ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ৩১ মে ২০২৫, ১৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

যেখানে হিরোশিমা নয়, টোকিওর রাতই ছিল সবচেয়ে ভয়ংকর, কেন এই নৃশংসতা?

প্রকাশিত: ০৩:০৭, ৩০ মে ২০২৫; আপডেট: ০৩:১১, ৩০ মে ২০২৫

যেখানে হিরোশিমা নয়, টোকিওর রাতই ছিল সবচেয়ে ভয়ংকর, কেন এই নৃশংসতা?

ছবি: সংগৃহীত

সূর্যোদয়ের দেশ জাপান। কিন্তু এই দেশের আকাশেও একদিন নেমে এসেছিল ইতিহাসের সবচেয়ে অন্ধকার রাত। হিরোশিমা ও নাগাসাকির পারমাণবিক ধ্বংসযজ্ঞের আড়ালে ঢাকা পড়ে গিয়েছে সেই রাতের কথা—যখন মাত্র কয়েক ঘণ্টায় আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল রাজধানী টোকিও। এই বিভীষিকাময় হামলাটি ইতিহাসে পরিচিত অপারেশন "মিটিং হাউজ" নামে। ১৯৪৫ সালের ৯ মার্চ রাতে সংঘটিত এই হামলায় মুহূর্তেই প্রাণ হারান প্রায় ১ লাখ মানুষ, যার বেশিরভাগই নারী, শিশু ও বৃদ্ধ।

আগুনের বর্ষণ: টোকিওর রাত বদলে গেল নরকে
সেই রাত ১০টা থেকে শুরু। প্রশান্ত মহাসাগর থেকে উড়ে আসে যুক্তরাষ্ট্রের ৩৩৪টি বি-২৯ সুপারফোর্টেস বোমারু বিমান। রাত ১২টা ১৫ মিনিটে প্রথম বোমা পড়ে জনবহুল সীতামাচি এলাকায়। এরপর মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ৩০ বর্গকিলোমিটার এলাকা আগুনে জ্বলে ওঠে। ৫ লাখ এম-৬৯ ন্যাপাম বোমার ক্লাস্টার ছড়িয়ে পড়ে গোটা শহরে। কাঠ ও কাগজের ঘরে তৈরি টোকিও দ্রুত রূপ নেয় এক দাউ দাউ করা অগ্নিসমুদ্রে। লাশে ভরে যায় সুমিদা নদী।

এক প্রত্যক্ষদর্শী, হারু ও নিহেই, যিনি সেসময় মাত্র আট বছরের শিশু, বলেন, জেগে দেখি চারপাশে আগুন। বাবা কোলে নিয়ে দৌড়াচ্ছেন, কিন্তু চারদিকে পুড়ে যাওয়া মানুষের দেহ। রাস্তায় আগুনে ঝলসানো লাশ স্তূপ হয়ে আছে। আমি একসময় পড়ে যাই সেই স্তূপের নিচে। আমাকে টেনে বের করা হলে দেখি, আমি একাই বেঁচে আছি। 

কেন এই নৃশংসতা?
১৯৪১ সালে জাপানের পার্ল হারবার আক্রমণের পর যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। জাপানের মূল ভূখণ্ডে আঘাত হানার সুযোগ খুঁজছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু জাপানের বিমান প্রতিরক্ষা ও প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতায় সাফল্য পাচ্ছিল না। তখন মার্কিন জেনারেল কার্টিস লেমে কৌশল বদলান। লক্ষ্য ছিল রাতের অন্ধকারে নিচু থেকে ফায়ার বম্ব ছুড়ে শহর পুড়িয়ে দেয়া।

এর আগে তারা পরীক্ষামূলকভাবে বানিয়েছিল জাপানি ঘরবাড়ির আদলে মডেল গ্রাম। সেখানে দেখে নেয় কোন ধরনের বোমা সবচেয়ে বেশি পুড়িয়ে দিতে সক্ষম। এরপর বেছে নেয় জেলি মিশ্রিত পেট্রোল ভর্তি ন্যাপাম বোমা। যা সহজেই মানুষের শরীরে ও কাঠে লেগে আগুন ছড়িয়ে দেয় দাবানলের মতো।

জেনারেল লেমে পরে স্বীকার করেন, জাপানিদের মারা আমার জন্য সমস্যা ছিল না। আমরা যদি যুদ্ধে হেরে যেতাম, তাহলে আমাকে যুদ্ধাপরাধে ফাঁসি দেওয়া হতো।

ইতিহাসের নিকৃষ্টতম বোমা হামলা?
হিরোশিমা ও নাগাসাকির পারমাণবিক বোমা তাৎক্ষণিকভাবে যে প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল, টোকিওর এই হামলায় নিহতের সংখ্যা ছিল তার চেয়েও বেশি। শুধু টোকিওতেই নয়, যুক্তরাষ্ট্র পরবর্তী সময়ে ওসাকা, কোবে, নাগোয়া সহ ৬৬টি শহরে ন্যাপাম বোমা ছুড়েছিল—যার কোন সামরিক ভিত্তি ছিল না। উদ্দেশ্য ছিল সিভিলিয়ানদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি।

এই ভয়াল রাত সম্পর্কে এক মার্কিন পাইলট পরে নিজের ডায়েরিতে লেখেন— দান্তের ইনফার্নো (নরক) আমাদের কাছে নিছক কল্পনা। কিন্তু টোকিওর সেই রাত ছিল বাস্তব। মানুষ পোড়া গন্ধে আমাদের অনেকে বিমানের মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল।


টোকিওর সেই বিভীষিকাময় রাত মানব ইতিহাসে এক নিষ্ঠুর অধ্যায়। এটা শুধু একটি যুদ্ধের ঘটনা নয়, বরং প্রমাণ করে যুদ্ধ মানেই শুধু রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব নয়, এটি বর্বরতারও চূড়ান্ত প্রকাশ। সেই রাত যেন আজও এক অদৃশ্য ধোঁয়ার মতো ছড়িয়ে আছে বিশ্ববিবেকের আকাশে।

ফরিদ 

×