ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৭ মে ২০২৫, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

স্টার্ট-আপ আইডিয়া থেকে বাস্তবে, ঝুঁকির বাজারে সাফল্যের স্পর্শ পেতে করণীয়

প্রকাশিত: ১৯:৩৩, ১৭ মে ২০২৫; আপডেট: ১৯:৩৭, ১৭ মে ২০২৫

স্টার্ট-আপ আইডিয়া থেকে বাস্তবে, ঝুঁকির বাজারে সাফল্যের স্পর্শ পেতে করণীয়

ছবি: ব্লোফিক্স.কম


যতই দিন যাচ্ছে, বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের এই অগ্রগতিতে স্টার্টআপ এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। পশ্চিমা অর্থনৈতিক সংস্কৃতি থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে আগত এই স্টার্টআপ কনসেপ্টটি আমাদের দেশের অর্থনীতি ও শিল্পখাতেও এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় ও আলোচিত একটি শব্দ। ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে যারা যুক্ত, তাদের কাছে স্টার্টআপ শব্দটি খুবই পরিচিত ও স্বাভাবিক। উদ্যোক্তাদের কাছে শব্দটির পরিচিতি থাকলেও বাংলাদেশের বহু সাধারণ মানুষ এখনও এই শব্দটির সাথে অপরিচিত। আমার আজকের এই প্রবন্ধটি স্টার্টআপের ধারনা থেকে শুরু করে, সফলভাবে একটি স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ ধাপগুলো নিয়ে রচিত।

স্টার্টআপ কি? 
স্টার্টআপ হলো এমন এক ধরনের ব্যবসায়িক উদ্যোগ, যা এক বা একাধিক উদ্ভাবনী পণ্য বা সেবা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বাজারে প্রবেশ করে। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই এর লক্ষ্য থাকে দ্রুতগতিতে সফলতার শীর্ষে পৌঁছানো। স্টার্টআপ খুবই ছোটো আকারে শুরু হয়, এবং ঝুঁকি নিয়ে হলেও সফলতার শীর্ষে পৌঁছানোর আশায় ব্যবসা পরিচালনা করে। প্রযুক্তিনির্ভরতা ও উদ্ভাবনই স্টার্টআপের মূল বৈশিষ্ট্য। ১৯৯০ পরবর্তী সময়ে এটি পশ্চিমা দেশগুলোতে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে সফল স্টার্টআপের উদাহরণ হিসেবে গুগল, ফেসবুক, ইউটিউব, উবার, এয়ারবিএনবি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশেও বিকাশ, পাঠাও, টেন মিনিট স্কুল, সহজ, চালডাল প্রভৃতি স্টার্টআপ দেশীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে।

একটি সফল স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠার উপায়
স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠা করা ও স্টার্টআপে সফলতা অর্জন করার মধ্যে রয়েছে বড় ফারাক। যেকোনো উদ্ভাবনী স্টার্টআপ আইডিয়া নিয়ে, খুব সহজে আমরা একটি স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠা করতে পারলেও, ঐ স্টার্টআপে সফলতা পাওয়া মোটেই সহজ কথা নয়। যেমনটি প্রবাদে শোনা যায়, "স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন"। এই কথাটি স্টার্টআপের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠা করার চেয়ে স্টার্টআপে সফলতা অর্জন করা অনেক বেশি কঠিন। সফল স্টার্টআপগুলো যেভাবে আমাদের অর্থনীতির চাকাকে শক্তিশালী করতে পারে, একইভাবে একেকটি ব্যর্থ স্টার্টআপ বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তাই স্টার্টআপকে সফল করার জন্যে প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই কিছু নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করা জরুরি। বিশ্বের একটি বৃহৎ স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের আলোকে আজকে আমি স্টার্টআপের সফলতার পেছনে থাকা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ নিয়ে আলোচনা করবো।

১. মার্কেট রিসার্চ ও আইডিয়া যাচাই-বাছাই 
বাংলাদেশের বাজার (মার্কেটপ্লেস) পশ্চিমা বাজার থেকে অনেকটাই আলাদা। তাই এই দেশে কোনো স্টার্টআপ সফলভাবে পরিচালনা করার জন্য গভীরভাবে এই বাজার নিয়ে গবেষণা করা জরুরি। মার্কেট রিসার্চের মাধ্যমে এই মার্কেটের চাহিদা ও সমস্যাগুলো সহজেই নির্ধারন করা যাবে। এই চাহিদা ও সমস্যাগুলোর কথা মাথায় রেখে স্টার্টআপ আইডিয়া যাচাই-বাছাই করাও অনেক সহজ হবে। মার্কেট রিসার্চের আরও একটি বড় সুবিধা হলো, এর মাধ্যমে প্রতিযোগীদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়, যা সিদ্ধান্ত নিতে এবং প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সহায়ক হয়। শুধুমাত্র স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠার সময়েই নয়, স্টার্টআপটি পরিচালনার সময়েও নিয়মিত মার্কেট রিসার্চ করে নতুন নতুন সিদ্ধান্ত নেয়া সফলতার ক্ষেত্রে খুবই জরুরি। 

২. দক্ষ কোর টিম তৈরি করা
একটি শক্তিশালী ও দক্ষ কোর টিম হলো যেকোনো স্টার্টআপের মেরুদণ্ড। ফাইনান্স, মার্কেটিং, টেকনোলজি সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষতাসম্পন্ন সদস্যদের একত্র করে গঠন করা টিমকেই কোর টিম হিসেবে ধরে নেয়া হয়েছে, যারা স্টার্টআপটি সফলভাবে প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করবে। এই কোর টিমের সদস্যরা যত বেশি দক্ষ হবে, স্টার্টআপের সফলতার সম্ভাবনা ততই বেশি থাকবে। যেকোনো পরিবর্তনের সাথে দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে একটি শক্তিশালী কোর টিম এর বিকল্প নেই।

৩. ফান্ড সংগ্রহ করা
স্টার্টআপ পরিচালনা, কার্যক্রম বৃদ্ধি করা, বাজার সম্প্রসারণ করা ও পণ্য বা সেবা তৈরি করার ক্ষেত্রে অর্থ বা পুঁজি অপরিহার্য। স্টার্টআপের জন্য ফান্ড বা অর্থ সংগ্রহের অনেক উপায় রয়েছে। এর মধ্যে ক্রাউডফান্ডিং, ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ও অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টরদের মাধ্যমে ফান্ড সংগ্রহ করা সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সহজ উপায়। ইনভেস্টর বা বিনিয়োগকারী শুধুমাত্র আর্থিক সাহায্যই দেয়না, এর পাশাপাশি তারা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ ও নেটওয়ার্কিং সুবিধাও প্রদান করে, যা সফলতার ক্ষেত্রে অনেক বড় ভূমিকা রাখে।

৪. উদ্ভাবনী পণ্য বা সেবা তৈরি করা
বাংলাদেশের বাজারে টিকে থাকার জন্য একটি স্টার্টআপকে অবশ্যই নতুনত্ব আনতে হবে। একঘেয়ে সেবা বা পণ্যের বদলে এমন কিছু দিতে হবে যা ভোক্তাদের জন্য বাস্তব সমস্যার সমাধান করে। উদ্ভাবনী পণ্য বা সেবা হলো একটি স্টার্টআপের মূল বৈশিষ্ট্য। পাশাপাশি এদেশের মানুষের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো এরা পরিবর্তন পছন্দ করে। দ্রুত প্রোটোটাইপ তৈরির মাধ্যমে গ্রাহকের মতামত সংগ্রহ করে, বারবার উন্নয়ন করলে পণ্যের মান বাড়বে এবং ব্র্যান্ডের প্রতি এদেশের মানুষের আস্থা গড়ে উঠবে। ভোক্তাদের আস্থা সৃষ্টি হলে যেকোনো স্টার্টআপ এদেশে সফল হবেই।


৫. কার্যকর বিজনেস মডেল তৈরী করা
একটি টেকসই বিজনেস মডেল স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করে দেয়, কীভাবে স্টার্টআপটি তার আয়ের পথ সৃষ্টি করবে, অতিরিক্ত খরচ নিয়ন্ত্রণ করবে এবং গ্রাহকদের সঠিক সেবা প্রদান করবে। এতে মূলত পন্য বা সেবার মূল্য নির্ধারণ কৌশল, আয়ের উৎস এবং ব্যয় কাঠামো অন্তর্ভুক্ত থাকে। একটি সুসংগঠিত বিজনেস মডেল বিনিয়োগকারীদেরও আস্থা অর্জন করে এবং ব্যবসার সম্প্রসারণকে সহজ করে। একটি কার্যকর বিজনেস মডেলের উপর ভিত্তি করে ব্যবসা পরিচালনা করলে স্টার্টআপের সফলতার পথ অনেক সহজ হয়ে যায়।


বাংলাদেশের অনেক নতুন ও পুরাতন স্টার্টআপের উপর গবেষণা করে দেখা গেছে, তাদের মধ্যে অনেক স্টার্টআপই উপরে বর্ণিত এই গুরুত্বপূর্ণ ধাপগুলো অনুসরণ করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করে না। এদেশের অনেক স্টার্টআপই একজন আইনজীবী বা বিজনেস কনসালটেন্টের মাধ্যমে নিবন্ধন প্রক্রিয়া শেষ করে অন্যান্য সাধারণ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মতোই পরিচালিত হয়, যাদের কোনো কার্যকর বিজনেস মডেল, দক্ষ কোর টিম ও উদ্ভাবনী পণ্য থাকে না। এর ফলে বাংলাদেশে প্রতিনিয়তই স্টার্টআপে ব্যর্থতার দৃশ্য দেখা যায়, যা এদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। এদেশে প্রতিষ্ঠিত বেশিরভাগ স্টার্টআপই বড় ফান্ড সংগ্রহে ব্যর্থ হয়, যার ফলে প্রতিষ্ঠার কয়েক বছরের মাথায় সেই স্টার্টআপ হারিয়ে যায়। এটা শুধু ভুল জায়গায় অর্থের অপচয়ই নয়, উদ্যোক্তাদের জন্য এক ধরনের মানসিক চাপও বটে। এর ফলে উদ্যোক্তাদের নিজেদের উপর আস্থা বা আত্মবিশ্বাস বিনষ্ট হয় এবং ধীরে ধীরে এর প্রভাব দেশের অর্থনীতিতে পড়ে। তাই বাংলাদেশে যেকোনো স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠা করার পূর্বে এদেশের বাজার ও ভোক্তাদের সম্পর্কে পর্যাপ্ত গবেষণা করা এবং স্টার্টআপ পরিচালনা সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান অর্জন করা আবশ্যক।


ছবি ও লিখা: মলয় দাস, প্রতিষ্ঠাতা, ব্লোফিক্স.কম

সাব্বির

×