
গ্যাস লাইটিং — নামটা হয়তো পরিচিত নয়, কিন্তু এর ছায়া আমাদের জীবনে অনেক সময় ছড়িয়ে পড়ে। এটি আসলে এক ধরনের মানসিক অত্যাচার, যেখানে এক ব্যক্তি অন্যজনকে ধীরে ধীরে বিভ্রান্ত করে নিজের ধারণা এবং অনুভূতিকে ভুল বোঝাতে বাধ্য করে।
এই শব্দটি এসেছে একটি পুরোনো ফিল্ম “Gas Light” থেকে, যেখানে একজন স্বামী তার স্ত্রীর সঙ্গে এমন খেলায় লিপ্ত হয় যে, ঘরের গ্যাস লাইট ধীরে ধীরে কমানো হলেও তিনি তা অস্বীকার করেন। স্ত্রীর বিশ্বাস ভেঙে যায়, এবং তিনি নিজেকে পাগল ভাবতে শুরু করেন। গ্যাস লাইটিং-এ ঠিক এ রকমই একটি মনস্তাত্ত্বিক কৌশল ব্যবহার করা হয়।
গ্যাস লাইটিং কিভাবে ঘটে?
গ্যাস লাইটিং মূলত ঘটে যখন একজন পার্টনার বা খুবই ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি অন্যজনকে ধীরে ধীরে তাদের নিজস্ব বাস্তবতা নিয়ে সন্দিহান করে তোলে। তারা যেকোনো ভিকটিমের ভাবনা, বিশ্বাস এবং অনুভূতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, ভিকটিমকে নিজেদের চিন্তাধারা ভুল বলে বিশ্বাস করায়। এটি একটি ক্ষমতা খেলার কৌশল, যার মাধ্যমে গ্যাস লাইটার ভিকটিমের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।
গ্যাস লাইটিংয়ের মাধ্যমে ভিকটিমের আত্মবিশ্বাস ধ্বংস হয়, তারা নিজের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে, নিজেদের ভুল ভাবতে শুরু করে এবং অবশেষে মানসিক সমস্যায় ভুগতে শুরু করে। এ ধরনের অত্যাচার সাধারণত ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের মধ্যে ঘটে — যেমন সঙ্গী, বন্ধু, কর্মক্ষেত্রের সহকর্মী, বাবা-মা বা অন্য কোনো আত্মীয়।
গ্যাস লাইটিংয়ের লক্ষণগুলো
অপরাধবোধ চাপিয়ে দেওয়া
ছোটোখাটো বিষয় নিয়ে ইগনোর করা বা মিথ্যা অপমান করা
বাস্তবতা পরিবর্তনের প্রচেষ্টা
ভিকটিমের প্রতিটি কথাবার্তা বা আচরণ ভুল মনে করানো
আত্মবিশ্বাস ভেঙে ফেলা এবং নিজের ভুল ভাবার বাধ্যতা সৃষ্টি করা
প্রথমদিকে অনেকেই বুঝতে পারেন না যে তারা গ্যাস লাইটিংয়ের শিকার হচ্ছেন। দীর্ঘ সময়ের মধ্যে ভিকটিম নিজেও বিশ্বাস করে নেয় যে, সত্যিই সে ভুল করছে। ফলে তারা একাকী হয়ে পড়ে, মানসিক অবসাদে আক্রান্ত হয়, এবং নিজের মূল্যবোধ হারায়।
গ্যাস লাইটিংয়ের প্রভাব
মানসিক অসুস্থতা, বিষণ্নতা ও উদ্বেগ
আত্মবিশ্বাস হারানো
কাজের প্রতি অনাগ্রহ ও মনোযোগের অভাব
শারীরিক অসুস্থতা
নিজের ওপর সন্দেহ ও পরনির্ভরশীলতা বৃদ্ধি
পারিবারিক ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা
প্রতিকার ও করণীয়
নিজেকে একা ফেলে দেবেন না, ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত রাখুন।
গ্যাস লাইটিং করার ব্যক্তিকে ইগনোর করতে শিখুন।
আপনার অনুভূতি ও সমস্যাগুলো কাউকে খুলে বলুন।
প্রতিদিনের ঘটনার একটি ডায়েরি রাখুন, যা আপনাকে পর্যালোচনা করতে সাহায্য করবে।
প্রয়োজন হলে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন।
নিজের ভাল গুণাবলীকে স্মরণ করুন এবং নিজেকে প্রমাণ করুন, আপনি ভুল নন।
গ্যাস লাইটারদের কাছ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করুন, তাদের কথায় অতিরিক্ত গুরুত্ব দেবেন না।
যদি সম্পর্ক ত্যাগ করা না যায়, তবে আপনার মানসিক শান্তির জন্য যাদের প্রয়োজন ধরে রাখুন।
গ্যাস লাইটিং করার লোকেরা সাধারণত মানসিকভাবে দুর্বল এবং তাদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণের তীব্র আকাঙ্ক্ষা থাকে। তারা অন্যজনকে মানসিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ভয়ংকর কৌশল ব্যবহার করে, যা এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক অপরাধই বলা যায়।
আপনি যদি মনে করেন, আপনি কিংবা আপনার পরিচিত কেউ এই মানসিক অত্যাচারের শিকার, তবে সহায়তা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। নিজের মূল্য বুঝুন, নিজের আত্মবিশ্বাস ধরে রাখুন এবং কখনোই এই মানসিক অত্যাচারের শিকার হয়ে নিজেকে হারাবেন না।
রাজু