দাম্পত্যে দূরত্ব

এটি এমন এক সম্পর্ক যেখানে স্বামী-স্ত্রী মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন, কিন্তু সামাজিকভাবে বা আইনত তারা বিবাহিত থাকেন। এটি এমন এক পরিস্থিতি যখন দুটি মানুষ একই ছাদের নিচে বসবাস করলেও তাদের মধ্যে কোনো মানসিক সংযোগ, আবেগিক আদান-প্রদান বা পারস্পরিক বোঝাপড়া থাকে না। এটি প্রচলিত বিবাহবিচ্ছেদের মতো কোনো আইনি প্রক্রিয়া নয়, বরং এটি সম্পর্কের একটি অদৃশ্য ভাঙন।
নীরব বিচ্ছেদের লক্ষণসমূহ: নীরব বিচ্ছেদের কিছু সাধারণ লক্ষণ হলো- স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অর্থপূর্ণ কথোপকথন একেবারেই কমে যায়। তারা দৈনন্দিন কাজকর্ম নিয়ে কথা বললেও আবেগিক বা ব্যক্তিগত বিষয়ে কোনো আলোচনায় থাকে না। একে অপরের প্রতি ভালোবাসা, সহানুভূতি বা আগ্রহের অভাব দেখা যায়। কোনো পক্ষই অন্যজনের অনুভূতি বা প্রয়োজন নিয়ে মাথা ঘামায় না। দম্পতিরা ইচ্ছাকৃতভাবে একে অপরের সাথে সময় কাটানো এড়িয়ে চলেন। তারা নিজেদের আলাদা রুটিন তৈরি করে নেন এবং যার যার নিজস্ব কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। শারীরিক ঘনিষ্ঠতা সম্পূর্ণভাবে বা আংশিকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। এটি মানসিক দূরত্বের একটি বড় প্রতিফলন। ছোটখাটো বিষয় নিয়েও ভুল বোঝাবুঝি হয় এবং কেউ ক্ষমা চাইতে বা বিষয়টি মিটমাট করতে আগ্রহী হয় না। দম্পতিরা একসাথে কোনো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করেন না। প্রত্যেকেই নিজেদের ব্যক্তিগত লক্ষ্য ও স্বপ্ন নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। একে অপরের সফলতা বা ব্যর্থতায় কোনো রকম আগ্রহ বা অনুভূতি প্রকাশ পায় না।
কারণ: অনেকগুলো কারণে নীরব বিচ্ছেদ হতে পারে। এর মধ্যে কিছু প্রধান কারণ হলো- ছোটখাটো সমস্যাগুলো সমাধান না হয়ে দীর্ঘদিন ধরে জমতে থাকলে তা বড় ধরনের মানসিক দূরত্ব তৈরি করে। একবার বিশ্বাস ভঙ্গ হলে তা আবার ফিরিয়ে আনা কঠিন হয়ে পড়ে, যা নীরব বিচ্ছেদের দিকে ঠেলে দেয়। একজন বা উভয় সঙ্গী যদি মনে করেন তাদের আবেগিক চাহিদা পূরণ হচ্ছে না, তবে তারা মানসিকভাবে দূরে সরে যেতে পারেন। সন্তান লালন-পালন বা আর্থিক বিষয় নিয়ে তীব্র মতবিরোধ থাকলে তা সম্পর্কের অবনতি ঘটায়। অতিরিক্ত কর্মব্যস্ততা বা সম্পর্কের জন্য সময় না দেওয়াও নীরব বিচ্ছেদের একটি কারণ হতে পারে। অনুভূতি প্রকাশ করতে না পারা বা একে অপরের কথা শুনতে না চাওয়া সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করে। সাইলেন্ট ডিভোর্সের প্রভাব শুধু স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং এটি পুরো পরিবার, বিশেষ করে সন্তানদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। দম্পতিরা নিজেদের মধ্যে একাকিত্ব এবং হতাশা অনুভব করেন। বাবা-মায়ের এ নীরব বিচ্ছেদ দেখে সন্তানরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে এবং তাদের মানসিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি হয়। তারা ভুল ধারণা নিয়ে বড় হতে পারে যে, সম্পর্কে ভালোবাসা বা আবেগ প্রকাশ করা অপ্রয়োজনীয়। অনেক সময় দম্পতিরা সামাজিকভাবে নিজেদের গুটিয়ে নেন এবং বাইরে স্বাভাবিক থাকার ভান করেন। দীর্ঘদিনের মানসিক চাপ বিভিন্ন শারীরিক অসুস্থতার কারণ হতে পারে। এছাড়া আরও অনেক কারণ থাকে- স্ত্রী অসুস্থ হলে তার খোঁজ না নেওয়া, স্ত্রী-সন্তানের প্রতি দায়িত্বহীনতা। স্ত্রী-সন্তানকে সময় না দেওয়া। কখনো তাদের নিয়ে বাইরে ঘুরতে না যাওয়া, তার হাতে সময় থাকা সত্ত্বেও। স্ত্রীকে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মতো মনে না করে, একজন কাজের লোকের মত চালনা করা। একে অপরের আবেগ অনুভূতির মূল্যায়ন না করা।
প্রতিকারের উপায়: যদি আপনি বা আপনার পরিচিত কেউ এমন নীরব বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে যায়, তবে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে- স্বামী-স্ত্রীকে নিজেদের মধ্যে খোলাখুলি কথা বলতে হবে। নিজেদের অনুভূতি, চাহিদা এবং সমস্যাগুলো স্পষ্টভাবে তুলে ধরতে হবে। বিশেষজ্ঞ বা কাউন্সেলরের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। একজন তৃতীয় পক্ষ নিরপেক্ষভাবে সমস্যাগুলো বিশ্লেষণ করতে সাহায্য করতে পারেন। পুরানো স্মৃতিগুলো ফিরে দেখা এবং একসাথে নতুন কিছু করার চেষ্টা করা যেতে পারে।
একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি প্রদর্শন করা অত্যন্ত জরুরি। মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখা প্রয়োজন। নীরব বিচ্ছেদ একটি জটিল সমস্যা যা অনেক সময় অজান্তেই সম্পর্কের গভীরে শিকড় গেড়ে বসে। সঠিক সময়ে এর লক্ষণগুলো চিহ্নিত করতে পারলে এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারলে অনেক ক্ষেত্রেই সম্পর্ককে বাঁচানো সম্ভব। তবে যদি কোনোভাবেই সম্পর্ককে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব না হয়, তবে বিচ্ছেদকে একটি সুস্থ সমাধান হিসেবে মেনে নেওয়াও প্রয়োজন হতে পারে।