
ছবিঃ সংগৃহীত
“আমি অনেক কষ্ট দেখেছি।”—বলেন লোকউই, এক বৃদ্ধ দক্ষিণ সুদানি। নিজের কুঁড়েঘরের পাশে রান্না করা এক নারীকে দেখিয়ে তিনি বলেন, “এই মহিলার স্বামীকে এখানে হত্যা করা হয়েছিল।”
এই নারী লোকউইয়ের ভাবি। ১৯৮৮ সালে, যখন দক্ষিণ সুদানের ‘সুদান পিপলস লিবারেশন আর্মি (SPLA)’ কাপোয়েত শহর ও আশপাশের গ্রাম দখল করে নেয়, তখন তার ভাইকে হত্যা করা হয়। সে সময় লোকউই ছিলেন শিশু। সেই ভয়াল দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন,
“ওইদিন ভালো কিছু ছিল না… গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সৈন্যরা বেসামরিকদের ওপর হামলা চালিয়েছিল। মানুষ চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল।”
দক্ষিণ সুদান—আফ্রিকার একটি দেশ, যেটি ২০১১ সালে সুদানের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে, দীর্ঘদিনের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পর। স্বাধীনতার সময় আশার আলো দেখা গেলেও, মাত্র দুই বছরের মাথায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোন্দলের কারণে আবারও সহিংসতা শুরু হয়।
২০১৮ সালে একটি যুদ্ধবিরতি এবং ক্ষমতা ভাগাভাগির চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও, তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতি রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা, অর্থনৈতিক সংকট এবং জাতিগত বিদ্বেষ দক্ষিণ সুদানে আবারও গৃহযুদ্ধের পরিবেশ তৈরি করেছে। ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে জাতিসংঘের দক্ষিণ সুদান মিশনের প্রধান নিকোলাস হেইসোম সতর্ক করে জানান, বিশ্বের নবীনতম দেশটি আবারও গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে।
লোকউই—যিনি টোপোসা জাতিগোষ্ঠীর সদস্য—এখন গ্রামের একটি গাছের ছায়ায় বসে সেই দিনগুলোর কথা বলেন। কীভাবে তিনি বনে পালিয়ে গিয়েছিলেন, কদিন বুনো ফলে বেঁচে ছিলেন, এবং পরে কিভাবে ক্ষুধার্ত অবস্থায় নারুস শহরে পৌঁছে এক দিনকা (Dinka) ব্যক্তির কাছ থেকে খাবার পেয়েছিলেন।
গ্রামে ফিরে এসে দেখেন, সবকিছু পুড়ে ছাই—ঘরবাড়ি, গরু, খাদ্যশস্যের গুদাম সব শেষ। তিনি সিদ্ধান্ত নেন আবার শুরু করার, কিন্তু তার আরেক ভাই, যিনি নারুসে বাস করেন, বলেন তিনি আর কখনো গ্রামে ফিরবেন না, কারণ এই ভূমি তাঁর জন্য যন্ত্রণার প্রতীক।
আজ লোকউই একজন শান্তি কর্মী। তিনি আশপাশের অঞ্চলে শান্তিপূর্ণ সংলাপের মাধ্যমে সহিংসতা রোধে কাজ করেন। কিন্তু যুবকদের সহিংসতা থেকে ফেরানো সহজ নয়, বললেন তিনি।
“আমি যখন তাদের বলি সংঘর্ষ থামাও… তখন কিছু পরিবার শোনে, কিন্তু কিছু যুবক শোনে না—তারা এখনও সমস্যা তৈরি করে।”
গবাদিপশু কেন্দ্রিক সহিংসতা ও আগ্নেয়াস্ত্রের ছড়াছড়ি
দক্ষিণ সুদানে ২০২৪ সালে, কিংস কলেজ লন্ডনের XCEPT প্রোগ্রামের আওতায় গবেষক আনা আদিয়ো সেবিত ও আরও তিনজন গবেষক টোপোসা ও নুয়ের সম্প্রদায়ের ৪০০-এর বেশি নারী-পুরুষের সাক্ষাৎকার নেন। গবেষণায় দেখা যায়, সহিংসতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানসিক ট্রমা অনেক সময় একজনকে সহিংসতায় জড়াতে প্রভাবিত করে।
এই অঞ্চলের পশুপালক জাতিগোষ্ঠীগুলো—যেমন দিনকা, নুয়ের, টোপোসা—গরুকে অর্থনৈতিক মূলধন হিসেবে বিবেচনা করে। গরু লাগে বিয়ের কনে মূল্য দিতে, আবার অপরাধের ক্ষতিপূরণ দিতেও। ফলে গরু লুট ও গোষ্ঠীগত সংঘাত নিয়মিত ঘটনা।
এক সময় এসব সংঘর্ষ ছিল লাঠি, পাথর ও বর্শার মাধ্যমে। কিন্তু এখন দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে আগ্নেয়াস্ত্র, বিশেষ করে AK-47। একজন বয়স্ক ব্যক্তি যিনি নিজেকে “অবসরপ্রাপ্ত যোদ্ধা” বলেন, জানান:
“আমাদের পূর্বপুরুষেরা যুদ্ধ করত লাঠি, পাথর আর বর্শা দিয়ে। তখন খুব কম সংঘর্ষ হতো। কিন্তু AK-47 আসার পর লুটপাট বেড়েছে, হতাহতের সংখ্যাও অনেক বেড়েছে।”
এই সমাজে লিঙ্গভিত্তিক দায়িত্বও স্পষ্ট। নারীরা কৃষিকাজ, রান্না ও ঘর বানানোর দায়িত্ব পালন করে। আর পুরুষদের কাজ গবাদিপশু পাহারা দেওয়া ও তা রক্ষার জন্য লড়াই করা। অনেক যুবক গরুর খামারে সময় কাটায়, যেখানে গরু চারণের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়—যা লুটপাটের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা।
বিয়ের জন্য কনে মূল্য (bride price) অর্জন করতে গেলে একজন তরুণের জন্য সফল গরু লুটপাট সম্মানের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু ছোটবেলা থেকে সহিংসতার অভিজ্ঞতা পরবর্তীতে তাদের মধ্যে প্রতিশোধমূলক হত্যাসহ নানা ধরণের সহিংসতা চালানোর প্রবণতা তৈরি করে।
নারীদের ওপর সহিংসতা ভয়াবহ মাত্রায়
২০২৪ সালে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের এক গবেষণায় বলা হয়, দক্ষিণ সুদানে ৬৫ শতাংশ নারী ও কিশোরী কোনো না কোনোভাবে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন—যার মধ্যে সর্বাধিক হলো সঙ্গীর দ্বারা নির্যাতন। জাতিসংঘের দক্ষিণ সুদান মিশন জানায়, ২০২৪ সালে যৌন সহিংসতা এবং নারী ও কিশোরীদের অপহরণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
লোকউই বলেন, তিনি গ্রামের বৈঠকে যখন শত্রু সম্প্রদায়ের লোকদের নিয়ে আলোচনা করেন, তখন নারী হত্যার বিষয়টি সামনে আনেন:
“তরুণরাও এসব মিটিংয়ে অংশ নেয়। আমরা সবাইকে বলি, ‘বনে নারীদের হত্যা বন্ধ করো।’ আমি তাদের বলি—নারীরাই প্রজন্ম সৃষ্টি করে, তাহলে কেন তাদের হত্যা করো? কেউ কেউ এ কথা শুনে অনুতপ্ত হয় এবং বন্ধ করে দেয়। কিন্তু আবারও অনেকে আছে, যাদের কাছে হত্যা জীবনযাপনের অংশ… তারা নারীদের হত্যা চালিয়ে যায়।”
ইমরান