ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০২ জুন ২০২৫, ১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ভ্রমণকাহিনী 

ঘুরে এলাম চন্দ্রনাথ

মোঃ আমির আলী, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, বালাগঞ্জ, সিলেট

প্রকাশিত: ২৩:৫৩, ৩১ মে ২০২৫

ঘুরে এলাম চন্দ্রনাথ

পাহাড়ের চারদিকে সবুজ গাছপালা, লতা গুল্মে ভরপুর, মাঝে মাঝে পশু-পাখির ডাক আর মন জুড়ানো শীতল বাতাস। এই রোমাঞ্চকর অনুভূতি আপনাকে এনে দেবে এক পাহাড়সম মানসিক প্রশান্তি। বলছিলাম চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে অবস্থিত চন্দ্রনাথ পাহাড়ের কথা। যারা দুর্গম পাহাড়ি পথে হাঁটতে পছন্দ করেন, তবে তাদের জন্যই চন্দ্রনাথ পাহাড়।

ফেইসবুক ঘাঁটছিলাম হঠাৎ আড্ডা থেকেই শুরু হয় চন্দ্রনাথে যাওয়ার সিদ্ধান্ত। আমি, বন্ধু রুমন আর ছোট ভাই আবিদ। সিদ্ধান্তটা ছিল মাত্র কয়েক মিনিটের। যেই কথা, সেই কাজ। কয়েক দিন সময় হাতে নিয়ে অনেক প্রস্তুতি সম্পন্ন করে, আমরা প্রস্তুত হলাম। যেদিন ভ্রমনে যাবো সেদিন বৃহস্পতিবার থাকায়, বাসের টিকেট পেতে বেগ পেতে হলো, বাসের টিকেটের জন্য কয়েক কাউন্টারে যোগাযোগ করে না পাওয়ায়, শেষে মধ্যম ক্লাসের বাসের টিকেট কাটলাম ঢাকার জন্য। সন্ধ্যা ৭ টায় পৌঁছলাম সায়েদাবাদ বাস স্টেশনে। ঢাকায় পৌঁছে এশার নামাজ শেষে হালকা বিশ্রাম নিলাম। বিশ্রাম শেষে চা পান করলাম, যাতে ঘুমটা যায়। রাতের খাবার শেষে সায়েদাবাদ বাস স্টেশন থেকে চট্টগ্রাম সীতাকুন্ডে যাওয়ার জন্য বাসে উঠলাম, খুব ভোরে বাস সীতাকুন্ডে পৌছে দিলো।

আপাতত কিছুক্ষন এখানেই অবস্থান করতে হবে, গাড়ি চলাচল শুরু না হওয়া পর্যন্ত তাই শহরের রাস্তায় হাঁটছি, মনে হচ্ছে সীতাকুন্ডে নয়, যেন বাড়ির বারান্দায় পায়চারী করছি।

কিছুক্ষণ পর ফজরের নামাজ আদায় করে নিলাম, সীতাকুন্ডে সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা মসজিদে। নামাজ শেষে হালকা বিশ্রাম নিলাম আমরা। এতোক্ষনে সকাল প্রায় হয়ে গেছে। সবাই আস্তে আস্তে দোকান পাট খুলছে। ছোট একটা হোটেলে সকালের নাস্তা সেরে রওনা হলাম কাঙক্ষিত গন্তব্যে। শহর থেকে মাত্র দুই কিলোমিটারের পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছলাম চন্দ্রনাথ পাহাড়ের পাদদেশে। এ দুই কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে গিয়ে মনে হলো সীতাকুন্ডে যেন মন্দিরের শহর। রাস্তার দুই পাশে বিভিন্ন ধরনের অনেক মন্দির আপনার নজর কাড়বে। স্থানীয়দের এবং সি,এন,জির চালকের কাছ থেকে জানতে পারলাম, এই ছোট্ট এলাকায় প্রায় আড়াইশোর বেশি মন্দির আছে। এবং আমরা যে পাহাড়ের চূড়ায় চড়তে যাচ্ছি সেখানেও নাকি দুটি শিব মন্দির আছে। আগ্রহটা আরও বেড়ে গেল ১২০০ ফুট চন্দ্রনাথের চূড়ায় চড়ার।

সেখানে পৌছে দেখি আমাদের আগে অনেকে খুব ভোরে সেখানে পৌঁছে গেছে। পাহাড়ের নিচে ব্যাগ রেখে, বাশের লাটি কিনলাম, পাহাড়ী উঁচু নিচু পথে হাটতে সাহায্য হয় লাটি থাকলে। সব প্রস্তুতি নিয়ে রওয়ানা হলাম চন্দ্রনাথ পাহাড়ের পথে। প্রথমদিকে তেমন কষ্ট না হলেও তিনশো ফুট থেকে আপনাকে উঠতে হবে খাড়া পাহাড় বেয়ে। কখনোবা চলতে হবে এক পাশে পাহাড়ের গা ঘেঁষে আর অন্য পাশে খাদ নিয়ে। একবার পা ফসকালেই পড়তে হবে পাহাড়ের কয়েকশ ফুট নিচে। কোন কোন জায়গায় পথটা এতটাই সরু যে, দুজন মানুষ একসঙ্গে উঠা-নামা করা প্রায় অসম্ভব। আমাদের সাথের একজনতো বলেই ফেলেছিলো চলেন আমরা ফিরে যাই, আমি উনাকে বললাম, আপনি চলে যান আমি উপর দিকে উঠি। তারপর উনিও চললেন আমাদের সাথে। মাঝে মাঝে পাবেন প্রাচীনকালের তৈরি সিঁড়ি। চারদিকে নিরব-নিস্তব্ধ। মাঝে মাঝে শুনতে পাবেন চেনা-অচেনা পাখির ডাক। দেখতে পাবেন ঝরনাও। তবে আমরা যে সময় টায় গিয়েছিলাম সে সময় ঝরনা গুলো ছিলো পানিশূন্য মৃত্যুপ্রায়। প্রায় ঘন্টা দেড় হাটার পর আমরা পৌঁছলাম প্রথম পাহাড়ের চূড়ায়। সেখানে রয়েছে শ্রী শ্রী বিরূপাক্ষ মন্দির। অনেক প্রাচীন জীর্ণ শীর্ণ দেয়াল মন্দিরের। সেখানে কিছুক্ষন অবস্থান করে কিছু ছবি তুললাম। দর্শনার্থীদের কাছথেকে জানতে পারলাম এটা তাদের শিব দেবতার বাড়ি। প্রতিবছর এই মন্দিরে শিবরাত্রি তথা শিবর্তুদশী তিথিতে বিশেষ পূজা হয়। এই পূজাকে কেন্দ্র করে সীতাকুন্ডে বিশাল মেলা হয়। সীতাকুন্ড চন্দ্রনাথ পাহাড় এলাকায় বসবাসকারী হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা প্রতি বছর বাংলা ফাল্গুন মাসে (ইংরেজী ফেব্রুয়ারী-মার্চ মাস) বড় ধরনের একটি মেলার আয়োজন করে থাকেন। যেটি শিবর্তুদর্শী মেলা নামে পরিচিত। এই মেলায় বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান, থাইল্যান্ডসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে অসংখ্য সাধু এবং নারী-পুরুষ যোগদান করেন। পাহাড়ে এই মেলা চলে ১৩ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত। আর পাহাড়ের নিচে মেলা চলবে পুরো ফেব্রুয়ারী মাসজুড়ে।

কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে রওনা হলাম চন্দ্রনাথ পাহাড়ের সর্বোচ্চ চূড়ায়। সেখানেও নাকি একটা মন্দির আছে নাম, চন্দ্রনাথ মন্দির। বিরূপাক্ষ মন্দির থেকে চন্দ্রনাথ মন্দিরের ১৫০ ফুট রাস্তার প্রায় ১০০ ফুটই আপনাকে উঠতে হবে খাড়া পাহাড় বেয়ে। সেখানে নিজেকে সামলে রাখা অনেকটাই কষ্টকর। অবশেষে খাড়া পাহাড় বেয়ে মাটি থেকে ১২০০ ফুট উপরে চন্দ্রনাথ পাহাড়ে উঠলাম আমরা। পাহাড়ের চূড়ায় আরোহণ করে মনের মধ্যে আলাদা শিহরণ ও আনন্দ অনুভব করলাম।। চারপাশে সাদা সাদা কুয়াশা দৃষ্টি যতো দূর যায়, পাহাড় থেকে সীতাকুন্ডে শহর ও শহরের দালানগুলিকে ছোট ছোট কাগজের ঘরের মতো দেখায়।

চট্টগ্রামের সর্বোচ্চ উঁচু পাহাড় চন্দ্রনাথে দাঁড়িয়ে আপনি দেখতে পাবেন একদিকে সমুদ্র আর অন্য দিকে পাহাড়ের নির্জনতা। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকবেন উঁচু-নিচু পাহাড়ের সবুজ গাছপালার দিকে। প্রশান্তিতে জুড়িয়ে যাবে চোখ। যত দূর চোখ যাবে আপনি শুধু সাদা সাদা কুয়াশা দেখতে পাবেন। সেখানে কিছুক্ষন অবস্থান করে অনেক ছবি তুললাম আমরা।

এবার নিচে নামার পালা। কিছুটা নিচে নামার পর আপনি, প্রয়োজনীয় খাবার পানি, ডাবের পানি, কলা ও অন্যান্য ফলের দোকান পাবেন। আমরাও এরকম দোকান থেকে কলা ও পানি নিয়ে খেলাম।

পাহাড় থেকে নিচে নামার সময়ও আপনি মুগ্ধ হবেন। কারণ, এই পাহাড়ের দুটি রাস্তা রয়েছে। আপনি যদি আগে বিরূপাক্ষ মন্দির হয়ে উঠেন সেটা হবে আপনার জন্য বুদ্ধিমানের কাজ। কারণ, চন্দ্রনাথ মন্দির থেকে নামার রাস্তার সিড়ির ধাপগুলো অনেক বড় বড়। এই পথে উঠতে গেলে আপনি খুব দ্রুত ক্লান্ত হয়ে যাবেন। আর নামতে গেলে আপনি পাবেন দুই পাহাড়ের মাঝের সুরঙ্গ রাস্তা। এই সুরঙ্গ রাস্তাগুলো আপনার মধ্যে আলাদা একটা অনুভূতি এনে দেবে।

এখানে সব সময়ই বাতাস থাকে। যা আপনার ক্লান্ত দেহকে এক মুহূর্তেই শীতল করে দেবে। এবং এই পাহাড় থেকে নিচে নামা একদম সহজ নয়। একটু পা পিছলেই আপনি মারাত্মক অবস্থার মুখোমুখি হতে হবে। পাহাড় থেকে নেমে সোজা সীতাকুন্ড বাজারে হোটেলে ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার সেড়ে নিলাম। এরপর সোজা পথ ধরলাম গোলিয়াখালী সমুদ্র সৈকতের দিকে। এখানে সন্ধ্যা পর্যন্ত অবস্থান করলাম। এরপর ফিরে এলাম সীতাকুন্ড এখান থেকে সোজা রাতে বাসে ঢাকায়। অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়দের জন্য চন্দ্রনাথ পাহাড় একদিনের রোমাঞ্চকর আদর্শ ট্যুরও বলা যায়।

 

রাজু

×