
ছবি: সংগৃহীত
গবেষণা বলছে, বাগান করার মাধ্যমে মানসিক দক্ষতা সংরক্ষণ করা সম্ভব, যা দীর্ঘ ও সুস্থ জীবনযাপনকে সহায়তা করে। এখন ‘কেয়ার ফার্ম’-এর প্রেসক্রিপশনের মাধ্যমে ডিমেনশিয়া রোগীরাও পাচ্ছেন এর সুফল।
নরওয়ের অবসরপ্রাপ্ত দাদি মারিয়ানে রোগস্তাদ আজীবন শেখার আগ্রহী একজন মানুষ। তিনি সুইজারল্যান্ডে পাঁচ দশক ধরে হোটেলের কর্মী হিসেবে কাজ করেছেন, যেখানে প্রতিদিন তিনি নতুন ভাষা ও সংস্কৃতিতে ডুবে থাকতেন।
কিন্তু নরওয়েতে ফিরে আসার পর তিনি ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হন। এর ফলে তিনি একাকী হয়ে পড়েন এবং তার উদ্দীপনার উৎসগুলো হারিয়ে ফেলেন। এরপরই তিনি ওসলো শহরের বাইরে অবস্থিত একটি ছোট ‘কেয়ার ফার্ম’ ইমপালসসেন্টারে যোগ দেন। হেনরিয়েটে ব্রিংসইয়র্ড বলেন, এই ‘ফার্ম’ মানুষের কাজের ও যোগাযোগের স্বাভাবিক আকাঙ্ক্ষা মেটাতে তৈরি করা হয়েছে।
"আমার মা–বাবা কৃষিকাজ খুব ভালোবাসতেন। তারা ভাবতেন, ডিমেনশিয়া আক্রান্ত মানুষের জন্য কাজ থামিয়ে দেওয়া এবং সামাজিক জীবন হারানো কতটা কষ্টের। তাই তারা এমন কিছু করতে চেয়েছিলেন যাতে এই মানুষগুলো আবার জীবনের অংশ হতে পারেন," বলেন ব্রিংসইয়র্ড, যিনি এখন ফার্মটি সহ-পরিচালনা করেন।
২০১৫ সালে, নরওয়ে প্রথম দেশগুলোর একটি হিসেবে একটি জাতীয় ডিমেনশিয়া কেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করে, যার অংশ হিসেবে ‘ইন পা তুনেট’ বা ‘ইয়ার্ডে প্রবেশ’ নামক কেয়ার ফার্ম সুবিধা চালু করা হয়। এখন, গবেষকেরা দেখছেন কৃষিকাজ মস্তিষ্কের জন্য কতটা উপকারী—এবং সেই অনুযায়ী আরও অনেক জায়গায় চিকিৎসার অংশ হিসেবে প্রকৃতিতে সময় কাটানোর বা ‘গ্রিন প্রেসক্রিপশন’ চালু হচ্ছে।
"প্রকৃতি নির্ভর প্রেসক্রিপশন শারীরিক কার্যকলাপ ও সামাজিক সংযোগ বাড়াতে পারে এবং চাপ কমাতে সাহায্য করে। এর ফলে রক্তচাপ, রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণ এবং ওজন বজায় রাখতে সহায়তা হয়—যা ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি কমায়," বলেন কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ও চিকিৎসক মেলিসা লেম।
নতুন তথ্য দেখাচ্ছে, বাগান করার মাধ্যমে মানসিক বিকাশ সম্ভব। এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা এক অনন্য গবেষণায় ১১ এবং ৭৯ বছর বয়সে অংশগ্রহণকারীদের বুদ্ধিমত্তার তুলনা করেন। দেখা গেছে, যারা নিয়মিত বাগান করতেন, তাদের মানসিক উন্নয়ন ছিল উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি।
গবেষণার প্রধান গবেষক জেনি করলি বলেন, “গাছপালা নিয়ে শেখা, বাগান পরিষ্কার রাখা—এসব মানসিকভাবে জটিল কাজ, যা মেমোরি ও এক্সিকিউটিভ ফাংশনকে সক্রিয় রাখে।”
তিনি আরও বলেন, "ইউজ ইট অর লুজ ইট" বা "ব্যবহার না করলে হারিয়ে যাবে" তত্ত্ব অনুসারে, যদি আমরা নিয়মিত কোনো মানসিক কাজ না করি, তবে আমাদের মস্তিষ্কের সংশ্লিষ্ট অংশগুলোর কার্যক্ষমতা কমে যায়। তবে সৃজনশীলতা, শেখা ও সমস্যা সমাধানের মতো কাজ নিয়মিত করলে মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকে।
২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ৮০০ জন সন্ন্যাসিনীর ওপর করা এক গবেষণায় দেখা যায়, যারা নিয়মিত মানসিক কাজ করতেন, তাদের অ্যালঝেইমার রোগের ঝুঁকি ছিল অনেক কম। জাপানে করা এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, অর্থবহ কাজে অংশগ্রহণ স্মৃতিশক্তি রক্ষায় সহায়তা করে। এমনকি সামাজিকভাবে পরিচালিত মানসিক উদ্দীপনামূলক কার্যক্রমে অংশ নিলে মন-মেজাজ, যোগাযোগ এবং সামাজিক মেলামেশা উন্নত হয়।
বাগান করার নির্দিষ্ট কিছু মানসিক সুফল রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, গবেষণায় দেখা গেছে বাগান করলে ব্রেইন-ডেরাইভড নিউরোট্রফিক ফ্যাক্টর (BDNF) এবং ভাসকুলার এন্ডোথেলিয়াল গ্রোথ ফ্যাক্টর (VEGF) বাড়ে—যা নিউরনের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে এবং মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বাড়ায়।
অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০৬ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা প্রতিদিন বাগান করতেন, তাদের ডিমেনশিয়া হওয়ার ঝুঁকি ৩৬% কম।
রজার উলরিচ, সুইডেনের চালমারস বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন আর্কিটেকচার অধ্যাপক, তার গবেষণায় দেখিয়েছেন, শুধু প্রকৃতির দিকে তাকালেও চাপ কমে, মন ভালো থাকে এবং মনোযোগ বাড়ে। তিনি বলেন, এই প্রবণতা আমাদের বিবর্তনের ফল।
মেলিসা লেম বলেন, প্রকৃতির প্রতি আমাদের টান এবং এর স্বাস্থ্য উপকারিতা আমাদের বিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এমনকি প্রকৃতির ছবি দেখা, শব্দ শোনা বা গন্ধ শোঁকার মাধ্যমেও স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়। কানাডায় একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি প্রকৃতি প্রেসক্রিপশনের পাইলট প্রকল্প চালিয়েছেন।
‘অ্যাটেনশন রিস্টোরেশন থিওরি’ অনুসারে, প্রকৃতি আমাদের মনোযোগ পুনরুদ্ধারে সহায়তা করে, যা শহরের ব্যস্ত জীবনে হ্রাস পায়।
লেম আরও বলেন, বাগান করার মাধ্যমে শারীরিক দক্ষতাও বাড়ে—যেমন হাতের কাজের দক্ষতা, পেশিশক্তি, ফুসফুসের সক্ষমতা ও চলাফেরার স্বাধীনতা। যুক্তরাষ্ট্রে করা দুটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা প্রতি সপ্তাহে এক ঘণ্টার বেশি সময় বাগানে কাজ করেন, তাদের হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি ৬৬% কম, এবং হাড়ের ঘনত্ব বেশি হয়।
ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য বাগান করা আরও বেশি উপকারী। এটি তাদের মেজাজ, আচরণ, যোগাযোগ এবং দৈনন্দিন কাজের দক্ষতা বাড়ায়। বর্তমানে ইউরোপ ও যুক্তরাজ্যে ডিমেনশিয়া রোগীদের জন্য কেয়ার ফার্ম গড়ে উঠছে।
ব্রিংসইয়র্ড বলেন, কেয়ার ফার্মে বাগান করা মানুষকে নিজের কাজের ফল দেখার সুযোগ দেয়, যা স্বাধীনতা ও আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। “অনেকেই কাজের প্রক্রিয়া ভুলে যান, কিন্তু যখন অন্যদের দেখেন, তখন স্মৃতি ফিরে আসে,” তিনি বলেন।
রোগস্তাদ এখন সপ্তাহে তিন দিন কেয়ার ফার্মে কাজ করেন—সবজি চাষ, গরুকে খাওয়ানো ও মুরগির যত্ন নেওয়ার মতো কাজে ব্যস্ত থাকেন। তিনি বলেন, “প্রকৃতির মাঝে সময় কাটানো দারুণ। বাসায় বসে থাকার চেয়ে এটা অনেক ভালো।”
শহীদ