
করোনা মহামারির অভিঘাতে বিশ্বজুড়ে কাজের ধরনে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছিল, তার প্রভাব এখনো অনুভূত হচ্ছে। হঠাৎ করেই অফিসের চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরের চার দেয়ালে আটকে পড়ে বিশ্বের কোটি কোটি কর্মজীবী মানুষ। সেই জরুরি প্রয়াস আজ যেন রূপ নিচ্ছে একটি নতুন কর্মসংস্কৃতির, যার নাম রিমোট ওয়ার্ক।
২০১৯ সালে যুক্তরাজ্যের মাত্র ৪.৭ শতাংশ কর্মী বাসা থেকে কাজ করতেন। কিন্তু করোনোত্তর বিশ্বে ২০২৩ সালের একটি সরকারি প্রতিবেদনে দেখা যায়, যুক্তরাজ্যের প্রায় ৪৪ শতাংশ কর্মী এখন পুরোপুরি বা আংশিকভাবে রিমোট বা হাইব্রিড পদ্ধতিতে কাজ করছেন।
কর্মজীবনের নতুন সমীকরণ: নমনীয়তাই এখন সবচেয়ে বড় চাওয়া
কর্মক্ষেত্রে স্বাধীনতা ও নমনীয়তা এখন সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত সুবিধা হয়ে উঠেছে। জরিপ বলছে, ৬৫ শতাংশ কর্মী সবসময় রিমোট ওয়ার্ক করতে আগ্রহী, আর ৩২ শতাংশ চান হাইব্রিড পদ্ধতি। এমনকি, বর্তমান চাকরিতে রিমোট বা হাইব্রিড সুবিধা না পেলে, ৫৭ শতাংশ কর্মী চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কথাও ভাবতে পারেন।
এই চাহিদা শুধু একটি সাময়িক প্রবণতা নয়; বরং এটি প্রমাণ করে, বিশ্বজুড়ে কর্মজীবী মানুষ এখন কাজের পদ্ধতি নিয়ে নতুন করে ভাবতে শিখেছেন।
উৎপাদনশীলতা নিয়ে সংশয়: দূর থেকে কাজ কি কমায় কাজের মান?
রিমোট ওয়ার্ক নিয়ে এক বড় প্রশ্ন উঠেছে উৎপাদনশীলতা নিয়ে। একদিকে, অফিসে যাওয়ার দীর্ঘ যাত্রা এড়িয়ে কর্মীরা বাড়িতে কাজ করে পাচ্ছেন বেশি মানসিক প্রশান্তি, যা কাজের প্রতি উৎসাহও বাড়িয়েছে। অন্যদিকে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৈশ্বিক সংকট মহামারি, অর্থনৈতিক অস্থিরতা, মুদ্রাস্ফীতি এই সবকিছু মিলিয়ে উৎপাদনশীলতায় প্রভাব ফেলেছে।
তবে, একে একান্তই রিমোট ওয়ার্কের দোষ হিসেবে দেখলে তা হবে সরলীকরণ। ৬৬ শতাংশ কর্মী জানিয়েছেন, আর্থিক দুশ্চিন্তা তাদের পেশাগত ও ব্যক্তিজীবনে প্রভাব ফেলছে। ফলে দেখা যাচ্ছে, অফিসের ভৌগোলিক অবস্থান নয়, বরং আরও গভীর কাঠামোগত চ্যালেঞ্জগুলিও উৎপাদনশীলতাকে প্রভাবিত করছে।
উদ্ভাবন কি কমে যাচ্ছে দূর থেকে?রিমোট ওয়ার্ক নিয়ে আরেকটি বড় উদ্বেগ এই ব্যবস্থায় কি সৃষ্টিশীলতা ও উদ্ভাবন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে?
টেক ইন্ডাস্ট্রির অনেক নেতা মনে করেন, সৃজনশীল চিন্তার জন্য মুখোমুখি মিটিং, তাৎক্ষণিক আলোচনা ও হঠাৎ মাথায় আসা ভাবনা ভাগাভাগি করার সুযোগ থাকা জরুরি। অ্যামাজনের সিইও অ্যান্ডি জ্যাসি যেমন বলেন, “আমরা যখন একসাথে থাকি, তখনই আমাদের সেরা কাজগুলো হয়।”
তবে সবাই একমত নন। সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান Atlassian-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যানি ডিন জানান, সৃজনশীলতা ‘কোথায় কাজ করা হচ্ছে’ তার চেয়ে বেশি নির্ভর করে ‘কীভাবে কাজ করা হচ্ছে’-এর উপর।
তার কথায়, প্রযুক্তিনির্ভর যুগে ভার্চুয়াল টিমও পারস্পরিক সহযোগিতায় সমানভাবে উদ্ভাবনী হয়ে উঠতে পারে শুধু দরকার নতুনভাবে চিন্তা করা এবং সঠিক প্রক্রিয়া গড়ে তোলা।
মানসিক স্বাস্থ্যের সংকট: নিঃসঙ্গতার ছায়া
রিমোট ওয়ার্কের সুবিধা যতই থাকুক, এটি মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর কিছু নেতিবাচক প্রভাবও ফেলতে পারে। যুক্তরাজ্যের একটি জরিপে ৮০ শতাংশ কর্মী বলেছেন, বাসা থেকে দীর্ঘদিন কাজ করার ফলে তারা একাকীত্ব ও বিচ্ছিন্নতা অনুভব করেন।
অফিসের সঙ্গীতময় পরিবেশ, সহকর্মীদের সঙ্গে আলাপচারিতা, ব্রেকটাইমের হাস্যরস এসব অনুপস্থিতির কারণে অনেকের জন্য রিমোট ওয়ার্ক মানে হয়ে দাঁড়াচ্ছে একাকীত্বের দীর্ঘ সময়।
উত্তরণের পথ কোথায়?
রিমোট ওয়ার্ক নিয়ে আলোচনা এখনো চলমান। একক কোনো সমাধান হয়তো নেই, তবে হাইব্রিড মডেল অনেকের কাছেই এখন বাস্তবসম্মত ও টেকসই মনে হচ্ছে।
সম্প্রতি এক জরিপে ৭০ শতাংশ এইচআর নেতৃবৃন্দ মত দেন যে, অফিসে ফেরার জন্য নেতৃত্বের জোরাজুরি প্রয়োজন নেই। কেউ কেউ বলেন, ৯-৫ অফিস মডেল এখন অচল ,বিশ্ব এখন চলছে ২৪/৭ ঘড়িতে, যেখানে বিভিন্ন টাইমজোন থেকে সারাক্ষণ বার্তা আসে।
The Briars Group-এর চিফ পিপল অফিসার আমান্ডা সাইমন পরামর্শ দেন, “নেতাদের উচিত কর্মীদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলা, এমন একটি কর্মপদ্ধতি গড়ে তোলা, যেখানে কর্মীরা নিজের মতো করে উপযুক্ত পরিবেশে কাজ করতে পারেন।”
ভবিষ্যতের পথচিত্র
রিমোট ও হাইব্রিড ওয়ার্ক এখন আর পরীক্ষামূলক নয়, বরং এটি ধীরে ধীরে হয়ে উঠছে কর্মসংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। নতুন বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য দরকার খোলামেলা আলোচনা, প্রযুক্তিনির্ভর সমাধান এবং কর্মীদের চাওয়া-পাওয়া বুঝে সেই অনুযায়ী কর্মপরিকল্পনা সাজানো।
পুরনো নিয়মে ফেরার চেষ্টা নয়, বরং নতুন বাস্তবতাকে আলিঙ্গন করাই ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যাওয়ার চাবিকাঠি। আর এই পথেই লুকিয়ে থাকতে পারে কর্মজীবনের আরও নমনীয়, সৃজনশীল ও সুস্থ ভবিষ্যৎ।
সূত্র:https://tinyurl.com/2vt3dksa
আফরোজা