ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১১ জুন ২০২৫, ২৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

রক্তে ইউরিক অ্যাসিড বেড়ে যাচ্ছে? সতর্ক না হলে বড় বিপদ!

প্রকাশিত: ১১:১৭, ১০ জুন ২০২৫

রক্তে ইউরিক অ্যাসিড বেড়ে যাচ্ছে? সতর্ক না হলে বড় বিপদ!

শরীরের ভেতরে এক ধরনের রাসায়নিক একটু বেশি হয়ে গেলেই শুরু হতে পারে নানা সমস্যা। হাঁটু ফুলে যাওয়া, পায়ের আঙুলে যন্ত্রণাদায়ক ব্যথা, কিডনিতে পাথর এই সব কিছুর পেছনে একটাই দোষী- ইউরিক অ্যাসিড। অথচ অনেকেই জানেন না, শরীরের এই স্বাভাবিক বর্জ্য পদার্থ কখন যেন নিঃশব্দে রূপ নেয় মারাত্মক রোগের উৎসে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউরিক অ্যাসিড যখন রক্তে অতিরিক্ত পরিমাণে জমে যায়, তখন তা গাঁটে গাঁটে জমে যন্ত্রণাদায়ক ব্যথা তৈরি করতে পারে। বাড়তে পারে কিডনির সমস্যা কিংবা হৃদরোগের ঝুঁকিও। চলুন জেনে নেওয়া যাক, ইউরিক অ্যাসিড কীভাবে বাড়ে, কখন সেটি বিপদজনক হয়ে ওঠে, এবং কীভাবে আপনি সহজ কিছু পরিবর্তনের মাধ্যমে শরীরকে সুস্থ রাখতে পারেন।


ইউরিক অ্যাসিড কী ও কোথা থেকে আসে

ইউরিক অ্যাসিড তৈরি হয় শরীরের কোষের ভেতরে থাকা ‘পিউরিন’ নামের একটি রাসায়নিক উপাদান ভেঙে যাওয়ার ফলে। এই পিউরিন কিছুটা শরীরেই তৈরি হয় এবং কিছুটা আসে খাদ্য থেকে বিশেষ করে লাল মাংস, কলিজা, সামুদ্রিক মাছ, চিংড়ি, এলকোহল ও চিনি বা ফ্রুক্টোজজাত খাবার থেকে।

লিভার পিউরিনকে ভেঙে ইউরিক অ্যাসিড তৈরি করে এবং তা শরীর থেকে বের করে দেওয়ার কাজ করে কিডনি ও অন্ত্র। কিন্তু যখন এই নিষ্কাশন প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন ঘটে অথবা অতিরিক্ত ইউরিক অ্যাসিড তৈরি হতে থাকে, তখন তা রক্তে জমা হতে থাকে। এই অবস্থাকেই বলা হয় হাইপারইউরিকেমিয়া।


স্বাভাবিক মাত্রা কত, কখন বিপদ?

পুরুষদের ক্ষেত্রে রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের স্বাভাবিক মাত্রা ২.৪ থেকে ৭.৪ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার এবং নারীদের ক্ষেত্রে ১.৪ থেকে ৫.৮ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার। ইস্ট্রোজেন হরমোন নারীদের শরীরে ইউরিক অ্যাসিডের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখে, ফলে তাদের ক্ষেত্রে এই মাত্রা তুলনামূলক কম থাকে। তবে মেনোপজের পর ইস্ট্রোজেনের পরিমাণ কমে গেলে নারীদের ইউরিক অ্যাসিড হঠাৎ বেড়ে যেতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা যদি ৬.৮ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটারের বেশি হয়, তাহলে তা শরীরে স্ফটিক আকারে জমা হতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে গাঁটে ব্যথা বা কিডনির সমস্যার মতো জটিলতা দেখা দিতে পারে।

কেন বাড়ে ইউরিক অ্যাসিডের পরিমাণ

অতিরিক্ত পিউরিনযুক্ত খাবার খাওয়া, যেমন গরুর মাংস, কলিজা বা সামুদ্রিক মাছ, ইউরিক অ্যাসিড বাড়ানোর জন্য অন্যতম দায়ী। এছাড়া চিনি বা ফ্রুক্টোজ সিরাপজাত পানীয়, যেমন কোমল পানীয় বা প্রসেসড ফুড, কিডনির অসুস্থতা, স্থূলতা, ডায়াবেটিস বা কিছু নির্দিষ্ট ওষুধও ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে।

ক্যানসারের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ বা কিছু জন্মগত বিপাকজনিত রোগেও এই মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। এমনকি অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন ও কম পানি পান করাও এর একটি বড় কারণ।

যে সমস্যাগুলো হতে পারে ইউরিক অ্যাসিড বেড়ে গেলে

সবচেয়ে প্রচলিত সমস্যা হলো গাউট। এটি এক ধরনের প্রদাহজনিত আর্থ্রাইটিস, যেখানে ইউরিক অ্যাসিড গাঁটে জমে ব্যথা, ফোলাভাব ও লালচে ভাব তৈরি করে। প্রথম দিকে সাধারণত একটি গাঁট আক্রান্ত হয়, যেমন পায়ের বড় আঙুল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একাধিক গাঁটও আক্রান্ত হতে পারে।

ইউরিক অ্যাসিড বাড়ার কারণে কিডনিতে পাথর তৈরি হওয়ার আশঙ্কাও থাকে। এতে তলপেটে তীব্র ব্যথা, প্রস্রাবে জ্বালা ও রক্তপাতের মতো সমস্যা দেখা দেয়।

ক্যানসারের চিকিৎসার সময় হঠাৎ করে অনেক কোষ একসঙ্গে ধ্বংস হয়ে গেলে একসঙ্গে অনেক ইউরিক অ্যাসিড তৈরি হয়, যা কিডনির উপর চাপ সৃষ্টি করে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এই অবস্থাকে বলা হয় টিউমার লাইসিস সিনড্রোম।

এছাড়া ফ্যানকোনি সিনড্রোম নামের একটি বিরল কিডনি রোগেও ইউরিক অ্যাসিডের ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়, যার ফলে শিশুরা ঠিকমতো বেড়ে উঠতে পারে না এবং হাড় দুর্বল হয়ে পড়ে।

কীভাবে বুঝবেন ইউরিক অ্যাসিড বেড়েছে কিনা

সবসময়ই যে লক্ষণ প্রকাশ পায়, তা নয়। তবে কারও শরীরে ইউরিক অ্যাসিড বেড়ে গেলে গাঁটে তীব্র ব্যথা, বিশেষ করে রাতে ঘুম ভাঙিয়ে দেওয়ার মতো যন্ত্রণা, হাঁটু বা আঙুলে ফোলাভাব ও লালচে ভাব দেখা দিতে পারে।

কিডনির পাথরের ক্ষেত্রে তলপেটে প্রচণ্ড ব্যথা, প্রস্রাবে রক্ত বা জ্বালাভাব দেখা দিতে পারে। টিউমার লাইসিস সিনড্রোমে দেখা দিতে পারে বমি, দুর্বলতা, খিঁচুনি ও হৃৎস্পন্দনের গতি বেড়ে যাওয়া।

রক্ত পরীক্ষা করলেই ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা জানা যায়। পাশাপাশি প্রয়োজনে প্রস্রাব পরীক্ষা, গাঁটের তরল বিশ্লেষণ বা কিডনির পাথরের গঠন বিশ্লেষণ করেও সঠিক রোগ নির্ণয় করা সম্ভব।

চিকিৎসা ও নিয়ন্ত্রণের উপায়

শরীরে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা একটু বেশি হলেও যদি উপসর্গ না থাকে, তাহলে সাধারণত ওষুধের প্রয়োজন হয় না। তবে মাত্রা অনেক বেশি হলে বা উপসর্গ প্রকাশ পেলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

গাউটের চিকিৎসায় ব্যথা কমাতে এনএসএআইডি জাতীয় ওষুধ, কোলচিসিন বা স্টেরয়েড ব্যবহার করা হয়। ঘন ঘন সমস্যা হলে ইউরিক অ্যাসিড কমানোর ওষুধ যেমন অলোপিউরিনল প্রয়োগ করা হয়।

কিডনির পাথরের ক্ষেত্রে বেশি পানি পান করতে বলা হয় এবং ইউরিক অ্যাসিড কমাতে কিছু ওষুধ দেওয়া হয়। প্রয়োজনে পাথর অপসারণেরও ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

টিউমার লাইসিস সিনড্রোমে রোগীকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখে চিকিৎসা দিতে হয়। ইউরিক অ্যাসিড কমাতে ইনজেকশন, স্যালাইন ও ইলেকট্রোলাইট নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি প্রয়োজনে ডায়ালাইসিসও করতে হয়।

ফ্যানকোনি সিনড্রোমে অ্যাসিডিটি কমানোর জন্য বেকিং সোডা, ফসফেট ও ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট দেওয়া হয়। জটিল ক্ষেত্রে কিডনি প্রতিস্থাপনও প্রয়োজন হতে পারে।

ইউরিক অ্যাসিড শরীরের স্বাভাবিক বর্জ্য হলেও মাত্রা বেড়ে গেলে তা নানা ধরনের রোগের কারণ হয়ে উঠতে পারে। সময়মতো রক্ত পরীক্ষা, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত পানি পান ও সঠিক জীবনযাত্রা মেনে চললে ইউরিক অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

আপনার যদি সন্দেহ হয় যে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বেশি, তাহলে দেরি না করে একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। কারণ এই একটি উপাদানই অনেক অজানা ব্যথা ও অসুস্থতার পেছনে লুকিয়ে থাকতে পারে।

 

 


সূত্র:https://tinyurl.com/bdtj43dc

আফরোজা

×