ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১২ জুন ২০২৫, ২৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

জেনে নিন কোন দেশ বিশ্বের সবচেয়ে বেশি চেরি উৎপাদন করে

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশিত: ০২:১৬, ১১ জুন ২০২৫

জেনে নিন কোন দেশ বিশ্বের সবচেয়ে বেশি চেরি উৎপাদন করে

ছবিঃ সংগৃহীত

চেরি—মিষ্টি, রসালো ও উজ্জ্বল এই ছোট ফলটি বহুদিন ধরেই ফলপ্রেমী ও রন্ধনশিল্পীদের কাছে প্রিয়। এটি কাঁচা খাওয়া যায়, আবার নানা রকম মিষ্টি, জ্যাম বা সিরাপে রূপ নিয়ে রান্নায় ব্যবহৃত হয়। কিন্তু আপনি কি জানেন বিশ্বের অধিকাংশ চেরি কোথা থেকে আসে? উত্তরটি হলো তুরস্ক—একটি দেশ যা তার সমৃদ্ধ ইতিহাস ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের পাশাপাশি, এখন চেরি উৎপাদনের দিক থেকেও বিশ্বে শীর্ষে রয়েছে।

এই প্রতিবেদনটিতে আমরা চেরির ইতিহাস, তুরস্ক কীভাবে চেরি উৎপাদনে শীর্ষস্থান দখল করেছে, এবং কীভাবে এই ফল বিশ্বজুড়ে মানুষের মন জয় করেছে, তা বিশ্লেষণ করবো।

চেরির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

চেরি ফলটি "Prunus" গণের অন্তর্গত এবং এটি পিচ, আলুবোখারা ও এপ্রিকটের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। এর উৎপত্তি প্রাগৈতিহাসিক যুগে, এমনকি প্রস্তর যুগেও মানুষ বুনো চেরি খেত বলে প্রমাণ রয়েছে। প্রাচীন গ্রিক, রোমান এবং পার্সিয়ান সভ্যতায় চেরি অত্যন্ত আদৃত ছিল। রোমান জেনারেল লুকুলাস খ্রিস্টপূর্ব ৭৪ সালে চেরিকে এশিয়া মাইনর (বর্তমান তুরস্ক) থেকে ইউরোপে নিয়ে যান। সেখান থেকেই এর ব্যাপক বিস্তার ঘটে।

চেরির জনপ্রিয়তার কারণ কী?

চেরির জনপ্রিয়তা শুধু এর স্বাদের জন্য নয়, এর পুষ্টিগুণ এবং স্বাস্থ্য উপকারিতার জন্যও। চেরিতে রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট (যেমন অ্যান্থোসায়ানিন ও কুয়েরসেটিন), প্রচুর ভিটামিন সি, পটাশিয়াম ও ফাইবার। এটি প্রাকৃতিক মেলাটোনিনের কারণে ঘুমের মান উন্নত করে এবং প্রদাহ কমাতেও সহায়ক। এসব উপাদান ও রন্ধনপ্রস্তুতিতে বহুমুখী ব্যবহার চেরিকে বিশ্বজুড়ে অত্যন্ত চাহিদাসম্পন্ন ফল করে তুলেছে।

বৈশ্বিক চেরি উৎপাদন: একটি চিত্র

যদিও যুক্তরাষ্ট্র, ইরান ও চিলি চেরি উৎপাদনে পরিচিত, তুরস্ক উৎপাদনের দিক থেকে অনেক এগিয়ে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বার্ষিক উৎপাদন:

  

দেশ আনুমানিক বার্ষিক উৎপাদন (মেট্রিক টন)
তুরস্ক ৮৫০,০০০+
যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ৩৬০,০০০
ইরান ২২০,০০০
চিলি ২০০,০০০
উজবেকিস্তান ১৭০,০০০

 

তুরস্ক বিশ্বের মোট চেরির ২০% এরও বেশি উৎপাদন করে, যা একে নিরবিচারে শীর্ষ চেরি উৎপাদক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

কেন তুরস্ক চেরি উৎপাদনে শীর্ষে?

১. আবহাওয়া ও ভৌগোলিক সুবিধা: তুরস্কের ভূমধ্যসাগরীয় আবহাওয়া এবং উর্বর আগ্নেয় মাটি চেরি চাষের জন্য আদর্শ। আফিওনকারাহিসার, ইস্পার্তা, কনিয়া, মানিসা এবং ইজমির অঞ্চলের উঁচু জায়গা ও শীতল আবহাওয়া চেরির মান উন্নত করে।

২. প্রাচীন কৃষিপরম্পরা: তুরস্কে হাজার হাজার বছর ধরে চেরির চাষ হচ্ছে। ঐতিহ্যবাহী চাষ পদ্ধতির সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে এখানে চেরির ফলন ও গুণগত মান খুবই উন্নত।

৩. বিভিন্ন জাত ও বৈচিত্র্য: তুরস্কে মিষ্টি (Prunus avium) এবং টক (Prunus cerasus) উভয় ধরনের চেরি উৎপাদিত হয়। জনপ্রিয় জাতগুলো হলো Ziraat 900, Napoleon, Regina এবং Starks Gold।

৪. শক্তিশালী রপ্তানি বাজার: তুরস্ক চেরি রপ্তানি করে জার্মানি, রাশিয়া, চীন, যুক্তরাজ্য এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। দেশটির অবস্থান এবং উন্নত পরিবহন ব্যবস্থাপনা একে বড় রপ্তানিকারক হিসেবে সাহায্য করেছে।

তুরস্কের চেরি শিল্পের অর্থনৈতিক প্রভাব

  • ৫ লক্ষাধিক মানুষ এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত।

  • প্রতিবছর মিলিয়ন ডলার আয় হয় রপ্তানি থেকে।

  • গ্রামীণ উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখে।

  • স্থানীয় উৎসব ও চেরি পর্যটনের প্রসার ঘটায়।

তুরস্ক এখন ঠান্ডা সংরক্ষণাগার, প্যাকেজিং ও পরিবহন প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে, যাতে বৈশ্বিক চাহিদা পূরণ সম্ভব হয়।

অন্যান্য শীর্ষ চেরি উৎপাদনকারী দেশসমূহ

যুক্তরাষ্ট্র: ওয়াশিংটন, ওরেগন, ক্যালিফোর্নিয়া ও মিশিগান রাজ্য থেকে মিষ্টি ও টক চেরি উৎপন্ন হয়। মিশিগানে হয় বিখ্যাত ন্যাশনাল চেরি ফেস্টিভাল।

ইরান: তেহরান, কাজভিন ও পূর্ব আজারবাইজানে প্রধান চেরির চাষ হয়। দেশটি স্থানীয় বাজার ও রপ্তানি উভয়ের জন্য চেরি সরবরাহ করে।

চিলি: দক্ষিণ গোলার্ধের জন্য, নভেম্বরে থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত চেরি উৎপাদন করে চিলি উত্তর গোলার্ধের শীতকালে বিশেষ চাহিদা পূরণ করে। চীনে চিলির চেরির বিশাল বাজার রয়েছে।

চেরির প্রধান জাত ও ব্যবহার

মিষ্টি চেরি: Bing, Regina, Napoleon
টক চেরি: Montmorency, Morello, Oblacinska

চেরির ব্যবহার হয়:

  • চেরি ব্র্যান্ডিতে

  • জ্যাম ও সংরক্ষিত খাবারে

  • শুকনো খাবার হিসেবে

  • মিষ্টান্ন ও গার্নিশে

  • তুরস্কের ঐতিহ্যবাহী ভিশনে রেচেলি (টক চেরি জ্যাম)-এ

বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ

চেরি উৎপাদনে যেসব সমস্যা দেখা দেয়:

  • জলবায়ু পরিবর্তন ও অনিশ্চিত আবহাওয়া

  • শ্রমিক সংকট

  • সংরক্ষণের সীমাবদ্ধতা

  • বাজার প্রতিযোগিতা

এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় উৎপাদকরা আধুনিক প্রযুক্তি, সংরক্ষণ কৌশল ও টেকসই কৃষিপদ্ধতি গ্রহণ করছে।

তুরস্ক বৈশ্বিক চেরি উৎপাদনে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে তার অনুকূল আবহাওয়া, প্রাচীন কৃষিরীতি এবং শক্তিশালী রপ্তানি ব্যবস্থার কারণে। আজকের আধুনিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ খামার থেকে শুরু করে প্রাচীন উদ্যান—তুরস্কের চেরি শিল্প সত্যিকার অর্থেই ঐতিহ্য ও আধুনিকতার এক অপূর্ব সংমিশ্রণ।

চেরি শুধু একটি মৌসুমি ফল নয়, এটি সাংস্কৃতিক ইতিহাস, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং বিশ্বজুড়ে রন্ধনপ্রিয়তার এক অনন্য প্রতীক। আপনি যখন একটি মিষ্টি তুর্কি চেরিতে কামড় দেন বা শীতে চেরি পাই উপভোগ করেন, তখন আপনি স্বাদ নিচ্ছেন এমন এক ফলের, যার স্বাদ যতটা রঙিন, তার ইতিহাস ততটাই গভীর।

সুত্রঃ https://lodhigarden.com/which-country-is-the-largest-cherry-producer-in-the-world/

পৃথী

×