ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৯ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

শেখ মিরাজুল ইসলাম

ধারা-বাহিক উপন্যাস ॥ মোঘল গীবত

প্রকাশিত: ০৬:১১, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭

ধারা-বাহিক উপন্যাস ॥ মোঘল গীবত

লাল টিউলিপের বাগান ১৫ এপ্রিল, ১৬৫৮ সাল। মধ্যরাত হতে আকাশ ভেঙ্গে মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে। প্রচণ্ড মেঘের গর্জনে মনে হচ্ছিল ভূমিকম্প হচ্ছে। আওরঙ্গজেব শুনেছিলেন তার জন্মের আগে আগ্রায় এক ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প হয়েছিল। ভেঙ্গে খান খান হয়ে গিয়েছিল কেল্লার দেয়াল ও উঁচু গম্বুজওয়ালা মিনার। এটা কিসের ইঙ্গিত? মহারাজ যশোবন্ত সিং ঝড়-বৃষ্টি দেখে আনন্দিত বোধ করলেন। একে শুভ লক্ষণ মনে করলেন। নিশ্চয় আওরঙ্গজেব-মুরাদ বাহিনীর গোলন্দাজরা এই আবহাওয়ায় কিছুটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বে। রাজা রাই সিং শিশোদিয়াকে যুদ্ধক্ষেত্রের ডান পাশে এবং নওয়াব ইফতেখার খানকে বাম পাশে রেখে আক্রমণ করার কথা চিন্তা করলেন মহারাজ। রাঠোর বাহিনীর অশ্বারোহী সৈন্যরা বিদ্রোহী বাহিনীর পরিখাগুলো টপকে গেলে দানিশ খানের গোলা বারুদে বাড়তি ভরসা করার প্রয়োজন নেই। ওদিকে আওরঙ্গজেব সিদ্ধান্ত নিলেন এই বৈরী আবহাওয়াকেই কাজে লাগাতে হবে। গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধান মুর্শিদ কুলি খানের একান্তে সঙ্গে পরামর্শে বসলেন শাহজাদা। -দারা’র রাজকীয় বাহিনীকে সকালের আলো ফুটলেই আক্রমণ করতে হবে। আওরঙ্গজেব যুক্তি দিলেন। বৃষ্টির পানি জমে পুরো এলাকা জলাভূমি হয়ে পড়েছে। কাদামাখা ডোবা-নালায় রাজপুতদের ঘোড়ার গতি অকার্যকর হয়ে যাবে। আপনার বিদেশী সৈন্যদের নিয়ে গড়া গোলন্দাজ বাহিনীর ওপর আমি অনেক ভরসা করছি। -আপনি নিশ্চিত থাকুন মহামান্য। দারা’পুত্র সুলাঈমান এই মুহূর্তে পাটনায় শাহ সুজার পেছনে ব্যস্ত। পূর্ণ শক্তির মুঘল রাজকীয় বাহিনীর মোকাবেলা করতে হচ্ছে না আমাদের। খোদার দরবারে শুকরিয়া করুন। অভিজ্ঞ মুর্শিদ কুলি খান বয়ান দিলেন। তারা আরও সিদ্ধান্ত নিলেন যুদ্ধে শাহজাদা মুরাদকে ডান দিকে ও আওরঙ্গজেবের ছোট ছেলে মোহাম্মদ আজমকে বাম দিকে আক্রমণের দায়িত্ব দিয়ে বড় ছেলে মোহাম্মদ সুলতানকে থাকবেন তার পিতার হাতি বাহিনীর অগ্রভাগে। মুরাদকে যুদ্ধ পরিকল্পনার চূড়ান্ত সঙ্কেত পাঠিয়ে একাকী পশ্চিমমুখী অবস্থায় জায়নামাজে বসলেন আওরঙ্গজেব। বাকি রাত ইবাদত করেই কাটিয়ে দেবেন। মাত্র দুই ঘণ্টা ঘুম তার জন্য যথেষ্ট। আগ্রার আকাশে ধর্মাতের কালো মেঘ তখনও এসে পৌঁছায়নি। তবে ভ্যাপসা গরমে অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল আগ্রাবাসীর। লাল কেল্লার হেরেমখানার বাঈজীরা হেরেম প্রধান খোজা নাজিরের কাছ হতে ভূগর্ভস্থ হেরেমখানা থেকে বের হবার অনুমতি পেয়েছেন। তারা মুক্ত হাওয়ায় জটলা পাকিয়ে আকবরী মহলের চার কোনাকৃতি খোলা বারান্দায় ঝর্ণার পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে বসে অলস সময় কাটাতে থাকলেন। নিñিদ্র প্রহরা বসানো হলো সেখানে। কেবলমাত্র সম্রাট ও শাহজাদা ছাড়া অন্তঃপুরের অন্য পুরুষ সদস্যদের সেখানে প্রবেশ নিষেধ। বাঈজীদের কেউ কেউ আরাম পেতে শরীরের সব কাপড় খুলে নগ্ন হয়ে ঝর্ণার চৌবাচ্চার পাশে শুয়ে পড়লেন। কেউ গুন গুন করে রেওয়াজ করছেন ‘ মেরে পিয়া বোলে’ দেশী সুরে, কেউ তার সঙ্গে যন্ত্র সঙ্গীতের সঙ্গত করার চেষ্টা করছেন। আবার কেউ নাচের মুদ্রা ঝালিয়ে নিচ্ছেন। কেউ বা উপভোগ করছিলেন যমুনার শোভা। সম্রাটের আদরের প্রিয় কন্যা পাদশাহ বেগম জাহান আরা নিজেও দাক্ষিণাত্যের সীমানায় শুরু হওয়া ধর্মাতের যুদ্ধের উৎকণ্ঠা ভুলে যেতে চাইলেন। একান্ত দাসী কানিজ আলমাসকে তার নিজস্ব হাম্মানখানায় গা ধোয়ার প্রস্তুতি নিতে বললেন। শরীর ভিজিয়ে কয়েক মুহূর্তের জন্য তিনিও ভুলে যেতে চান হিন্দুস্থানের ভবিষ্যত চিন্তা। -কুসুম গরম পানিতে গোলাপ পাপড়ি ছড়িয়ে দেবো নাকি আতরের সুগন্ধিমাখা ঠাণ্ডা চৌবাচ্চা, কোনটা পছন্দ বেগম জানের? কানিজ আলমাস জিজ্ঞাসা করলেন জাহান আরা’কে। ভারি রেশম কাপড়ের নক্সা কাটা পর্দা দিয়ে ঘেরা হাম্মানখানায় আতরের চৌবাচ্চায় সম্পূর্ণ নিরাভরণ হলেন জাহান আরা। দেয়ালে ঝোলানো আয়নায় নিজের দিকে তাকালেন। খুলে রাখলেন সম্রাটের উপহার দেয়া রক্ত লাল রুবি পাথর বসানো গলার হার। ঘাড়ের এক পাশে আগুনে পোড়া ক্ষতের দিকে তাকিয়ে মুখ কুঁচকে গেল। ছোট বোন রোশেন আরা’র ঈর্ষা নাকি পূর্ব পুরুষের অভিশাপের আগুনে এই পোড়া দাগ? চৌবাচ্চায় ধ্যান মগ্ন আসনে বসলেন শাহজাদী। যা অতীন্দ্রিয় অলৌকিক এবং অপূর্ব, তার প্রতি অস্বাভাবিক অবান্তর অস্থিরতা দিন দিন যেন বেড়েই চলেছে জাহান আরার। স্মৃতিতে ধাক্কা দিচ্ছে মুঘল পূর্ব পুরুষদের রেখে যাওয়া হাজারো কীর্তি। কিছু আনন্দের, কিছু বেদনার। প্রাণ ভরে আতরের সুঘ্রাণ নিলেন তিনি। এই নতুন সুগন্ধি আতর আবিষ্কারের গল্পটি তিনি শুনেছিলেন দাদীজান নূরজাহানের কাছ থেকে। বাদশাহ জাহাঙ্গীরের প্রিয় বেগম নূরজাহানের আম্মিজান আসমত বেগমের শখ ছিল সুগন্ধী বানানো। নিজের পছন্দ অনুযায়ী সুগন্ধী তৈরি করতেন। একদিন তিনি পাত্রের মধ্যে গোলাপ ফুলের রস বানাতে গিয়ে উনুনে একটু বেশি জ্বাল দিয়ে ফেলেছিলেন। ফুটন্ত পানিতে ফুলের রসের সর ভেসে উঠছিল। সেই গাদওয়ালা ঘন রস একটু একটু করে আলাদা পাত্রে তিনি সরিয়ে রাখলেন। এরপর সেই জমাট বাঁধা তরল রস এক ফোঁটা হাতের তালুতে আলত করে লাগিয়ে দেখলেন কড়া গন্ধ অনেকক্ষণ ধরে গায়ে লেগে আছে। এভাবে তৈরি হলো এক নতুন সুগন্ধী। আতর নামের এই সুগন্ধীর সুবাস অন্দর মহল হয়ে পুরো বাদশাহী মহলে ছড়িয়ে পড়লো। জাহাঙ্গীর খুশি শাশুড়ি আম্মা আসমত বেগমকে মুক্তার মালা উপহার দিয়ে পুরস্কৃত করলেন। এর আগে মুঘল হেরেমে এবং দরবারের হাম্মানখানায় গায়ে মাখার সুগন্ধী সাবান হিসেবে তখন সানতুক, আরগাজা, গুলকামা, রুহ আফজা, অপটানা, আবীর-মায়া, কিসতা, ফাতিলা, ঘাসুল বিভিন্ন নামের সুগন্ধী চালু ছিল। সেই সুগন্ধীগুলো মূলত বানানো হতো নানা রকমের গাছের শিকড় ও ফুলের মিশ্রণে। এর কাঁচামাল সংগ্রহ করা হতো সাইপ্রাস, ইরান, বাহরাইন, চীন, সুমাত্রা, জাভা, তুরস্ক ও ভারতের বিভিন্ন জায়গা থেকে। ফুল হিসেবে ব্যবহৃত হতো মালশ্রী, রাই-বেল, কেতকী, জুঁই, নার্গিস, কেওড়া, চামেলী, চম্পা, মোতি, গুল-ই-জাফ্রান, চালতা, পদ্ম, শাপলা, হেনা, মালতি, গোলাপ। সব ফুলের নির্যাস হতে তৈরি হতো অম্বর-ই-আসহাব, মুশক, জাফরান-ই-কাশ্মীর, জাফরান-ই-কুমুদিনী, জাবাদ, কুফর-ই-চায়না, আরক–ই–গুলাব, লোবান, চন্দন, আরক–ই-চাম্বেলী প্রভৃতি নামের দামী সুগন্ধী। ইতিহাসের ছাত্রী হিসেবে জাহান আরা জানেন মুঘলদের প্রতিটি অবদানকে যেমন সবাই মনে রাখবেন, তেমনি প্রতিটি ভুল আগামী বংশধররা চুলচেরা বিশ্লেষণ করবে। গীবত করবে, ক্ষমা করবেন না। ত্রিশূলে বিদ্ধ করবে অথবা আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দেবে। কিতাবখানায় পুরানো সভ্যতার-সাম্রাজ্যের বই ঘেঁটে তিনি এই সত্য বুঝেছেন। গ্রীক- রোমান-পারস্য-বাইজেন্টাইন-আব্বাসীয় খলিফার যুগ থেকে শুরু করে মহান পূর্ব পিতা কুবলাই খানের বংশধর তৈমুরদের ইতিহাসে পণ্ডিতরা শান্তির চেয়ে যুদ্ধের গল্পই বেশি লিখে গেছেন। ইতিহাস অনেক বেশি রক্ত পছন্দ করে। সম্রাটের অসুস্থতার পর কিভাবে এতো দ্রুত চারপাশ বদলে গেল তা ভাবতে গিয়ে অবাক হলেন জাহান আরা। সম্রাট অসুস্থ হবার মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে আগ্রার দোরগোড়ায় যুদ্ধের সাজে উপস্থিত হয়েছেন আওরঙ্গজেব। ঘটনা শুনে মনে হচ্ছে দারার কাছ থেকে সিংহাসন ছিনিয়ে না নেয়া পর্যন্ত তিনি থামবেন না। তারপর? মহলের ভেতর থেকে বাঈজীদের গান বাজনার রেওয়াজের আওয়াজ ভেসে এলো। সেই সুরের বিচ্ছিন্ন আওয়াজে আনন্দের দিনগুলোর স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে চাইলেন শাহজাদী। চোখের সামনে দুলে উঠলো দারার বিয়ের আতশবাজি আর হাজারো মানুষের উৎফুল্ল কাফেলা কিংবা কাবুল-কাশ্মীরের সাজানো বাগান আর জমজমাট রেশম বাণিজ্যের পথ বেয়ে আসা বিদেশী বণিকদের ফেরি করা রেশমী কাপড়-মসলার বাজার। একই সঙ্গে দিল্লীর লাল কেল্লায় গান বাজনায় কাটানো অজগ্র সুফী-কাওয়ালীর রাতগুলো তাকে আবারও দুঃখী ভারাক্রান্ত করে তুলল। সেই দিনগুলো থাকবে তো? বিষণœতা ভুলে স্মরণ করতে চাইলেন হারিয়ে যাওয়া প্রিয়তম খেদমতগার আরিফ খানের সুন্দর মুখ আর উদ্দাম ভালবাসাবাসির চরম মুহূর্তগুলো। জাহান আরার জীবন থেকে আরিফকে সুকৌশলে সরিয়ে দেবার জন্য মনে মনে তিনি সম্রাটকে ক্ষমা করতে পারেননি। দিল্লী-আগ্রায় সেসব আনন্দের দিনগুলোর কথা ভাবতে ভাবতে আতর গোলাপে সুরভিত সাদা মার্বেল পাথরের চৌবাচ্চায় ডুব দিলেন শাহজাদী। তার গাঢ় লাল ঠোঁটের সমান্তরালে ভরাট নিটোল স্তনের গোলাপী বৃন্ত যুগল পদ্ম ফুলের কলির মতো ভেসে উঠল। আড়াআড়ি ভাঁজ করা ধবধবে সাদা পায়ের গোছা অতিক্রম করে দৃষ্টি চলে যায় আরও গভীরে, উন্মুক্ত কটিদেশে। সেই ভাসন্ত সৌন্দর্যের দিকে তাকালে চোখ ফেরানো মুশকিল। অল্পক্ষণ পর আনমনে নিজের অঙ্কুরিত কুঁড়ি-ফুলের পাপড়ি স্পর্শ করতে থাকলেন শাহজাদী। অদৃশ্য সুরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে এক সময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন নির্জন হাম্মানখানায়। ঘুমের ভিতর আধো স্বপ্নে দেখতে পেলেন ধর্মাতের মাঠ রক্তে ভিজে লাল টিউলিপের বাগান হয়ে গেছে। যত দূর চোখ যায় বৃষ্টি আর কাদায় মাখামাখি হয়ে পড়ে আছে রাজপুত ও মুঘল সৈন্যদের স্তূপাকৃতি লাশের সারি। অজগ্র যুদ্ধঘোড়া মোরগের পালকের লাল-বেগুনি শিরস্ত্রাণ পড়ে দিশেহারা হয়ে লাশগুলোর ওপর দৌড়ে বেড়াচ্ছে। আরও দেখলেন এক বিশাল কালো হাতীর পিঠে রক্ত ভেজা তরবারি হাতে বসে আছেন আওরঙ্গজেব। ভর দুপুরের দুঃস্বপ্নে জোরে ঘন নিশ্বাস নিতে থাকলেন জাহান আরা। হঠাৎ স্বপ্নের ভেতর আওরঙ্গজেবের অট্টহাসি কানে আসতেই আতঙ্কে অস্ফুট চিৎকারে চৌবাচ্চা ছেড়ে লাফিয়ে উঠলেন শাহজাদী। উপচে পড়লো চৌবাচ্চার পানি। -ওহ! খোদা! নাহ! জাহান আরার বেদনা বিহ্বল কোমল আর্তনাদ হাম্মানখানার আতর সুবাসিত বাতাসে মিলিয়ে গেলো। কেউ শুনতে পেলো না। (শেষ)
×