ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৫ জুন ২০২৫, ১২ আষাঢ় ১৪৩২

টেক্সবিজ: ভবিষ্যৎ বিজনেস লিডারদের মঞ্চ

রাতুল সাহা, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশিত: ২০:৪৩, ২৪ জুন ২০২৫

টেক্সবিজ: ভবিষ্যৎ বিজনেস লিডারদের মঞ্চ

ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে ব্যতিক্রম এক দৃশ্য। দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রাণবন্ত উপস্থিতি। কেউ স্যুট-টাই পরে, কেউ শাড়ি,কেউবা ব্লেজার কিংবা ফরমাল শার্ট-প্যান্টে। তাদের চোখে-মুখে আত্মবিশ্বাস, কথাবার্তায় পেশাদারিত্ব, যেন তারা একেকজন উদীয়মান কর্পোরেট লিডার।

সারারাত বৃষ্টিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনের মাঠে তখনো কিছুটা পানি জমে আছে। হাতে কফির কাপ, চোখে-মুখে উত্তেজনা আর পেছনে দুই মাসের নির্ঘুম প্রস্তুতি। বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় (বুটেক্স) বিজনেস ক্লাবের স্বেচ্ছাসেবীরা দৌড়ে দৌড়ে ঘুরছে—কে কোথায় কী লাগাবে, কোন অতিথি কখন আসবেন, কোন আলোটা একটু বাঁকা, কোন ব্যানারটা একটু নিচে এসব ছোট ছোট ব্যাপারে তাদের যত্ন যেন শিল্পীর তুলির আঁচড়। এমন উদ্দীপনা ও ব্যস্ততার মূলে রয়েছে বুটেক্স বিজনেস ক্লাব কর্তৃক আয়োজিত আন্ত:বিশ্ববিদ্যালয় বিজনেস কেস প্রতিযোগিতা টেক্সবিজ ২০২৫।

টেক্সটাইল শিক্ষার্থীদের বিজনেস যুদ্ধক্ষেত্র

টেক্সটাইল-ভিত্তিক আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় বিজনেস কেস প্রতিযোগিতা 'টেক্সবিজ' এখন আর শুধু একটি ইভেন্ট নয়—এটি একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে তরুণরা শিখে নেয় কীভাবে চিন্তা করতে হয় একজন কর্পোরেট লিডারের মতো। কেবল ক্লাসরুমে শেখা পাঠ নয়, এখানে তাদের মুখোমুখি হতে হয় বাস্তব সমস্যার, যেগুলোর সমাধান দিতে হয় প্রেজেন্টেশন, ডেটা অ্যানালাইসিস এবং টিমওয়ার্কের মাধ্যমে।

বুটেক্স বিজনেস ক্লাবের আয়োজনে এই আয়োজন এখন হয়ে উঠেছে ভবিষ্যৎ ম্যানেজার, বিজনেস স্ট্র্যাটেজিস্ট ও উদ্যোক্তাদের প্রস্তুতির এক অনন্য মঞ্চ। প্রতিযোগীদের কেস সমাধান করতে গিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে হয়—পণ্য উন্নয়ন, টার্গেট মার্কেট, সাপ্লাই চেইন মডেল, টেকসই ও লাভজনকতা—সবকিছু মাথায় রেখেই প্রেজেন্টেশন তৈরি করতে হয়। এই প্রতিযোগিতা টেক্সটাইল শিক্ষার্থীদের জন্য একটি ধাক্কার মতো, যা তাদের অ্যাকাডেমিক কমফোর্ট জোন থেকে টেনে আনে কর্পোরেট বাস্তবতার মুখোমুখি। যেখানে শুধুই বুদ্ধিমত্তা নয়, প্রয়োজন হয় সময় ব্যবস্থাপনা, যোগাযোগ দক্ষতা ও একাগ্রতার। এটি এমন এক প্ল্যাটফর্ম, যা তরুণদের শেখায়—টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রির ভবিষ্যৎ কেবল টেকনিক্যাল দক্ষতায় নয়, বিজনেস স্ট্র্যাটেজিতেও গড়ে উঠবে।

শুরুটা যেখানে

এই বছরের আসরে অংশ নিতে রেজিস্ট্রেশন করে ২০০টিরও বেশি দল। এর মধ্যে ৯৫টি দল জমা দেয় প্রাথমিক রাউন্ডের কেস সল্যুশন, যেখান থেকে বাছাইকৃত ৪০টি দল জায়গা পায় ওভিসি (Online Video Conference) রাউন্ডে। এই রাউন্ডে অংশগ্রহণকারীদের বিশ্লেষণ ক্ষমতা, দলগত কাজের স্কিল, যোগাযোগ দক্ষতা এবং সোশ্যাল এনগেজমেন্টের উপর ভিত্তি করে ১৭টি দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয় সেমিফাইনালে।

সেমিফাইনালে প্রতিযোগীরা বিচারকদের সামনে উপস্থাপন করেন একটি বাস্তব কেস সমস্যার সমাধান। তাদের প্রতিটি প্রেজেন্টেশন ছিল ব্যবসায়িক অন্তর্দৃষ্টিতে ভরপুর এবং টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রির নানা দিক বিবেচনায় সুচিন্তিত। সেখান থেকে বাছাই করা সেরা ৬টি দল অংশ নেয় টেক্সবিজ ২০২৫-এর চূড়ান্ত পর্বে। ফাইনালে সেরার মুকুট জয়ের লড়াইয়ে যে কেবল কৌশল ও বিশ্লেষণ, তা-ই নয়, প্রয়োজন হয়েছিল আত্মবিশ্বাস, দলগত কাজ এবং বাস্তব অভিজ্ঞতা।

উদ্ভাবনী চিন্তায় এগিয়ে তিন সেরা দল

চূড়ান্ত পর্বে প্রতিটি দলই নিজেদের সেরা চেষ্টাটা তুলে ধরেছে। যেখানে চ্যাম্পিয়ন হয় ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি টিম 'কেইস ক্লোজড ক্রু'। তারা পুরস্কার হিসেবে ৳৪০,০০০ প্রাইজমানি পায়।প্রথম ও দ্বিতীয় রানারআপ হয়  বুটেক্সের 'টিম ট্রেইলব্লেজারস' ও বিইউপি, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে গঠিত 'টিম ঝালমুড়ি' তারা যথাক্রমে ৳২৫,০০০ ও ৳১৫,০০০ প্রাইজমানি পায়। চ্যাম্পিয়ন, রানারআপ দলের সকলের জন্য ছিল ক্রেস্ট ও সার্টিফিকেট। এছাড়া 'টিম দিবালোক' কে বেস্ট ইমার্জিং টিম ঘোষণা করা হয়।

ত্রিমাত্রিক ভাবনার রঙে রঙিন টেক্সবিজ

এই আয়োজন কেবল কেস সল্যুশনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এর পাশাপাশি ছিল আরও দুইটি সেগমেন্ট:
আর্টিকেল রাইটিং কম্পিটিশন, যেখানে বিশ্লেষণধর্মী ভাবনার প্রকাশ ঘটেছে কলমের মাধ্যমে। এ সেগমেন্টে ১০০টি দল রেজিস্ট্রেশন করে। যেখানে চ্যাম্পিয়ন হয় কুয়েটের শিক্ষার্থী রোয়াইদা বিনতে আলী এবং রানারআপ হয় বুটেক্সের শিক্ষার্থী আনজুম আব্দুল্লাহ পোস্টার প্রেজেন্টেশন, যেখানে সমস্যা ও সমাধান রূপ নিয়েছে ভিজ্যুয়াল আইডিয়ায়। পোস্টার প্রেজেন্টেশনে ৬০ এর অধিক দল রেজিস্ট্রেশন করে। পোস্টার প্রেজেন্টেশনে চ্যাম্পিয়ন ও রানারআপ হয় বুটেক্সের 'টিম ফিউশন' ও 'টেক টিউর গ্রিন'। প্রতিটি সেগমেন্টে শিক্ষার্থীরা তাদের চিন্তা, গবেষণা এবং সৃজনশীলতা দিয়ে মুগ্ধ করে বিচারকদের।

ডেকোরেশন থেকে ডেডিকেশন

দুই মাস ধরে নিরলসভাবে কাজ করেছে বুটেক্স বিজনেস ক্লাবের সদস্যরা। পুরো আয়োজনটি পরিচালনা করেছে ক্লাবের আটটি বিভাগ: ক্রিয়েটিভ, আইটি, পাবলিক রিলেশন, কমিউনিকেশন, ইভেন্ট, অ্যাডমিন, ফিন্যান্স ও লজিস্টিকস।

ডেকোরেশন টিম বিশ্ববিদ্যালয়ের চেনা পরিবেশটাকে বদলে দিয়েছিল এক কর্পোরেট কনফারেন্স সেন্টারে—ব্যাকড্রপ, ব্যানার, রঙিন আলো, ফটো বুথ, কাঠামোগত সেটআপ সব কিছুতেই ছিল পেশাদারিত্ব।

টেক্সবিজ ২০২৫–এর প্রতিটি মুহূর্তকে আকর্ষণীয় ও হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার মতো করে তুলেছে যে দলটি, তারা হলো ক্রিয়েটিভ টিম। আয়োজন শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই, নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করেছে এই দল। একের পর এক চমৎকার পোস্টার, ব্যানার, সোশ্যাল মিডিয়ার ভিজ্যুয়াল কনটেন্ট, প্রোমোশনাল ভিডিও—সবকিছুতেই তারা রেখেছে অসাধারণ দক্ষতার ছাপ।

অনলাইন প্রমোশন, গ্রাফিক ডিজাইন, ভিডিও শুট ও এডিটিং—সবকিছুই তারা করেছে পেশাদারিত্ব ও নিখুঁত পরিকল্পনার সমন্বয়ে। শুধু একটি অনুষ্ঠান নয়, তারা তৈরি করেছে একটি ব্র্যান্ডেড এক্সপেরিয়েন্স নিঃসন্দেহে, এই দলের সৃষ্টিশীলতা ও নিবেদিত পরিশ্রমই ছিল পুরো আয়োজনের চোখে দেখা যায় না এমন মেরুদণ্ড—যা ছাড়া এই অনুষ্ঠান এতটা প্রাণবন্ত, এতটা সৌন্দর্যমণ্ডিত হতো না।

পাবলিক রিলেশন টিম ৮ সদস্যের একটি দল গঠন করে যারা সারাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ১০০টি ক্লাবকে কোলাবোরেশান প্রপোজাল পাঠায়,যেখানে তারা ৫০ জন ক্যাম্পাস অ্যাম্বাসেডর পায় যারা বাইরের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে টিম রেজিস্ট্রেশনে ভূমিকা রাখে। এছাড়া ২ সপ্তাহব্যাপী অনলাইন রোড শো করে থাকে।

যোগাযোগ ও প্রচারণার দায়িত্বে ছিল কমিউনিকেশন ডিপার্টমেন্ট। তারা স্পন্সর প্রপোজাল তৈরি, ই-মেইল ও বিচারক আমন্ত্রণ পাঠানো, ইনভাইটেশন লিস্ট তৈরি, ক্লাসরুম প্রমোশন এবং সোশ্যাল মিডিয়া কনটেন্ট ম্যানেজমেন্টে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

আইটি টিম পুরো রেজিস্ট্রেশন, কেস সাবমিশন ও রেজাল্ট প্রসেসিং সিস্টেমকে রেখেছে অনলাইনভিত্তিক ও স্বচ্ছ।

পর্দার আড়ালে নিরলসভাবে কাজ করে গেছে ইভেন্ট ও লজিস্টিকস টিম। প্রতিটি পোস্টার ও ব্যানার প্রিন্ট থেকে শুরু করে খাবারের অর্ডার ও সময়মতো বিতরণ, বিচারক ও বিজয়ীদের জন্য ক্রেস্ট ও উপহার প্রস্তুত, সেগুলো সংগ্রহ, প্যাকেজিং ও সুশৃঙ্খলভাবে বিতরণ—সব দায়িত্বই তারা পালন করেছে নিখুঁতভাবে। এই টিমের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও নিষ্ঠাই আয়োজনকে করেছেন সফল। ইভেন্ট ও লজিস্টিকস টিম টিকিয়ে রেখেছিল পুরো ইভেন্টের ফাউন্ডেশন।

এই সবকিছুর পেছনে ছিল একটাই জিনিস—একটি স্বপ্ন, যেখানে শিক্ষার্থীরা শুধু ক্লাসরুমে শিখবে না, বাস্তব জীবনের চ্যালেঞ্জও মোকাবেলা করবে।

টেক্সবিজ ২০২৫ শেষ হয়েছে। মঞ্চ খুলে গেছে, ব্যানার খুলে গেছে, অতিথিরা চলে গেছেন। কিন্তু থেকে গেছে একটা বিশ্বাস—এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শুধু ইঞ্জিনিয়ার নয়, তারা হতে পারে লিডার, সলভার, চেঞ্জমেকার।

এই আয়োজন প্রমাণ করে দিয়েছে—যদি স্বপ্ন থাকে, পরিকল্পনা থাকে আর কাজের প্রতি ভালোবাসা থাকে, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়েও শিক্ষার্থীরা গড়তে পারে এক আন্তর্জাতিক মানের আয়োজন।

Mily

×