ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

ধা রা বা হি ক ॥ উপন্যাস ॥ মোঘল গীবত

প্রকাশিত: ০৭:০৪, ৫ মে ২০১৭

ধা  রা  বা  হি  ক ॥ উপন্যাস ॥ মোঘল গীবত

(পূর্ব প্রকাশের পর) আওরঙ্গজেবের চিঠি সময় দ্রুত বয়ে চলেছে। সেই সঙ্গে যমুনা-নর্মদা-সবরমতী নদীগুলো আরব সাগরের সঙ্গে মিতালী পেতে অবিরাম জোয়ার-ভাটায় জানান দিচ্ছে সময় আর স্রোত কারও জন্য অপেক্ষা করে না। সময়ের আঁচড় আজকাল খালি চোখে দেখা যায়। আওরঙ্গজেব যেন একটু বেশি দেখছেন। এই তো দৌলাতাবাদের মজবুত প্রাচীরে পাখির বাসা আর শেওলা জমেছে। অজন্তা আর ইলোরা গুহায় রাত হলে বাদুড়ের ঝাঁক পুরো আকাশ ছেয়ে ফেলে। চোখের সামনে দ্রুত বদলে যাচ্ছে পুরনো কিল্লা শহর ফতেহাবাদ। আওরঙ্গবাদ নামটি আদৌ টিকবে কি? খোদ আওরঙ্গজেব যদি না জেতেন এই মাটির পৃথিবীর মায়ার সংসারে, নাম তো দূরের কথা নিশানাও থাকবে না ভবিষ্যত মুঘল সাম্রাজ্যে। যুদ্ধ ও রক্তপাত এখন অনিবার্য সত্য। বিজাপুরের আদিল শাহ আর গোলকোন্দার কুতুব শাহকে আগেই চিঠি লিখে রেখেছেন আওরঙ্গজেব। দিল্লী অভিযানে বের হলে তাদের পক্ষ হতে পেছন দিক হতে আক্রমণের আশঙ্কা আপাতত নেই। দিল্লীতে সুন্নি আমির ও মৌলানারা গোপন সঙ্কেতে জানিয়ে দিয়েছেন মুরতাদ দারার পক্ষে তারা নেই। এখন মুরাদকে শান্ত করে তার কথা মতো কাজ করাতে পারলেই দিল্লী-আগ্রা দখল করার দরজা খুলে যাবে। বাকিটা খোদার সহায়। জোরে নিশ্বাস ফেলেন শাহজাদা। যা করার এখনই করতে হবে। ইতোমধ্যে সুলাইমান আর সুজা মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে ফেলেছে। সুজাকে এই সুযোগে নিজের পক্ষে টেনে আনলে দারার বিপক্ষে জেতার সম্ভাবনা আরও বেড়ে যায়। তার আগে মুরাদকে বিশ্বাস করাতে হবে ভাইদের মধ্যে আওরঙ্গজেবই শ্রেষ্ঠ। জোহরের নামাজ শেষ করলেন শান্তভাবে আওরঙ্গজেব। জায়নামাজে ঠায় বসে থেকে চিঠিতে কি লিখবেন তার ছক আঁটতে থাকলেন। চোখ বন্ধ করে থাকার দরুন বোঝার উপায় নেই তিনি তসবিহ টিপে ধ্যান করছেন, নাকি হিন্দুস্তানের হিসাব মেলাচ্ছেন। প্রিয়তম ভাই মুরাদ, “... এখন যেহেতু সিংহাসনে আরোহণের নমুনাটা স্থির করা হয়েছে, আর আমার ধর্মীয় লক্ষ্য হলো অধার্মিকতা আর পৌত্তলিকতার যে কণ্টকময় আগাছা ছড়িয়ে পড়েছে তা নির্মূল করা। ইসলামের এই সাম্রাজ্য থেকে এবং পৌত্তলিকদের নেতা, তার অনুসারী এবং তাদের শক্তির উৎসসমূহকে দমন ও মূলোৎপাটন করা, যাতে হিন্দুস্তানে এই অস্থিরতার ধুলা স্থির লাভ করতে পারে। যেখানে আমার প্রিয় ভাই, যে আমার নিজ হৃদয়ের সমান ভালবাসার, সেও আমার এই পবিত্র অভিযানে আমার সঙ্গে যোগদান করেছে। সে নতুন করে সহযোগিতার সকল শর্ত (যা আমাদের মধ্যে আগে থেকেই ছিল) অনুযায়ী দৃঢ় ও পূর্ণাঙ্গ বিশ্বাসের সঙ্গে, যা তার ওয়াদা ও অঙ্গীকার, এই নিশ্চয়তা দিয়েছে যে, ধর্ম ও সাম্রাজ্যের শত্রুদের সমূলে উৎপাটনের পর যখন সাম্রাজ্যে শান্তি পুনর্¯’াপিত হবে, তখনও সে তার এই মৈত্রী ও সাহায্যের দৃঢ় অবস্থানে অটল থাকবে। এই একইভাবে সর্বক্ষণ, সর্বক্ষেত্রে এবং সকল কাজে সে আমার বন্ধু ও সহযোগী হয়ে থাকবে, সে আমার বন্ধুর বন্ধু, আমার শত্রুর শত্রু হয়ে থাকবে এবং সে কোন জমির দখলদারিত্ব দাবি করবে না, শুধু সর্বজনীন সাম্রাজ্যের অল্প একটু অংশ যা তার জন্য ছেড়ে দেয়া হবে, তাই সে নেবে। সুতরাং আমি এই লিখছি যে, আমাদের এক ও অভিন্ন লক্ষ্যের প্রতি, হৃদয়ের একই অভিন্নতা এবং সদিচ্ছার প্রতি আমাদের এই ভাই যতক্ষণ পর্যন্ত কোন প্রকার অনভিপ্রেত আচরণ প্রদর্শন না করছে, তার প্রতি আমার ভালবাসা ও সদিচ্ছা প্রতিদিন বাড়বে বৈ কমবে না। আমি আমাদের লাভ বা লোকসানের মধ্যে কোন বিভেদ করব না, সকল পরিস্থিতিতে সব সময় তাকে সাহায্য করব। আমি বরং তাকে বর্তমানের চাইতেও বেশি প্রাধান্য দেব যখন আমার প্রধান লক্ষ্য অর্জন করব ও এই অভিশপ্ত পৌত্তলিকদের সমূলে উচ্ছেদ করব। আমি আমার ওয়াদা রক্ষা করব ও পূর্বের পরিকল্পনা ও সমঝোতা অনুযায়ী আমি তাকে পাঞ্জাব, আফগাস্তিান, কাশ্মীর এবং সিন্ধ (ভাক্কার ও টাট্টা) ছেড়ে দেব এবং আরব সাগরের সেই পুরো অঞ্চল দিয়ে দেব এবং এ ব্যাপারে আমার কোন আপত্তি থাকবে না। যখনই সেই পৌত্তলিকের মূলোৎপাটন করা হবে এবং এই সাম্রাজ্যের বাগান থেকে অস্থিরতা আর কন্টকময় আগাছা পরিষ্কার হবেÑ এই ন্যায় কাজে তোমার সাহায্য ও সাহসিক বন্ধুত্ব অত্যন্ত জরুরীÑ তাই অনতিবিলম্বে আমি তোমাকে এই অঞ্চলে রওনা দেয়ার অনুমতি দিচ্ছি। আল্লাহ এবং রাসুল আমার এই সদিচ্ছার সাক্ষী থাকলেন ...।” তিনজন স্বল্পবসনা সুন্দরীর মাঝে শুয়ে চিঠিটা বার বার পড়লেন শাহজাদা মুরাদ। সন্ধ্যায় বিশেষ দূত রমজান আলী চিঠিটা তাকে দিয়ে গেছেন। আবার উল্টেপাল্টে দেখতে থাকলেন চিঠিটা। আলোর বিপরীতে ধরে দেখলেন, চোখ বন্ধ করে গভীরভাবে নাক দিয়ে ঘ্রাণ নিলেন। বোঝার চেষ্টা করলেন চিঠিটা নকল কি না। একই চিঠি কি সুজাকেও পাঠানো হয়েছে? মুহূর্তেই চিন্তাটা ঠেলে দূর করতে পারলেন না। যতেœর সঙ্গে ভাঁজ করলেন চিঠিটা। এটা অনেক জরুরী নিশানা হবে সামনের দিনে। যুদ্ধের পরিণতি যাই হোক আওরঙ্গজেবের মনোবাসনা স্পষ্ট হয়েছে চিঠির প্রতিটি অক্ষরে। সেয়ানা মানুষ তিনি। পরোক্ষভাবে হুমকিও দিয়ে রেখেছেন। মুরাদ ঠিক বুঝতে পেরেছেন চিঠির দ্বিতীয় অর্থ। তবে সব কিছু নির্ভর করছে আসন্ন যুদ্ধজয়ের ওপর। চিঠির প্রতিটি শব্দ মুরাদের মাথায় আঘাত করছিল। স্থির হতে পারছিলেন না শাহজাদা। অথচ যুদ্ধ অভিযান শুরুর আগে মাথা স্থির করা সবচেয়ে জরুরী। শরীর সায় দিলেও মাথা কাজ করছে না। মুরাদ টের পেলেন তার সঙ্গী তিনজনের কামোত্তেজনা এখনো বাকি রয়ে গেছে। তাদের হতাশ করা ঠিক হবে না। অবশেষে মুরাদ দুষ্টুমির হাসি দিয়ে নির্দেশ দিলেন স্বর্ণদণ্ডের কৃত্রিম অঙ্গসদৃশ বিশাল অপদ্রব্যটি তার কোমরে বেঁধে দেয়ার জন্য। এই অযাচিত প্রাপ্তিতে তিন সঙ্গিনী আনন্দে খিলখিল করে একসঙ্গে হেসে উঠলেন। অস্থির সময়ে এমন রাত পাওয়া তো ভাগ্যের ব্যাপার। (চলবে)
×