পর্শী ভুবন নির্মাণে। আবদুল খালেককে অহর্নিশি তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় তার শৈশব, অনেক পেছনে ফেলে আসা সেই কৈশোর,আর চিরচেনা সেই সমস্ত কাছের মানুষগুলো। সোনারকাঠি রুপারকাঠিতে মোড়ানো তার সেই স্বর্ণোজ্জ্বল শৈশবই দিনযাপনের গ্লানি থেকে মুক্তি দেয়, নিজেকে তখন মুক্ত বিহঙ্গ ভাবে, খুঁজে পায় অন্য আরেক জগত। শৈশব যে কি মধুর তার রহস্য অর্থাৎ কুলকিনারা কেউ পায়, আবার কেউ পায় না, এই পাওয়া-না পাওয়ার রেশ ধরেই মাহমুদুল হক পরিচয় করিয়ে দিয়েছে ‘কালো বরফে’র সঙ্গে। কালো বরফ নিয়ে বলতে গেলে বলতেই হয়, স্বদেশভাগ-প্রেম-কান্না-রোদনময়তা যেমন দেখি, আবার শুনতে পায় শৈশবের আকুতি। শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত দেশ বা মাটিÑযে দেশ বা মাটি তার জীবনের সবচেয়ে বড় অধ্যায়। মফঃস্বলের কলেজ শিক্ষক প্রথাবিচ্ছিন্ন মানুষ আবদুল খালেক এবং তার অন্তর্জগতের সম্রাট পোকা, এই নিয়েই তো ‘কালোবরফ’। পোকা আবদুল খালেকের শৈশব, আবদুল খালেক পোকার মেটামরফসিস জাতীয় রুপান্তর। আবদুল খালেক একজন বিচ্ছিন্ন এবং নিঃসঙ্গ মানুষ, যে নিজেই নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে, বলা যায় খানিকটা পিছিয়ে পড়া দলের মানুষ। এই দলছুট মানুষটির, তার শৈশব-কৈশোর ও বর্তমান এবং উভয়ের সমন্বয়ই চিত্রায়িত কতোগুলো স্মৃতি-বিস্মৃতি দৃশ্যপটই ‘কালোবরফ’। ভাষাচিত্রের তুলনা এককথায় অসাধারণ, শিল্পকে শিল্পের জায়গায় রেখে, জীবনকে সাজিয়েছেন অন্যভাবে, শব্দের-বাক্যের-চৈতন্যের স্বতন্ত্র একটা জগৎ নির্মাণ করে কান্নাকে নতুন ভাষায় নির্মিত করে তুলেছেন। কালো বরফ নানানভাবেই ভাবিত করে, তাড়িত করে হয়তো কখনো-সখনো আমাদের রোমাঞ্চিতও করেছে। ‘দেশ’পত্রিকায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘বাংলা গদ্যে প্রভুত্ব করার মতো যথেষ্ট ক্ষমতা মাহমুদুল হকের আছে।’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র আবদুল খালেক, শৈশবের পোকা চরিত্র। আমাদের মননে এতোটাই তীব্র ভাব তৈরি করে যে, শৈশবকালই মানুষের বিশুদ্ধ কাল বলে মনে হয়, এবং তা বড় রকমের একটা দাগও কাটে। পোকা দর্শনে চমৎকৃত হই এমন কি হতবিহ্বল হই, মাহমুদুল হকের মতো স্বর্ণধনী শৈশব কার হয়, যার নেই, তার তো শৈশবকালও নেই, সে হয়তো কাঙাল, জীবনভর সে এক অথর্ব পাথর। বালককালের এক চরিত্র পোকা, তাকে লেখক আলাদা এক জগতের বাসিন্দা করেন। শৈশবতাড়িত মানুষ সর্বদা শৈশবকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়। শৈশবের স্মৃতি বড় বেশি ভাবিত করে, পোকা যখন একসময় আবদুল খালেক হয়ে যায়, আবদুল খালেক হয়েও সে পোকাতেই নিজেকে দেখতে চায়। কালো বরফ-এ ছোট-বড় অনেক চরিত্র আছে, আরও আছে মজার অভিজ্ঞতা। জীবনকে এত কাছ থেকে দেখার সে অভিজ্ঞতা ক’জনের হয়, জীবনসত্তার কত কিছুই তো আমরা দেখেও দেখি না। শুধু তাই বা বলি কেন, মাহমুদুল হক তার সমস্ত উপন্যাস জগতকে এর ভেতর চালিত করেছে। এবং সমগ্র জীবনকে কেটে-ছিঁড়ে ভাগ বাটোয়ারা করে কালো বরফ নির্মিত করেছেন। কোথাও ফাঁকির আশ্রয় নেননি, নিজেকে পরিপূর্ণ সম্পৃক্ত করে সাজিয়ে-গুছিয়ে তুলেছেন। মধ্যবিত্ত খালেকের জীবন বড় জটিল হলেও স্ত্রী রেখা তাকে পরিপূর্ণতা দান করেছে, জীবনকে রাঙিয়ে তুলেছে নানান রূপে, নানান ছন্দে। আবদুল খালেকের বন্ধু মালেক, একজন লেখক, সবকিছুই ও কাজে লাগায়। সেই বন্ধুই অবশ্য খালেককে ডায়েরী লিখতে অনুপ্রাণিত করে, নিজের জীবনের কাহিনীসর্বস্ব ডায়েরী। মালেকের ফরমায়েশ মেটাতেই খালেক রাত জেগে লিখতে থাকে (ডায়েরি) পোকার জীবনেতিহাস অর্থাৎ নিজের শৈশব। কিন্তু রেখার ঝাঁঝালো প্রশ্নবাণের উত্তরে খালেকের ভাষায় (যা বলার মতো তেমন কিছু নয়) এই হিজিবিজি। অমিয়ভূষণ মজুমদার রচিত গড় শ্রীখণ্ড, উত্তরবঙ্গের পটভূমিকায় এই উপন্যাসের সৃষ্টি, বিগত পঞ্চাশের মন্বন্তরের ভয়াবহতা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশ বিভাগের ফলে দুই বাংলার সীমান্তবর্তী এলাকার প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের বিপর্যস্ত ও ঘূণে ধরা জীবনচর্চার পটভূমি নিয়েই এই লেখা, মানবপ্রবাহের জীবনসংগ্রামের মহাকাব্যিক শিল্পরূপ। এর পাত্র-পাত্রী সমাজের বিভিন্ন স্তরের, গ্রামাঞ্চলের নানান শ্রেণীর চরিত্রের সমাবেশে ও একটি অঞ্চলের ভৌগোলিক পরিবেশ, সমাজচেতনার বিশ্বস্ত ভঙ্গিকে ও জীবনচিত্রণের দক্ষতায়, লেখকের বাস্তব অভিজ্ঞতার পরিচয় পাওয়া যায়, বিশেষ কাকুতি মিশ্রিত এই উপন্যাসে। কমলকুমার মজুমদার এর ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ উপন্যাসে, দেশভাগের নানান রাজনৈতিক-সামাজিক সমস্যা দেখতে পাওয়া, এখানেও দেশবিভাগের মর্মবেদনা ফুটে উঠেছে প্রবলভাবে। প্রফুল রায়ের কেয়া পাতার নৌকা, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নীল কণ্ঠ পাখির খোঁজে, রমাপদ চৌধুরীর বনপলাশীর পদাবলী, মহাশ্বেতা দেবীর আঁধার মানিক উপন্যাসে যেমন দেশবিভাগের হাহাকার ফুটে উঠেছে, ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে যে অনাস্থা-অসন্তোষ রেখাপাত করেছে, তারই বিকাশ লক্ষ্য করা যায় প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে, তেমনি আবদুল মান্নান সৈয়দ ভাঙানৌকা বা ইছামতির এপার-ওপার উপন্যাসে দেশ বিভাগের পটভূমিকা যেভাবে তুলে ধরেছেন, এবং বুকের ভেতরের কষ্টকে নিংড়ে-নিংড়ে পাঠককে জানিয়েছেন, উদ্বাস্তু হয়ে আসা মানুষের জীবন এবং তার যন্ত্রণা কত গভীর তাও অঙ্কিত করেছেন। কিন্তু মাহমুদুল হক কালো বরফ উপন্যাসে উদ্বাস্তু মানুষের মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার ছবি অঙ্গিত করেছেন সফলতার সঙ্গে, একজন মানুষ কখনোই বাল্যস্মৃতি ভুলতে পারে না। এখানে অন্য এক হাহাকার অঙ্কিত হয়েছে. যেখানে রাজনীতি নেই, আছে শুধুমাত্র মানবিক দিক। নিজের বাল্যকালকেই ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস, পক্ষান্তরে নিজেকেই বারংবার তুলে ধরেছেন সময় এবং মানুষের কাছে। যতোই সে জীবনের কাছে ফাঁকি দিয়ে চলুক না কেন, প্রকৃতপক্ষে সে শৈশবকে আঁকড়ে থাকতে চায়, জীবনের নানান বাঁকে পিছু ফেলা দিনগুলো ছুটে আসে। ছুটে আসে ফেলে আসা জীবনের নানান মুখগুলো, যারা কোনদিন তাকে আর ফিরে পাবে না, সেও ফিরে পাবে না সেই হারানো শৈশব, কেনারাম কাকার ভালোবাসা। উপন্যাসের মূল প্রতিপাদ্য ছিল ‘সেই বোধহয় প্রথম তার ছিঁড়ে গেল সবকিছুর, সে তার আর কখনো জোড়া লাগলো না, আর কখনো জোড়া লাগবে না’। সেই তার মানে সম্পর্কের তার, দেশ ভাঙার তার, হৃদয় ভাঙার তার, আত্মীয়স্বজন পরিবেশ-পরিচিতি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার তার, বাল্যস্মৃতি আর বাল্যসঙ্গীদের থেকে ছিন্ন হওয়ার তার, যে তার আর কখনো জোড়া লাগবে না এবং সম্ভবও নয়। রেডক্লিপ নামের ব্যক্তিটি ভারতবর্ষের মানচিত্র কাঁটাছেঁড়া করে, বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করে হাজার বছরের যন্ত্রণার মহাসমুদ্রে নিক্ষেপ করেছে, তারই যন্ত্রণায় দগ্ধ একজন ছিন্নমূল মানুষ মাহমুদুল হক। সেদিন রেডক্লিপ কি জানতো দেশভাগ কতখানি হৃদয়াকাশকে ছিন্নভিন্ন করবে উভয় অঞ্চলের সাধারণ মানুষকে, যারা হয়তো তেমনভাবে রাজনৈতিকভাবে সচেতন নয় অথবা ওসবের ঘেরাটোপের মধ্যে যেতেও চায় না, কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত তারাই বেশি হবে। আবেগ দিয়ে বিচার করলে হৃদয় ভাঙার এই কষ্ট কোনোদিনই পূরণ হবার নয়। কালো বরফ দেশভাগের পটভূমিতে লেখা, কিন্তু তারপরও লেখকের কাছে একটা প্রশ্ন থেকেই গেছে, ’৪৬-এর দাঙ্গা এবং ৪৭-এর দেশবিভাগকে মেনে নিতে কোথায় যেন বাধে তার। নিজের শৈশব হারানো দলে হয়তো থাকতে চায়নি, অথবা নিজেকে আপন ভূমি বা বাস্তুভিটা থেকে উদ্বাস্তু হতে সাধ হয়নি। কিন্তু তারপরও দেশান্তরী হতেই হয়েছে,সবই হয়তো নিয়তির খ-ন। আবদুল খালেক হারিকেনের আলোয় সারারাত্রি ডায়েরি লেখে, নিজের স্মৃতিবিজড়িত জীবনের কথা লেখে, স্মরণ করে সে সমস্ত স্বাধীন দিনের কথা, স্ত্রীকে মিথ্যে বলে, বন্ধুর কাজে লাগবে বলে নিজে বাঁচে, স্ত্রীকে সময় না দেওয়ার জন্য মান-অভিমান চলে, আসলে নিজেকে লুকিয়ে রাখার এ এক ভিন্ন কৌশল। পেছনের স্মৃতি নিয়ে বাঁচতে চায়, ওর মধ্যে ডুবে থেকে ভুলতে চায় বর্তমানকে। টিপু ভাইজানকে নিয়ে জড়াজড়ি করে শুয়েছে একসময়, অথচ আজ সবই যেন রূপকথা, আদ্যিকালের গপ্পো। কতোদিন না দেখার সেই যন্ত্রণা বুকের মধ্যে ফুঁড়ে ওঠে। রেখাকে কখনো গিরিবালা ভেবে আদর করার ফল হিসাবে, রেখা বললে, গিরিবালা মাগীটা কে শুনি, হঠাৎ তার কথা মনে পড়লো কেনো? আবদুল খালেক বাইরের দিকে হাত বাড়ালো, বললে, ‘বাইরে আকাশ বলে একটা কিছু আছে, তা জানো তো! সেখানে একটা চাঁদ আছে, গোল চাঁদ, ওই চাঁদের ভেতর হাঁটু মুড়ে কতকাল ধরে বসে আছে, চরকার সুঁতো কাটছে বসে-বসে।’ বৃষ্টির দিনে কাগজের নৌকা বানানোর ধুম পড়ে যেতো, মনি ভাইজান তিন পালের জাহাজ তৈরি করতো, রানিবুবুর বিড়াল কুন্তির সঙ্গে কতো রঙের খেলা চলতো, হঠাৎ একদিন কুন্তি মারা যায়, কেনারাম কাকা একটা বিড়াল এনে হাজির হলেন, রানিবুবুকে সান্ত¡না দিতে। একবার একটা শালিকের সঙ্গেও বন্ধুত্ব হয়, মনি ভাইজান বললে, শালিকটা আমাদের এক বোন, তুলি, তুলি পাখিকে খুব ভালোবাসতো শৈশবে, তুলিপাখির ভাষা পুঁটি খুব বুঝতো, কথা বলতো, একদিন শালিকটাকে পুঁটি বললে, ও তুলি পা ভাঙলে কেনো, তোমার পায়ে কি হয়েছে। ক্যাঁ-ক্যাঁ করে শালিকটা ডাকার পর পুঁটি বললে, দেখছো- দেখছো, কী বজ্জাত, পাকিস্তান চায় বলে হিন্দু পাখিরা নাকি ওর ঠ্যাং ভেঙে দিয়েছে। মাহমুদুল হক উপন্যাসের ভেতরে গল্প বোনেন বাবুই পাখির বাসার মতো, মনি ভাইজানকে মনে পড়তেই পোকার মনে আসে মনি ভাইজানের জামার পকেটে একটা ফিতে, ফিতেয় চুলের গন্ধ...সেই গন্ধ অনেক দুঃখেরÑযে দুঃখ অনেক ভালোবাসা, যে ভালোবাসায় অনেক ছেলেবেলা...লেখকের ভাষায়, ‘এইভাবেই তো একদিন সব কিছু গল্প হয়ে যায়’। নগেন স্যাকরার কতো ফাঁকিবাজি ছিলো, কথা দিয়ে কখনো কথা সে রাখতো না ঠিকই, কিন্তু লোকটা তেমন একটা মন্দ ছিল না। বউ-ছেলে-মেয়ে সবাই ছিলো ওর। তারপরও সে হাটখোলার মাধুর ঘরে পড়ে থাকতো, মাধু ছিলো বিধবা, কেউ ছিলো না ওর, বাড়ি-বাড়ি ঘুঁটে আর গুল বেচতো, হাসলে ওর গালে টোল পড়তো। নগেনের ছিলো রাজরোগ, একদিন দেখা গেলো হঠাৎ-ই লোকটা মারা গেলো, তারপর মাধুকে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখেছিলো পোকা, মনি ভাইজান শুধালে জানায়, মানুষটা মরে গেছে। স্মৃতি মনে করে ওমন কান্না আর কাউকে কখনো কাঁদতে দেখেনি পোকা, মানুষ শুধুমাত্র ভালোবাসার জন্যই হয়তো ওভাবে কাঁদে। মাধু কি ভালোবাসতো নগেনকে? সেই ভালোবাসার কথা মনি ভাইজান এবং পোকা ছাড়া আর কে বা জানতো! মাধুর ভালো নাম ছিলো মাধুরী, মাধুর ভেতর থেকে বোধহয় মাধুরীই কেঁদে উঠেছিলো সেদিন ওমন করে, সত্যিকার ভালোবাসার জন্য এমন কান্না ক’জন কাঁদতে পারে। এরপর একদিন সত্যসত্যিই হুট করে পাকিস্তান হয়ে গেলো, আব্বা বলতো, মাথা উঁচু করে চলতে পারাটাই বড় কথা, যেখানে মাথা উঁচু করে থাকতে পারবো, সেটাই দেশ। আব্বা আরো বলতো, এক দেশ না ছাড়লে আরেক দেশ পাওয়া যায় না, সকলের জীবনেই একবার হিজরত আছে, রসুলুল্লাহর কথা ভুলে গেলে, তিনি মক্কা থেকে মদিনা শরীফকেই বেছে নিয়েছিলেন। তার ছিঁড়ে যায় আবদুল খালেকের, সেই বোধহয় প্রথম তার ছিঁড়ে গেলো সবকিছুর, সে তার কখনো আর জোড়া লাগবে না। দোফালি বঙ্গের মতো দ্বিখণ্ডিত হয় আবদুল খালেক। একভাগে কেনারাম কাকার দেওয়া নামে পোকার বসবাস, অন্যভাগে বর্তমানের কলেজ শিক্ষক আবদুল খালেক। আসবার সময় কেনারাম কাকা মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘ভালো থেকো, যেখানেই যাও ভালো থেকো, মানুষ হয়ো’। ওমন একজন মানুষকে আবদুল খালেক খুঁজে যায় আজো, ভালোবাসার জন্য তার এই খোঁজা, সেই খোঁজার যেন কোনো শেষ নেই। তার শিল্পের প্রকরণ ও প্রকৃতির স্বরূপ নির্ণয়ের আগে অবশ্যই তার শিল্পীব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যটির স্বরূপ সন্ধান করা আবশ্যক। কারণ যে কোনো শিল্পীর ব্যক্তিত্বের বিশিষ্টতা দিয়ে নির্ধারিত হয় তার শিল্পের রূপ-প্রকৃতি। উপন্যাসের নির্মাণ-উপকরণ কেবল ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্যর মধ্যে কিংবা ব্যক্তিমনের গলি-ঘুঁজিতেই খুঁজে পাওয়া যায় না, উপন্যাসের মূল উপাদান মানুষের সমাজ ও সমাজবাস্তবতা। তিনি নিজেই বিশ্বাস করতেন, ‘উপন্যাসের সুনির্দিষ্ট চিরন্তন কোনো প্রকরণ থাকতে পারে না, কারণ সময়ের সাথে-সাথে প্রকরণ পরিবেশ আইডোলজি বদলে যায়।’ দেশভাগ মানুষের মনকে যে শূন্যতায় নিয়ে যায় এবং হৃদয় মানস প্রতিক্রিয়ায় যে আউটসাইডার বোধ সৃষ্টি করে জীবনচর্যায়, জন্মভূমি ও ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হয়ে আসা মাহমুদুল হক যেন স্বয়ং হয়ে ওঠে এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র। জীবন অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ ও নানা টানাপোড়েনে অসুখী নায়ককে বাস্তুভিটা ত্যাগের বেদনা সারাক্ষণ এক যন্ত্রণায় শূন্যতায় স্থাপন করে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুল নাচের ইতিকথার শশী এবং মাহমুদুল হকের কালো বরফ-এর আবদুল খালেক আমাদের চেতনালোকে একাকার হয়ে মিশে গেছে। নরহরি ডাক্তার আর আবদুল খালেকের মধ্যে অনেক গল্প হয়, কাছের মানুষ বা প্রিয় স্বজনের সাথে যেমন কথা হয় মানুষের। গল্পের বিষয় ছিলোÑকলেজের আর্থিক অবস্থা নিয়ে কথা, ছাত্র ভর্তি কমে যাওয়া, অনুদান শূন্য হওয়া, কলেজ ফ্যান্ডের শূন্যতাÑএ’সমস্ত বিষয়াদি বড় ভাবিত করতো খালেককে। যা আলাপ প্রসঙ্গে বলতো, নিজের মাষ্টারী চাকুরী থাকবে না হয়তো, তারও আভাস দিতো । আরো কথা হয় নিজের স্ত্রী অর্থাৎ টুকুর মায়ের শারীরিক অবস্থা নিয়ে, নরহরি ঔষধ দেয়। আবদুল খালেকের কলেজ সহযোগীদের কাউকেই তার তেমন ভালো লাগে না। কারণ তার চিন্তায়, এরা স্থুল, পরশ্রীকাতর এবং লোভী আর অসৎ। আর সে কারণে নিজেকে গুটিয়ে রাখে ওদের কাছ থেকে সর্বদা। মন মরা হয়ে হাঁটে, বাড়ি ফেরে, প্রকৃতির দৃশ্য দেখতে-দেখতে কতো কিছুই না ভাবে, তার ভাবনার শেষ নাই, স্মৃতি তারপরও তাকে অহর্নিশি তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। কোথাও তার কোনো আড়াল নেই, সব কিছুই তার কাছে খোলা, নিজেকে শুধু অনেকটা ভেতরে রাখতে চায়, কারো কাছে ধরা দিতে ইচ্ছে হয় না। প্রকৃতির মতো রহস্য হয়ে থাকতে তার সাধ, নদী-মাছরাঙা পাখি-বর্ষার পানি ধানক্ষেত-হাঁসেদের খলবল-গ্রাম, হাঁটা পথে খালেকের মন কতো কিছু দেখে, এবং তাকে মোহিত করে। রেখা মামার বাড়িতে মানুষ, মামির অবহেলা আর অত্যাচারে তার সমস্ত অতীত ছেঁড়া-ছেঁড়া, রেখার ইচ্ছে ছিলো মামিকে সব কিছু ফেরত দেবে, কিন্তু পারেনি কিছুই করতে, আশাভঙ্গের যন্ত্রণা বড় তীব্র। আবদুল খালেকেরও ইচ্ছে ছিলো, নিজের মাকে কাছে রাখার, কিন্তু কোনো রকম আগ্রহই দেখালো না রেখা। মনে বড় দুঃখ পেয়েছে সে, মাঝে-মাঝে শুধু একটি কথাই ভেবেছে, এতো অনীহা-এতো অশ্রদ্ধা কেনো রেখার, ভেতর থেকে ভাষাসর্বস্ব খোয়ানো, এমন একটা নিরাপদ মানুষকেও ঠাঁই দিতে পারলো না রেখা একদিনের জন্য! বুকের ভেতর সে কষ্ট বড় জাগ্রত, মায়ের স্মৃতি-ভালোবাসা বড় জাগ্রত, ভুলতে পারে না কোনোভাবে। মানুষ কি সব ভুলতে পারে। সবাইকে ভোলা গেলেও কেউ-কেউ তো পেছন থেকে বেঁধে রাখে, চিরজনমের বাঁধনে, যেমন স্মৃতিময় বাল্যকাল, শৈশবের হারানো হাজারো চরিত্র। উপন্যাসের শেষ অর্থাৎ নবম এপিসোডের একটি শিরোনাম আছেÑ‘আলো ছায়ায় যুগলবন্দী’, সময়ের দুটি ভিন্ন স্পেসকে একই ফ্রেমে মিলিয়েছেন এখানে। এই শিরোনাম থেকে মালেকের জন্য লেখা শৈশবকে ‘আলো’ এবং প্রথাবিচ্ছিন্ন কলেজ শিক্ষকের বর্তমান জীবনকে ‘ছায়া’ হিসেবে বিবেচনা করার অবকাশ থেকে যায়। আলো ও ছায়া আবদুল খালেকের অতীত ও বর্তমান। উপন্যাসের শেষে রেখা আর তার স্বামীর মনস্তাত্ত্বিক জটিলতাকে পরিপূর্ণ অর্থে অনুধাবণে সক্ষম হলেও আবদুল খালেক উবু হয়ে পড়ে থাকে স্মৃতির উরুতে, তার শৈশব-কৈশোরের মাধুরী এসে আবার স্থান করে নেয় রেখার চোখে-মুখে অবয়বে। নৌকা অভিসারের ব্যাপারটা খানিক অতিরঞ্জিত মনে হতেও পারে, কিন্তু যে উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত তা সার্থক হয়েছিলো সন্দেহ নেই। যে বরফ জমেছিলো শুধু খালেকের মনে, সে বরফ রেখার মনকেও আচ্ছন্ন করেছিলো, এবং তা ক্রমে-ক্রমে গলতে থাকে, হালকা রঙ্গ-খুনসুটি মাঝে-মাঝে পুরনো দাম্পত্য বচসা ও আবেগতাড়িত কান্নার ভেতর দিয়ে দুজনেই তাদের মন-প্রাণকে উজাড় করে দিতে লাগলো চলমান নৌকায়, যার দু’পাশে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের সারি, তামাম সৌন্দর্য যেন ঢেলে দিয়েছে, রেখার ভেতরেও যে এতো-এতো কথা জমা আছে, তা যেন প্রথম জানতে পারলো খালেক। রেখাকে বুঝতে না পারার জন্য, নিজেকে বোঝাতে না পারার জন্য অনুতপ্তও সঙ্গে-সঙ্গে, এই বোধহয় প্রথম দু’একটি কথায় খালেক তার শৈশবের অনুভবকে মেলে ধরে রেখার কাছেÑ সেই শৈশব যখন একটা সামান্য রোগা ঠ্যাঁং ভাঙা শালিককে দেখতে না পেলে একসময় এক একটা দুপুর...মিথ্যে হয়ে যেতো! শোনার জন্য রেখা উদগ্রীব হয়ে থাকে, আর নির্ঝরের মতো ঝরে পড়তে থাকে পোকার শৈশব-চিত্রকল্প। অবশেষে আত্মাকে উন্মোচন করে খালেক বলে, সারাজীবনের সঞ্চয় শুধু এটুকুই। এই সামান্য স্বপ্নটুকুই, তখন ধরে নিতে হয় সে বেঁচে আছে কেবল স্মৃতির ভেতর। অবশেষে একটা অজানা গ্রামের ভেতর নির্জন জঙ্গলে নৌকা ভিড়ানো হলো, ঘাসের বিছানায় ঘনিষ্ঠ হয়, আবেগ ভরে পরস্পরকে ডাকে, বন্য পশুর মতো আদিম তীব্র অস্থির মিলন যেন আগে কখনো ঘটেনি। যৌনতাই হয়ে ওঠে যেন মুক্তি। নিজেকে নতুন করে সামনে তুলে ধরার অভিপ্রায়। অতীত বর্তমানের যে দ্বন্দ্ব প্রতিটি মানুষের অন্তর্গত সত্তায়, অভিন্ন অবিচ্ছেদ্য সূত্রে গ্রথিত করার মধ্য দিয়ে উপন্যাসের পরিসমাপ্তি। মাহমুদুল হক বাঙালীর গল্পকথন-রীতিতে তার নিজস্ব উপস্থাপনা কৌশলের আশ্রয় অত্যন্ত নাটকীয়, তারপরও কোথায় একটা প্রশ্ন যেন রেখেই দেয়। তার উত্তর মেলে না সহজে। মনকে জাগ্রত করে, উন্মেচিত করে কখনো হয়তো আরো প্রশ্নের সামনে দাঁড় করায়।
×