ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৩ মে ২০২৫, ২৯ বৈশাখ ১৪৩২

কৃষ্ণচূড়ার রঙে রঙিন প্রকৃতি: গ্রীষ্মের খরতাপেও চোখজুড়ানো শান্তি

সোহাইল আহমেদ কলামিস্ট,গণমাধ্যমকর্মী,শিক্ষক ও সংগঠক

প্রকাশিত: ২৩:৫৯, ১২ মে ২০২৫

কৃষ্ণচূড়ার রঙে রঙিন প্রকৃতি: গ্রীষ্মের খরতাপেও চোখজুড়ানো শান্তি

ছবি:সংগৃহীত

গ্রীষ্মের খরতাপে যখন পথঘাট জ্বলতে থাকে, তখনই যেন প্রকৃতি মেলে ধরে তার অপরূপ সৌন্দর্য। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলা এ সময়টাতে যেন রঙের উৎসবে মেতে ওঠে। গ্রীষ্মের এই তপ্ত ঋতুতে কৃষ্ণচূড়া ফুলের লাল আগুনে রাঙা হয় পথঘাট, খোলা প্রান্তর আর মেঠোপথের পাশ।আগুনরাঙা কৃষ্ণচূড়ার শোভা শুধু চোখে না, ছুঁয়ে যায় মনের গভীরেও।

উপজেলার ছয়ফুল্লাকান্দির বিলপাড়, সফিরকান্দি, কৃষ্ণনগর, ভেলানগর, পাহাড়িয়াকান্দিসহ বিভিন্ন গ্রামে এখন কৃষ্ণচূড়ার দখলে প্রকৃতি। শান্ত জলের তিতাস নদীর পাশ ঘেঁষে চলা মেঠোপথগুলোর ধারে সারি সারি কৃষ্ণচূড়া গাছ যেন প্রকৃতির এক জীবন্ত ক্যানভাস। বৈশাখের কাঠফাটা রোদ্রের মধ্যে এই লাল-কমলা ফুলগুলো প্রকৃতিকে দেয় এক অনন্য মাত্রা।

মেঘ-বৃষ্টির লুকোচুরি খেলায় আর মাঝেমধ্যে বয়ে যাওয়া বাতাসে যখন কৃষ্ণচূড়ার ডাল দুলে ওঠে, তখন সেই দৃশ্য যে কারও হৃদয়ে প্রশান্তির বাতাস বইয়ে দেয়। ফুলে ফুলে ভরে থাকা গাছে গাছে যেন রঙের উৎসব। কখনো গাঢ় লাল, কখনো কমলা বা হালকা হলুদ রঙের বাহার প্রকৃতিকে সাজিয়ে তোলে অপরূপভাবে।

প্রতিদিনের পথচলায় অনেক পথচারী থেমে যান এই সৌন্দর্যের টানে। সম্প্রতি বাঞ্ছারামপুরের একটি মেঠোপথে দেখা মেলে কয়েকজন ভ্রমণপিপাসু মানুষের। কথা হয় তাদের সঙ্গে। তারা জানান, শুধু প্রকৃতির ছোঁয়া পেতে, বুকভরে নিঃশ্বাস নিতে এসেছেন এখানে। তাদের কথায় উঠে আসে একটাই বার্তা— “বাঁচতে হলে প্রকৃতিকে ধারণ করতে হবে।”

এখানকার সকাল-বিকাল যেন ভিন্ন ভিন্ন রূপে ধরা দেয়। খুব ভোরে কৃষ্ণচূড়ার রঙ গাঢ় মনে হলেও বিকেলের মৃদু আলোয় তা হয়ে ওঠে তুলনাহীন সুন্দর। নদীর এক পাশে কৃষ্ণচূড়ার সারি আর অন্য পাশে সবুজ প্রান্তর মিলে তৈরি করে এক নয়নাভিরাম দৃশ্যপট। এই অপূর্ব পরিবেশ শুধু দৃষ্টির আরামই দেয় না, বরং হৃদয়েও ছড়িয়ে দেয় এক প্রশান্তির ছায়া।

ষড়ঋতুর এই বাংলাদেশে প্রকৃতি প্রতিটি ঋতুতে নিজেকে প্রকাশ করে ভিন্নভাবে। তবে গ্রীষ্মকালে কৃষ্ণচূড়ার এই প্রাণবন্ত উপস্থিতি যেন রুক্ষ সময়ের মাঝেও প্রাণের সঞ্চার করে। বাঞ্ছারামপুরের প্রতিটি মেঠোপথ আর গ্রামের মাঠ-প্রান্তর যেন কৃষ্ণচূড়ার রঙে রঙিন হয়ে উঠেছে।

এছাড়া কৃষ্ণচূড়ার এই বাহারি রূপ স্থানীয়দের জীবনযাত্রাতেও প্রভাব ফেলে। গ্রামের শিশু-কিশোরেরা এখন সময় পেলেই ছুটে যায় ফুলঝরা গাছের নিচে। কেউ পাঁপড়ি কুড়ায়, কেউ বা মোবাইলে ছবি তোলে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিদিনই শেয়ার হচ্ছে এসব ছবির বাহার। স্থানীয় তরুণ-তরুণীদের কাছে কৃষ্ণচূড়া এখন শুধু একটি ফুল নয়, হয়ে উঠেছে অনুভূতির অংশ। প্রেমিক-প্রেমিকারা খুঁজে নিচ্ছেন এই গাছের ছায়া, কেউ কেউ নিচে বসে কাটাচ্ছেন দুপুরের একটুখানি সময়।

বৃদ্ধ-প্রবীণরাও নস্টালজিয়ার ঘোরে হারিয়ে যান কৃষ্ণচূড়ার তলায় দাঁড়িয়ে। অনেকেই বলেন, তাদের শৈশবের স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই কৃষ্ণচূড়ার সঙ্গে। সেদিনকার স্কুলফেরা বিকেল কিংবা গ্রামের মেলার দিনগুলো ফিরে আসে চোখের সামনে। প্রকৃতি যেন তাদের স্মৃতির দরজায় নক করে।

বাঞ্ছারামপুরে যাদের বাড়ির আঙিনায় কিংবা রাস্তার পাশে কৃষ্ণচূড়া গাছ রয়েছে, তারা গর্ব করেই বলেন— “এই গাছ আমাদের আত্মার অংশ হয়ে গেছে।” কেউ কেউ নিজের খরচে গাছ লাগিয়েছেন পথের ধারে, যাতে আগামী প্রজন্মও এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে।

এছাড়া স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে অনেকেই দাবি তুলেছেন— “বাঞ্ছারামপুরের সৌন্দর্য ধরে রাখতে কৃষ্ণচূড়া ও রেইনট্রির মতো গাছ আরও লাগানো হোক।” পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ হিসেবে উপজেলা প্রশাসন চাইলে এই ফুলের সৌন্দর্যকে পর্যটনের অংশ হিসেবেও কাজে লাগাতে পারে।

এই রঙ, এই সৌন্দর্য শুধু চোখে দেখার নয়, হৃদয়ে ধারণ করার মতো। প্রকৃতি যে আমাদের সবচেয়ে বড় উপহার— এই কৃষ্ণচূড়ার শোভা যেন আবারও সেই বার্তাই দেয় নিঃশব্দে। তাই গ্রীষ্মের রোদ্রের মাঝেও কৃষ্ণচূড়ার আগুনরাঙা সৌন্দর্য বাঞ্ছারামপুরকে দিয়েছে এক অনন্য রূপ— যা দেখলে যে কেউ থেমে যেতে বাধ্য।
 

আলীম

×