
ছবি: সংগৃহীত
দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখা শিক্ষার্থীদের জন্য ইংরেজি ভাষার দক্ষতা প্রমাণ করা এক অপরিহার্য ধাপ। এতদিন আইইএলটিএস (International English Language Testing System) ছিল এর প্রধান উপায়। তবে, সময়সাপেক্ষ নিরীক্ষণ পদ্ধতি এবং ব্যয়বহুল নিবন্ধনের কারণে এর বিকল্প হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে প্রযুক্তিনির্ভর ও সহজলভ্য নানা পরীক্ষা। এমনই একটি যুগান্তকারী পরীক্ষা হলো ডুওলিঙ্গো ইংলিশ টেস্ট (DET), যা বর্তমানে উন্নত বিশ্বের পাঁচ হাজারের বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরিহার্য যোগ্যতা হিসেবে গৃহীত হচ্ছে। চলুন, ডুওলিঙ্গো পরীক্ষার পদ্ধতি এবং এতে অংশ নেওয়ার বিস্তারিত প্রক্রিয়া জেনে নেওয়া যাক।
ডুওলিঙ্গো ইংলিশ টেস্ট (DET) কী?
আমেরিকান প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষাবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ডুওলিঙ্গো ২০১৬ সালে ডিইটি চালু করে। কোভিড-১৯ মহামারি চলাকালে এর জনপ্রিয়তা ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
ডিইটি এমন একটি উদ্ভাবনী নিরীক্ষণ ব্যবস্থা, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) পরিচালিত অ্যালগরিদম ব্যবহার করা হয়। এটি পরীক্ষার্থীর প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর যাচাই করে তার মেধাবৃত্তিক অবস্থান মূল্যায়ন করে। অর্থাৎ, পরীক্ষার্থী একটি প্রশ্নের উত্তর সঠিকভাবে দিলে পরবর্তী প্রশ্নটি তুলনামূলকভাবে কঠিন করা হয় এবং এভাবেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুরো পরীক্ষাটি এগোতে থাকে। এর ফলে প্রতিটি পরীক্ষার্থীর জন্য একটি স্বতন্ত্র এবং অভিযোজিত (adaptive) পরীক্ষার অভিজ্ঞতা তৈরি হয়।
ডুওলিঙ্গো ইংলিশ টেস্ট পদ্ধতি: এক ঘণ্টার পরীক্ষা, সুনির্দিষ্ট বিন্যাস
ডুওলিঙ্গোর প্রশ্ন বাছাইয়ের জন্য রয়েছে সমৃদ্ধ ডেটাবেজ, তাই যতবারই পরীক্ষা দেওয়া হোক না কেন, একই প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। মোট এক ঘণ্টার এই পরীক্ষায় তিনটি ভিন্ন ধরনের বিভাগ থাকে:
-
১. ইনট্রোডাকশন অ্যান্ড অনবোর্ডিং (সময়: ৫ মিনিট) পরীক্ষার শুরুতে কম্পিউটার, স্পিকার ও মাইক্রোফোন সঠিকভাবে কাজ করছে কিনা, তা নিশ্চিত করতে হবে। এরপর পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র বা ড্রাইভিং লাইসেন্সের যেকোনো একটির ছবি আপলোড করে জমা দিতে হবে। এই ধাপে পরীক্ষার নিয়মকানুন ও প্রয়োজনীয়তা পর্যালোচনা করা হয়।
-
২. অ্যাডাপ্টিভ টেস্ট (সময়: ৪৫ মিনিট) এটিই পরীক্ষার প্রধান অংশ, যেখানে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্নের মাধ্যমে ইংরেজিতে দক্ষতা পরিমাপ করা হয়। এখানে প্রশ্নের কাঠিন্য নির্ভর করে পরীক্ষার্থীর আগের প্রশ্নের উত্তরের উপর। এটি পরীক্ষার্থীর প্রকৃত দক্ষতা নির্ণয়ে সহায়ক হয়।
-
৩. রাইটিং স্যাম্পল অ্যান্ড স্পিকিং স্যাম্পল (সময়: ১০ মিনিট) এই অংশে পরীক্ষার্থীর ইংরেজিতে লিখতে ও কথা বলতে পারার দক্ষতা যাচাই করা হয়। কথা বলার নমুনার জন্য ১ থেকে ৩ মিনিট এবং লেখার জন্য ৩ থেকে ৫ মিনিট সময় পাওয়া যায়।
ডিইটি স্কোর পদ্ধতি: দ্রুত ফলাফল, বিস্তারিত মূল্যায়ন
ইংরেজি ভাষার পারদর্শিতা মূল্যায়নের জন্য ১০ থেকে ১৬০ ডিইটি স্কেলে স্কোর করা হয়। ন্যূনতম ১২০-এর ওপর স্কোর থাকলেই ইংরেজিতে দক্ষ বলে বিবেচিত হয়। পরীক্ষা দেওয়ার মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ফলাফল পাওয়া যায়, যা অন্যান্য পরীক্ষার তুলনায় অনেক দ্রুত।
ফলাফল সামগ্রিক (Overall) ও সাবস্কোর (Subscore) – এই ২ ভাগে সরবরাহ করা হয়:
- সামগ্রিক স্কোর: ১০ থেকে ১৬০-এর মধ্যে একটি সংখ্যা থাকে।
- সাবস্কোর: ৪টি বিভাগে বিস্তারিত স্কোর দেখানো হয়:
- কমপ্রিহেনশন: পড়া ও শোনার দক্ষতা।
- কনভারসেশন: শোনা ও কথা বলার দক্ষতা।
- লিটারেসি: পড়া ও লেখার দক্ষতা।
- প্রডাকশন: লেখা ও কথা বলার দক্ষতা।
প্রাপ্ত ডিইটি স্কোর বা গ্রেডের মেয়াদ থাকে ২ বছর।
ডুওলিঙ্গো পরীক্ষার গ্রহণযোগ্যতা কেমন?
ডুওলিঙ্গো ইংলিশ টেস্টের স্কোর বর্তমানে হার্ভার্ড, স্ট্যানফোর্ড, এমআইটি (ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি), ইয়েলসহ পাঁচ হাজারের বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে গৃহীত হয়। আয়ারল্যান্ড তার স্টুডেন্ট ভিসা প্রোগ্রামের অংশ হিসেবেও এই পরীক্ষা গ্রহণ করে। এছাড়া লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস, ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডন, কিংস্টন ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব সাউদাম্পটন ও মিডলসেক্স ইউনিভার্সিটির মতো স্বনামধন্য ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও ডুওলিঙ্গো স্কোর গ্রহণ করে।
সম্পূর্ণ অনলাইনভিত্তিক হওয়ায় এই পরীক্ষায় আলাদা করে ভেন্যু ব্যবস্থাপনার ঝামেলা নেই, এবং ইন্টারনেটভিত্তিক স্কোর ট্র্যাক করাও সহজতর। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অনেক কম প্রচেষ্টায় শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করতে পারে, যা এর জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ।
বাংলাদেশে ডুওলিঙ্গো পরীক্ষায় অংশগ্রহণের উপায় ও প্রস্তুতি
ডিইটি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য কিছু নির্দিষ্ট প্রযুক্তিগত ও পরিবেশগত পূর্বশর্ত পূরণ করা আবশ্যক:
- ১. প্রয়োজনীয় হার্ডওয়্যার: মাইক্রোফোন, স্পিকার ও ক্যামেরাসহ একটি কম্পিউটার প্রয়োজন। ক্যামেরা কম্পিউটার মনিটর বা স্ক্রিনের শীর্ষ ও কেন্দ্রে থাকা উচিত। মাইক্রোফোন ও স্পিকারের আওয়াজের মান ভালো থাকা জরুরি।
- ২. বৈধ পরিচয়পত্র: প্রত্যয়িত ফলাফল পেতে সরকার প্রদত্ত ফটো আইডি প্রয়োজন। বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা বৈধ পাসপোর্ট, জাতীয় স্মার্ট কার্ড বা ড্রাইভিং লাইসেন্সের যেকোনো একটি ব্যবহার করতে পারবেন।
- ৩. নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগ: পরীক্ষার পুরো সময়টি ঝামেলাহীনভাবে সম্পন্ন করার জন্য ইন্টারনেটের গতি ভালো থাকা আবশ্যক। কমপক্ষে ২ এমবিপিএস ডাউনলোড গতি এবং ১ এমবিপিএস আপলোড গতি থাকা আবশ্যক। মোবাইল ডেটার পরিবর্তে তারযুক্ত ইথারনেট বা ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবহার করা উত্তম।
ডিইটি পরীক্ষার নিবন্ধন প্রক্রিয়া:
- প্রথমে englishtest.duolingo.com ওয়েবসাইটে ই-মেইল ঠিকানা দিয়ে একটি অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে।
- হোমপেজ থেকে ‘Purchase the Test’ সেকশনের অধীন ‘Buy Now’ অপশনে ক্লিক করুন।
- পরের পেজে শিক্ষার্থীর নাম ও পরীক্ষার মূল্য পরিশোধের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য নির্ভুলভাবে পূরণ করুন।
- পরীক্ষার ফি বাবদ ৫৯ মার্কিন ডলার বা প্রায় ৬,৪৭১ টাকা (১ মার্কিন ডলার = ১০৯.৬৮ বাংলাদেশি টাকা, বর্তমান বাজার দর অনুযায়ী পরিবর্তিত হতে পারে) অনলাইনে পরিশোধ করতে হবে।
- পরীক্ষা ক্রয়ের পর শিক্ষার্থী পরীক্ষা শুরু করার জন্য সর্বোচ্চ ২১ দিন সময় পাবেন। এছাড়া ৩০ দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ ৩ বার পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবেন।
ডিইটি ডেস্কটপ অ্যাপ ইনস্টলেশন:
নিবন্ধন ও পরীক্ষা ক্রয়ের পরবর্তী কাজ হচ্ছে ডিইটি ডেস্কটপ অ্যাপ ইনস্টল করা। এই অ্যাপ ডাউনলোডের অপশন স্বয়ংক্রিয়ভাবে উন্মুক্ত হয়ে যাবে। অ্যাপটি আকারে ছোট (ম্যাকের জন্য ২৪১ এমবি এবং উইন্ডোজের জন্য ৪৯ এমবি)। অ্যাপটি ইনস্টল হয়ে গেলে পরীক্ষার জন্য যাবতীয় প্রস্তুতি শেষ।
ডুওলিঙ্গো পরীক্ষার সময় কিছু সতর্কতা:
- পরীক্ষা দেওয়ার সময় প্রার্থীর নাম অবশ্যই পরিচয়পত্রের সঙ্গে হুবহু মিল থাকতে হবে।
- পরীক্ষার স্থানটি হতে হবে একদম শান্ত, যথেষ্ট আলো থাকতে হবে এবং কক্ষে পরীক্ষার্থী একা থাকবেন।
- ক্যামেরায় পরীক্ষার্থীর মুখমণ্ডল ও কান স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হতে হবে। ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে মাথা আবৃত থাকতে পারে।
- হেডফোন বা ইয়ারফোন ব্যবহার করা যাবে না।
- মোবাইল ডিভাইস, নোট, পাঠ্যপুস্তক ও বাইরের কোনো লেখা বা পড়ার উপকরণ সঙ্গে রাখার অনুমতি নেই।
- প্রেডিক্টিভ টেক্সট মেথড (যেমন: গুগল সার্চ ইঞ্জিনে টাইপ করার সময় সাজেশন আসা) ব্যবহার করা নিষেধ।
- চোখ সম্পূর্ণভাবে কম্পিউটার স্ক্রিনে নিবদ্ধ রাখতে হবে।
- কোনোভাবেই কিছু সময়ের জন্য হলেও কম্পিউটার ছেড়ে ওঠা যাবে না।
- অ্যাপ ব্যাকগ্রাউন্ডে চালিয়ে কম্পিউটারে অন্য কোনো কিছু চালু করা যাবে না। এমনকি পরীক্ষার উইন্ডোর পাশে নতুন ট্যাব বা নতুন উইন্ডো ওপেন করা যাবে না।
- শুধু একটি মনিটরই ব্যবহার করতে হবে। দুটি স্ক্রিন ব্যবহার গ্রহণযোগ্য নয়।
সম্পূর্ণ অনলাইনভিত্তিক হওয়ায় ডুওলিঙ্গো ইংলিশ টেস্ট প্রযুক্তিনির্ভর প্রজন্মের জন্য বেশ সহায়ক। ৩০ দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ ৩ বার পরীক্ষার সুযোগ, ২ বছরের ফলাফলের মেয়াদ এবং ১ ঘণ্টার তুলনামূলক কম সময়ের পরীক্ষা এটিকে শিক্ষার্থীদের কাছে দ্রুত জনপ্রিয় করে তুলেছে। তবে, পরীক্ষার সময় প্রয়োজনীয় কারিগরি ব্যবস্থা এবং মানসিক প্রস্তুতি থাকাটাও জরুরি।
তথ্যসূত্র:
- ডুওলিঙ্গো ইংলিশ টেস্টের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট (englishtest.duolingo.com)
- এমডি সাব্বির (ডুওলিঙ্গো স্কোর ১৩৫) - ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও পরামর্শ।
সাব্বির