
ছবি: সংগৃহীত।
ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে সংঘাতের ইতিহাস বহু পুরনো। এই উত্তপ্ত পরিস্থিতির কেন্দ্রে থেকেছে গোটা আরব বিশ্ব। ইতিহাসে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ হয়েছে মোট তিনবার। এর মধ্যে সবচেয়ে স্মরণীয় হয়ে আছে ১৯৬৭ সালের তৃতীয় আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ, যেটি ছয় দিনের মধ্যে শেষ হলেও রেখে যায় বহু রক্তাক্ত স্মৃতি এবং এক অকুতোভয় বাংলাদেশির নাম—সাইফুল আজম।
১৯৬৭ সালের জুনে, পাকিস্তান বিমান বাহিনীর কর্মকর্তা স্কোয়াড্রন লিডার সাইফুল আজমকে যুদ্ধকালীন সহযোগিতার জন্য পাঠানো হয় ইরাকি বিমান বাহিনীতে। তখন ইসরায়েল একে একে গাজা, সিনাই, পশ্চিম তীর, জেরুজালেম এবং সিরিয়ার গোলান মালভূমি দখল করে নিচ্ছে। যুদ্ধের প্রথম পাঁচ দিনেই সিরিয়ার দুই-তৃতীয়াংশ বিমান ধ্বংস হয়ে যায়।
এই সময় জর্ডানের মাফরাক বিমান ঘাঁটিতে হামলার উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসে চারটি ইসরায়েলি সুপারসনিক যুদ্ধবিমান। তখন আরবদের হাতে তেমন আধুনিক যুদ্ধবিমান ছিল না। কিন্তু বুকভরা সাহস নিয়ে হকার হান্টার জেট নিয়ে আকাশে ওড়েন সাইফুল আজম।
সাইফুল আজম একাই গুলি করে ভূপাতিত করেন দুটি ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান। পরদিন ইরাকের আকাশসীমায় আরও একটি ইসরায়েলি জেট ভূপাতিত করেন তিনি। মাত্র ৭২ ঘণ্টায় তিনটি যুদ্ধবিমান ধ্বংস করে তিনি গড়ে তোলেন এক অনন্য বিশ্বরেকর্ড—এককভাবে সবচেয়ে বেশি ইসরায়েলি বিমান ভূপাতিত করা বৈমানিক।
তার এই অনন্য সাহসিকতার জন্য জর্ডান সরকার তাকে "হুসাম ইস্তিকলাল" সম্মাননায় ভূষিত করে। এরপর ইরাকের আল ওয়ালিদ বিমানঘাঁটি রক্ষার দায়িত্বও দেওয়া হয় তাকে। সেখানে ইসরায়েলি এক ক্যাপ্টেন গিদিওন আত্মসমর্পণ করেন তার কাছে, যিনি পরবর্তীতে বন্দি বিনিময়ের মাধ্যমে হাজারের বেশি আরব সৈন্যকে মুক্ত করার পথ খুলে দেন।
সাইফুল আজম পৃথিবীর একমাত্র পাইলট যিনি পাকিস্তান, জর্ডান, ইরাক এবং স্বাধীন বাংলাদেশের বিমান বাহিনীতে দায়িত্ব পালন করেছেন। আরও বিস্ময়ের বিষয়, তিনি চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ আটটি দেশের বিভিন্ন বিমান ও প্রযুক্তি পরিচালনায় দক্ষ ছিলেন। বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান ছিলেন তারই প্রশিক্ষণার্থী।
এই অনন্য কৃতিত্বের স্বীকৃতি হিসেবে ২০০১ সালে মার্কিন বিমান বাহিনী তাকে ‘লিভিং ঈগল’ খেতাবে ভূষিত করে—যা কেবল যুদ্ধক্ষেত্রে অতুলনীয় অবদানের জন্য দেওয়া হয়।
সাইফুল আজম শুধু একজন যুদ্ধবিমান চালক ছিলেন না, ছিলেন এক কিংবদন্তি। তিনি পাবনা-৩ আসনের সংসদ সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ২০২০ সালের জুনে, ৮০ বছর বয়সে কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে এই আকাশবীর ইন্তেকাল করেন।
আজও ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বিশ্লেষণে সাইফুল আজমের নাম উচ্চারিত হয় এক ভয়ংকর প্রতিপক্ষ হিসেবে। তিনি ছিলেন এক বাংলাদেশি, যার সাহসিকতা প্রমাণ করে দেয়—একজন মানুষের শক্তিই কখনো কখনো একটি জাতির মর্যাদা হয়ে দাঁড়ায়।
নুসরাত