ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০১ জুন ২০২৫, ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

প্রজেক্ট এসথার

জানা গেলো ফিলিস্তিন সংহতি আন্দোলন ধ্বংস করতে ট্রাম্প প্রশাসনের গোপন নীলনকশা!

প্রকাশিত: ১৩:১৩, ৩১ মে ২০২৫; আপডেট: ১৩:১৪, ৩১ মে ২০২৫

জানা গেলো ফিলিস্তিন সংহতি আন্দোলন ধ্বংস করতে ট্রাম্প প্রশাসনের গোপন নীলনকশা!

যুক্তরাষ্ট্রের এক প্রভাবশালী ডানপন্থী থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ‘দ্য হেরিটেজ ফাউন্ডেশন’ গত বছর একটি নীতিনির্ধারণী দলিল প্রকাশ করে, যার উদ্দেশ্য ছিল ফিলিস্তিন সংহতি আন্দোলনকে ধ্বংস করা। এই দলিলটি প্রকাশের পর প্রথমে খুব বেশি আলোচনায় না এলেও, আট মাস পর ‘প্রজেক্ট এসথার’ নামে পরিচিত এই নথিপত্র নতুন করে তীব্র নজরে এসেছে।

কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার প্রশাসনের কর্মকৌশলের সঙ্গে এর সুস্পষ্ট মিল পাওয়া যাচ্ছে বলে দাবি করছেন অধিকারকর্মী ও পর্যবেক্ষকরা।

প্রজেক্ট এসথার-এর রচয়িতারা একে ‘ইহুদিবিদ্বেষ প্রতিরোধের রূপরেখা’ হিসেবে উপস্থাপন করলেও সমালোচকরা বলছেন, প্রকৃতপক্ষে এর লক্ষ্য হলো ইসরায়েলের সমালোচকদের ‘হামাস-সংশ্লিষ্ট’ হিসেবে তুলে ধরে তাদের কার্যকলাপকে অপমান ও দুর্বল করা।

এই প্রকল্পটি মূলত গাজার বিরুদ্ধে ইসরায়েলি আগ্রাসনের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের বিরোধিতায় ক্রমবর্ধমান প্রতিবাদের প্রেক্ষাপটে তৈরি করা হয়। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো একে গণহত্যা হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।

প্রজেক্ট এসথার কী এবং এটি কীভাবে কার্যকর হচ্ছে?

প্রজেক্ট এসথার ২৪ মাসের মধ্যে তথাকথিত ‘হামাস সাপোর্ট নেটওয়ার্ক’ ধ্বংস করার লক্ষ্যে গৃহীত হয়। এই নেটওয়ার্ককে তারা এমন একটি সংগঠন হিসেবে চিত্রায়িত করেছে, যা ‘যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যবোধ ও জাতীয় নিরাপত্তার পরিপন্থীভাবে হামাসের উদ্দেশ্যকে সমর্থন করে’।

তবে বাস্তবতা হলো, যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের কোনো নেটওয়ার্কের অস্তিত্ব নেই। দেশটির সন্ত্রাসবিরোধী কঠোর আইন অনুযায়ী, হামাসের মতো সংগঠনকে সমর্থন বা আর্থিক সহায়তা দেওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তবুও, প্রজেক্ট এসথারে ফিলিস্তিনপন্থী বিভিন্ন শিক্ষাগত, সামাজিক এবং মানবাধিকার সংগঠনকে এমন সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কের অংশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

হেরিটেজ ফাউন্ডেশন ও প্রজেক্ট এসথার সম্পর্কিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক হেরিটেজ ফাউন্ডেশন ‘স্বাধীনতা, সীমিত সরকার ও শক্তিশালী জাতীয় প্রতিরক্ষা’-র আদর্শে নীতিমালা প্রণয়ন করে থাকে। এই সংস্থার ভাইস প্রেসিডেন্ট ভিক্টোরিয়া কোটস এই প্রকল্প তদারক করছেন, যিনি ট্রাম্পের প্রথম দফার শাসনামলে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

এই ফাউন্ডেশনই ‘প্রজেক্ট ২০২৫’ নামে আরও একটি বিতর্কিত পরিকল্পনার নেপথ্যে রয়েছে, যা ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে কার্যকর করার পরিকল্পনা বলেই ধারণা করা হয়।

 

প্রজেক্ট এসথারে ১৯টি উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে-

ফিলিস্তিনপন্থী বিদেশি শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশাধিকার রুদ্ধ করা,সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে 'ইহুদিবিদ্বেষী' কনটেন্ট বন্ধ করা,‘অপরাধমূলক কার্যকলাপের’ প্রমাণ হোয়াইট হাউসকে সরবরাহ করা,ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভের অনুমতি না দেওয়া,এবং প্রো-প্যালেস্টাইন সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে ‘আইনি গবেষণা’র মাধ্যমে তাদের বদনাম করা।এই প্রকল্পে এমনকি বলা হয়েছে, “আমরা আইনের অস্ত্র ব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে দমন করব।”

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেন প্রধান টার্গেট?

আল-শাবাকা থিঙ্ক ট্যাঙ্কের ফেলো তারিক কেনি-শাওয়া ব্যাখ্যা করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ইসরায়েলবিরোধী মনোভাব ক্রমেই বাড়ছে। বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এই বিরোধিতা স্পষ্ট। পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক জরিপ বলছে, ৫০ বছরের নিচের ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে ৭১ শতাংশ ইসরায়েলবিরোধী মনোভাব পোষণ করে।

এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কেন্দ্র করে ‘প্রজেক্ট এসথার’ ব্যাপক তৎপরতা চালাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের ভিসা বাতিল, বিভাগীয় পরিবর্তন এবং অধ্যাপক নিরীক্ষার মতো উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। এর একটি দৃষ্টান্ত হল কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে মধ্যপ্রাচ্য বিভাগের পুনঃমূল্যায়ন।

এই প্রকল্পে ‘আমেরিকান মুসলিমস ফর প্যালেস্টাইন (AMP)’, ‘জিউইশ ভয়েস ফর পিস (JVP)’ এবং অন্যান্য মুসলিম ও প্রগতিশীল ইহুদি সংগঠনকে হামাসের সমর্থক হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়েছে। AMP-এর নির্বাহী পরিচালক ওসামা আবুইর্শাইদ বলেন, নামের মধ্যে ‘মুসলিম’ থাকায় ইসলামবিদ্বেষী প্রবণতাকে কাজে লাগানো হচ্ছে।তিনি জানান, “আমাদের সংগঠন কার্যকর বলেই তারা এটিকে নিশানা করেছে। যদি আমাদের ধ্বংস করা যায়, তাহলে পুরো আন্দোলনেই ভীতির সঞ্চার হবে।”

নিরাপত্তা ঝুঁকি, গ্রেফতার, মিডিয়া আক্রমণ সব মিলিয়ে ফিলিস্তিনপন্থী কর্মীদের জন্য সময়টা কঠিন। তবে, একই সঙ্গে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদও জোরালো হয়েছে। অনেকেই বলছেন, এই দমননীতির মধ্য দিয়েই বহু মানুষ নতুন করে সচেতন হচ্ছেন এবং ফিলিস্তিন সংহতি আন্দোলনে যুক্ত হচ্ছেন।জিউইশ ভয়েস ফর পিসের রাজনৈতিক পরিচালক বেথ মিলার বলেন, “এই আক্রমণ আমাদের চুপ করাতে পারবে না। বরং নতুন করে প্রতিবাদের শক্তি জোগাচ্ছে।”

‘প্রজেক্ট এসথার’ যুক্তরাষ্ট্রের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের মূল্যবোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে এমনটাই মত বিশ্লেষকদের। এটিকে শুধু একটি রাজনৈতিক কৌশল বললে কম বলা হবে; বরং এটি একটি সামাজিক ও নৈতিক লড়াইয়ের ইঙ্গিতবাহী প্রক্রিয়া, যেখানে ভবিষ্যতের প্রজন্মের পক্ষপাতহীনতা এবং ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নেওয়া ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে। এই মুহূর্তে প্রশ্ন উঠছে যুক্তরাষ্ট্র কি সত্যিই বাকস্বাধীনতার দেশ হিসেবে নিজের অবস্থান ধরে রাখতে পারবে?

 

 

 

সূত্র: আল জাজিরা

আফরোজা

×