ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২০ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২

ইরান-ইসরায়েল সরাসরি সংঘাত: মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের ছায়া ও বৈশ্বিক বিপর্যয়

মো. আতিকুর রহমান, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, ঢাকা

প্রকাশিত: ২১:১৮, ১৯ জুন ২০২৫

ইরান-ইসরায়েল সরাসরি সংঘাত: মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের ছায়া ও বৈশ্বিক বিপর্যয়

ছবি: সংগৃহীত

দীর্ঘদিনের ‘ছায়া যুদ্ধ’ পেরিয়ে সরাসরি সামরিক সংঘাতে জড়িয়েছে ইরান ও ইসরায়েল। ২০২৫ সালের ১৩ জুন ইসরায়েলের আকস্মিক হামলার জবাবে ইরানের পাল্টা প্রতিক্রিয়া মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়ে দিয়েছে। এই সংঘাত কেবল আঞ্চলিক নিরাপত্তা নয়, বরং বৈশ্বিক রাজনীতি ও অর্থনীতিতেও গুরুতর প্রভাব ফেলছে।

সংঘাতের পেছনের প্রেক্ষাপট:
১৯৭৯ সালের ইরানি বিপ্লবের আগে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে উষ্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল। তবে খোমেনির ইসলামি বিপ্লবের পর নতুন শাসকগোষ্ঠী ইসরায়েলকে ‘প্রধান শত্রু’ হিসেবে ঘোষণা দেয় এবং তাকে ‘মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার’ ডাক দেয়। এই আদর্শগত বৈরিতা ভবিষ্যতের সংঘাতের ভিত্তি তৈরি করে। পরবর্তী সময়ে ইরান গড়ে তোলে ‘প্রতিরোধ অক্ষ’—যার মধ্যে লেবাননের হিজবুল্লাহ, গাজার হামাস, ইয়েমেনের হুথি ও ইরাকের শিয়া মিলিশিয়ারা রয়েছে। এরা ইরানের সামরিক ও আর্থিক সহায়তায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াই করে, ফলে ইরান সরাসরি যুদ্ধ এড়িয়ে থেকেছে দীর্ঘদিন।

অন্যদিকে, ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে তার অস্তিত্বের জন্য সরাসরি হুমকি বলে বিবেচনা করে। আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (IAEA) ইঙ্গিত দিয়েছে, ইরান বর্তমানে একাধিক পারমাণবিক বোমা তৈরির মতো ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণে সক্ষম। ইসরায়েলের ভাষ্য, ইরান এই ‘ব্রেকআউট উইন্ডো’র একেবারে প্রান্তে রয়েছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের ইসরায়েল হামলার মাধ্যমে গাজা যুদ্ধের সূচনা হলে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে পড়ে। এতে ইরানের প্রধান প্রক্সি শক্তিগুলো দুর্বল হয়ে পড়ায় ইসরায়েল ইরানের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযান চালাতে উৎসাহিত হয়।

সরাসরি সামরিক অভিযান ও কৌশল:
২০২৫ সালের জুন থেকে উভয় দেশই একে অপরের ভূখণ্ডে সরাসরি সামরিক হামলা শুরু করে। ইসরায়েলের লক্ষ্য হলো—ইরানের পারমাণবিক অবকাঠামো ধ্বংস, প্রক্সি নেটওয়ার্ক ভেঙে ফেলা এবং শীর্ষস্থানীয় পারমাণবিক বিজ্ঞানী ও সামরিক নেতাদের হত্যা করা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ও চোরাচালানকৃত ড্রোন ব্যবহারে ইসরায়েল তেহরানের আকাশে “বিমান শ্রেষ্ঠত্ব” দাবি করছে। তাদের হামলায় নাতাঞ্জ, ইসফাহান ও ফোরডো পারমাণবিক কেন্দ্র ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উল্টোদিকে, ইরান চালাচ্ছে প্রতিশোধমূলক হামলা। লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে—তেল আবিব, হাইফার মতো বাণিজ্যিক শহর, সামরিক ঘাঁটি, গোয়েন্দা কেন্দ্র ও মোসাদের অপারেশনাল প্ল্যানিং ইউনিট। ইরান হুঁশিয়ারি দিয়েছে—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা ফ্রান্স যদি ইসরায়েলকে সহায়তা করে, তবে তাদের মধ্যপ্রাচ্যস্থিত সামরিক ঘাঁটি ও নৌবহরও আঘাতের মুখে পড়বে। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস অ্যাক্টিভিস্টস জানাচ্ছে, ইসরায়েলি হামলায় ইরানে এ পর্যন্ত ৬৩৯ জন নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ২৬৩ জন বেসামরিক এবং ১৫৪ জন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য। অপরদিকে, ইরানি হামলায় ইসরায়েলে ২৪ জন নিহত এবং প্রায় ৪০০-৬০০ জন আহত হয়েছেন।

আঞ্চলিক উত্তেজনা ও বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া:
এই সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি ও নিরাপত্তা কাঠামোতে বিরাট প্রভাব ফেলেছে। ইরানের প্রক্সি নেটওয়ার্ক (হামাস, হিজবুল্লাহ) দুর্বল হয়ে গেছে। উপসাগরীয় দেশগুলো—যেমন সৌদি আরব, কাতার, ইউএই, বাহরাইন—উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং ইসরায়েলি হামলাকে তাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখছে। হরমুজ প্রণালি বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা তৈল বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। অর্থনৈতিকভাবে, ব্রেন্ট ক্রুডের দাম বেড়ে ব্যারেলপ্রতি ৭৪.৬০ ডলার এবং WTI-র দাম ৭৩ ডলার ছাড়িয়েছে। এতে মুদ্রাস্ফীতির আশঙ্কা বাড়ছে, স্টক মার্কেট পতনের মুখে, এবং বিনিয়োগকারীরা সোনা ও ডলারের মতো নিরাপদ সম্পদে ঝুঁকছে। কূটনৈতিক মঞ্চেও উত্তেজনা চরমে। যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারকে সমর্থন করছে এবং ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র গুলি করে নামাতে সহায়তা করেছে, যদিও তারা বৃহত্তর যুদ্ধ এড়াতে চায়। ট্রাম্প প্রশাসন ইরানকে “নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের” আহ্বান জানিয়েছে এবং সতর্ক করেছে—মার্কিন স্বার্থে হামলা বরদাস্ত করা হবে না। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ জরুরি বৈঠক ডেকেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সংযমের আহ্বান জানাচ্ছে এবং পারমাণবিক ইস্যুতে কূটনৈতিক সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়া মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছে এবং ইসরায়েলি হামলার নিন্দা করেছে । চীনও ইসরায়েলের 'ঝুঁকিপূর্ণ সামরিক পদক্ষেপের' নিন্দা করেছে এবং গঠনমূলক ভূমিকা পালনের প্রস্তাব দিয়েছে। তবে উভয় পক্ষের অনমনীয় অবস্থানের কারণে এখন পর্যন্ত কোনো সমাধান দেখা যাচ্ছে না।

ভবিষ্যতের ঝুঁকি ও প্রভাব:
বিশ্লেষকরা এই পরিস্থিতিকে “নিয়ন্ত্রিত সংঘাত” হিসেবে দেখছেন—যেখানে ইরান ও ইসরায়েল সরাসরি লড়লেও যুক্তরাষ্ট্রসহ বৃহৎ শক্তি সরাসরি সম্পৃক্ত হচ্ছে না। তবে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি আক্রান্ত হলে, কিংবা জ্বালানি সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হলে, এই সংঘাত সহজেই একটি বৃহৎ আঞ্চলিক যুদ্ধে রূপ নিতে পারে।

কূটনৈতিক সমাধান বর্তমানে কঠিন, কারণ ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচি ও প্রতিরোধ অক্ষকে আত্মরক্ষার অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করে। অপরদিকে, ইসরায়েল এই বিষয়গুলোকেই অস্তিত্ব সংকট হিসেবে দেখে।

উপসংহার:
ইরান-ইসরায়েল সরাসরি সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক মানচিত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আনছে। এই যুদ্ধ শুধু দুই দেশের মধ্যকার বিরোধ নয়—এটি বৈশ্বিক শক্তি ভারসাম্য, জ্বালানি নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতির জন্য এক নতুন ও চ্যালেঞ্জিং সময়ের সূচনা করছে।

Mily

×