ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

গওহর গালিব

সাহিত্যের খুঁটিনাটি ॥ পত্রসাহিত্য

প্রকাশিত: ০৭:১১, ১৩ অক্টোবর ২০১৭

সাহিত্যের খুঁটিনাটি ॥ পত্রসাহিত্য

বহুল পরিচিত ‘পত্র’ শব্দটি একেবারেই নৈমেত্তিক বিষয় হলেও ‘পত্রসাহিত্য’ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, বিশেষত লিটারেচারের ক্ষেত্রে। প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে অদ্যাবধি প্রেরক ও প্রাপকের মধ্যে ভাব ও সংবাদ আদানপ্রদানের ক্ষেত্রে প্রয়োজনভিত্তিক এক জনপ্রিয় যোগাযোগ মাধ্যম হলো পত্র বা চিঠি। সে জায়গায় এ পত্রই যখন সাহিত্য হয়ে উঠে তখন তা ব্যক্তিক আবেদনকে অতিক্রম করে হয়ে ওঠে সার্বজনীন। শিল্পসৌকর্যের মাধ্যম হিসেবে পত্রসাহিত্যের জন্ম আধুনিককালে হলেও; অতি প্রাচীনকাল থেকেই যে পত্রসাহিত্যের ব্যবহার ছিল এ বিষয়ে দ্বিমতের কোন অবকাশ নেই। ঐতিহাসিক দিক থেকে বিবেচনা করলে আমরা দেখব, আমাদের গদ্য সাহিত্যের উৎসও এই পত্র। রাজা কিংবা ভূস্বামীগণ যেসব পত্র লিখেছিলেন, সেসবই বর্তমানে গদ্যের নমুনা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। ধারণা করা হয় ১৫৫৫ খ্রিঃ অহোমরাজ স্বর্গনারায়ণকে লেখা কোচবিহারের মহারাজা নরনারায়ণের লিখিত পত্রই আমাদের বাংলা গদ্যের প্রথমদিককার নমুনা। শুধু তাই নয় মিথ বা পুরাণের মধ্যেও পত্রের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। গ্রিক পুরাণের পাশাপাশি ভারতীয় পুরাণ অর্থাৎ রামায়ণ-মহাভারতেও পত্র রচনার উল্লেখ আছে। যেমনÑ মহাভারতের নল-দয়মন্তী উপাখ্যানে দয়মন্তী হংসের পায়ে বেঁধে পত্র প্রেরণ করেছিলেন রাজা নলকে। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে যে, পত্রের মধ্য দিয়ে মনের ভাব আদান-প্রদানের বিষয়টি বহু পুরনো। তবে পত্রের আঙ্গিকটি ব্যবহার করে সাহিত্য রচনার বিষয়টি সত্যি অভিনব। শুধু বাংলা সাহিত্যেই নয়, বহু পূর্ব হতে ইংরেজী সাহিত্যেও পত্রকে আঙ্গিক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন স্যামুয়েল রিচার্ডসনের ‘পামেলা’ ইংরেজী সাহিত্যের বহুল পঠিত একটি পত্রোপন্যাস। অন্যদিকে বাংলা সাহিত্যে পত্রের আঙ্গিককে শুধু উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হয়নি। বরং কাব্য রচনার ক্ষেত্রেও পত্রের ব্যবহার প্রাজ্ঞ কবিকুলের কাছে এক ব্যতিক্রমী শিল্পমাধ্যম হিসেবে দারুণ জনপ্রিয়। এ ক্ষেত্রে মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যটি পত্র-কাব্য হিসেবে আজ ক্লাসিক সাহিত্যের মর্যাদা লাভ করেছে। ভারতীয় পুরাণের কিছু নারী চরিত্র তাঁদের প্রেমিকের কিংবা স্বামীর উদ্দেশে কল্পিত পত্র রচনা করেছেন, এই হলো ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের বিষয়বস্তু। উল্লেখ্য যে, নারীর ‘আমিত্বের’ প্রশ্নে ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের নারীদের যে উচ্চারণ তা নারীবাদী আন্দোলনের ডিসকোর্স হিসেবে বহুলভাবে পঠিত ও প্রশংসিত। বাংলা উপন্যাসের ক্ষেত্রে পত্রের আঙ্গিককে যাঁরা সচেতনভাবে ব্যবহার করেছেন, তাঁদের মধ্যে নটেন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্যতম। তাঁর রচিত ‘বসন্তকুমারের পত্র’ উপন্যাসটি পত্র-সাহিত্যের উদাহরণ হিসেবে সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কাজী নজরুল ইসলামও এই সময় একটি পত্রোপন্যাস রচনা করেন, নাম ‘বাঁধন হারা’। এই ধরনের অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের ‘ক্রৌঞ্চমিথুন’, ‘বনফুলের ‘কৃষ্টিপাথর’, বুদ্ধদেব গুহর ‘মহুয়ার চিঠি’, ‘সবিনয় নিবেদন’ কিংবা নিমাই ভট্টাচার্যের ‘মেম সাহেব’। এ ধরনের উপন্যাসে নৈর্ব্যত্তিক কোন ভূমিকা থাকে না। উপন্যাস বা কাহিনীর চরিত্র নিজ নিজ কথা বলে তাদের চিঠি বা পত্রের মাধ্যমে। পাঠক সেই চিঠির মাধ্যমেই সমসাময়িক বিষয়, ঘটনা বা রাজনৈতিক বাস্তবতা সর্ম্পকে জানতে পারেন। অর্থাৎ উপন্যাসের কাহিনী, চরিত্র, ঘটনা বা বর্ণনাÑ সবই উপস্থাপিত হয় পত্রের মাধ্যমে। তবে এ কথা স্বীকার্য যে, শুধু পত্র ব্যবহার করে সাহিত্যরচনা নয় কিংবা সাহিত্য রচনার আঙ্গিক মাত্রও নয় ; বরং বিশুদ্ধ পত্র হিসেবে রচিত পত্রও ক্ষেত্র বিশেষে পত্র-সাহিত্যের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হতে পারে। সত্যিকারের কবি বা সাহিত্যিকগণ তাঁদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার্য লেখাজোকার মধ্যেও সাহিত্যের বিচিত্র উপাদান ও উপকরণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে যান। এক্ষেত্রে তাঁদের রচিত চিঠিপত্রে তাঁদের স্ক্ষ্মূ অনুভূতি, মনন কিংবা বোধ ও বোধির পরিচয় পাওয়া যাবে, এটাই স্বাভাবিক। সে কারণে পাশ্চাত্যের কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে কবি কীটস্, জর্জ বার্নার্ড শ, ওয়ালপোল, লর্ড টেনিশন, কুপার, লুকাস প্রমুখের রচিত পত্রাবলী আমাদের নিকট ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। বাংলা সাহিত্যেও এরকম বেশ কিছু পত্র প্রকাশের পর, তা পরবর্তীকালে সাহিত্যের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। এদের মধ্যে নবীনচন্দ্র সেনের ‘প্রবাসের পত্র’, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘বিলাতের পত্র;’, স্বামী বিবেকানন্দের ‘পত্রাবলী’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তবে বাংলায় পত্র-সাহিত্যের ক্ষেত্রে যাঁর অবদান সবচেয়ে বেশি, তিনি হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি সমস্ত জীবনভর অসংখ্য বিষয় ও ঘটনার প্রেক্ষিতে পত্র রচনা করেছেন, যে সবের সাহিত্যমূল্য আজ অনেক প্রশ্নাতীত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্রসংবলিত পুস্তকাকারে প্রকাশিত গ্রন্থাবলী আজ বহুলভাবে পঠিত। এক্ষেত্রে তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলোÑ ‘য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র’, ‘ছিন্নপত্র’, ‘জাপানযাত্রী’, ‘রাশিয়ার চিঠি’, ‘পথে’, ও ‘পথের প্রান্তে’ ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এসব চিঠিপত্রে আমরা বিচিত্র বিষয়ের আস্বাদ পাই। রবীন্দ্রনাথ তাঁর পত্রে কখনও লঘু ভাষায় মনের হালকা চিন্তার বহিঃপ্রকাশ করেছেন; আবার তাঁর কোন কোন পত্র দার্শনিক চিন্তায় ভাস্বর হয়ে উঠেছে। মূলত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরেই পত্র-সাহিত্য আজ বাংলা সাহিত্যাকাশে বিশাল ও বিস্তৃত ক্যানভাস জুড়ে বিরাজ করছে।
×