
শ্রম বিক্রির হাট
চট্টগ্রাম নগরীর আকবর শাহ সড়কের মুখ- ভোর ৬টা থেকে ভিড় বাড়ছে বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষের। তারা আসছেন শ্রম বিক্রি করতে। কারণ, এখানে পণ্যের মতই বিক্রি হয় শ্রম। বিভিন্ন জেলা থেকে নিম্ন আয়ের মানুষ এ হাটে আসেন শ্রম বিক্রির জন্য। এখানে শ্রম বিক্রি হয় দিন, সপ্তাহের চুক্তিতে।
আকবর শাহ এলাকায় এই শ্রম বিক্রির হাট গত চলে আসছে ২৮ বছর ধরে। প্রায় প্রতিদিন ভোরের সূর্য ওঠার আগ থেকে কাজের সন্ধানে পাঁচ শতাধিক নারী-পুরুষ জড়ো হন এখানে। মাটি কাটা, ভবন তৈরি, রাস্তার পিচঢালাই, ইট ভাঙ্গা, পাইলিং, গাছ কাটার মতো বিভিন্ন শ্রমের কাজ করে থাকেন এসব শ্রমজীবী মানুষ।
বিভিন্ন বয়সের শ্রমজীবী যারা এখানে আসেন তাদের অধিকাংশই আশ্রয়হীন হতদরিদ্র। সকাল থেকে সন্ধ্যা অথবা রাত পর্যন্ত কাজ করে বাড়ি ফিরে যান তারা। দৈনিক ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকায় শ্রম বিক্রি করেন তারা। শ্রমিকদের দলনেতাকে বলা হয় মাঝি। তার নেতৃত্বেই কাজে যান শ্রমিকরা। যানবাহনে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছে যান তারা। কাজের সন্ধানে আসা এসব শ্রমজীবীদের মধ্যে রয়েছেন- গাইবান্ধা, রংপুর, কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জেলার মানুষ।
দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বেশির ভাগ শ্রমিক রাজমিস্ত্রির কাজ করছেন বলে জানান রংপুরের মর্জিনা বেগম। তিনি বলেন, দৈনিক ৫০০-৭০০ টাকায় বিক্রি হন নির্মাণ শ্রমিকরা। দৈনিক ৪৫০-৫৫০ টাকা চুক্তিতে বিক্রি হন অন্যসব কাজের শ্রমজীবীরা। মাসে ১০-১২ হাজার টাকা চুক্তিতেও অনেকে কাজ করেন। কাজ হিসেবে চুক্তিভিত্তিক বেতন নেন কিছু শ্রমিক।
শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভোরে হাটে এলেও সকাল ৮টার মধ্যে যারা শ্রম বিক্রি করতে পারেন না তাদের ফিরতে হয় ‘শূন্য হাতে’। আবার টানা কয়েকদিন কাজ না পেলে অনেকে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় চলে যান কাজের সন্ধানে।
শ্রমিক নিতে আসা আব্দুল খালেক জানান, শ্রমিক দরকার তাই ভোরেই চলে এসেছি। স্থানীয় শ্রমিকদের থেকে অপেক্ষাকৃত কম মজুরিতে এখানে লোক পাওয়া যায়; তারা কাজেও বেশ আন্তরিক। তাই বেশির ভাগ মানুষই এখানে শ্রমিক নিতে আসেন।
মাঝি নবী উদ্দিন বলেন, দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা এসব শ্রমিক ভালো কাজ করেন। ফাঁকি দেয় না। তাই তাদেরকে দিয়ে কাজ করায়। শ্রম বিক্রি করতে আসা দিনাজপুরের জামিউল ইসলাম বলেন, কাজ না পেলে কষ্টে দিন পার করি। অনেক সময় না খেয়েও থাকি। আর পরিবারের জন্য তো কিছু পাঠাতেই পারি না।
গাইবান্ধা বাড়ি হলেও দীর্ঘদিন আকবর শাহ এলাকায় বসবাস করেন মো. সাগর। আর্থিক অবস্থা ভালো না হওয়ার কারণে কাজের আশায় এসেছেন বলে ২৬ বছর বয়সী এই তরুণ জানান, কোনো কোনো দিন কাজ পান, আবার কোনো দিন খালি হাতে ফিরতে হয়।
লক্ষ্মীপুরের জিল্লুর রহমানের বয়স ৬৭ বছর। দুই দশক ধরে শ্রম বিক্রি করেন আকবর শাহ শ্রম বিক্রির বাজারে। ভবন নির্মাণ বা রাস্তার কাজ করেন তিনি। দ্রব্যমূল বাড়লেও বাড়েনি তাদের আয়। বলেন, এ অবস্থায় সংসার চালানো কষ্টসাধ্য।
নারীরা শাড়ি আর পুরুষরা ছেঁড়া লুঙ্গি, শার্ট, টি-শার্ট ও পুরোনো প্যান্ট পরে ভোরে দলে দলে ছুটেন আসতে থাকেন আকবার শাহ শ্রম বাজারে। গলা ও কোমরে গামছা বাঁধা থাকে। পোশাক যেমনই হোক তাতে কারও ভ্রুক্ষেপ নেই। পরিবার নিয়ে দু’মুঠো খেয়ে বেঁচে থাকতে পারলেই তারা খুশি। আর এ কাজটি পেতে ঘুম চোখে ভোর থেকে শুরু হয় তাদের সারা দিনের লড়াই।