
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ফাইন্যান্স বিভাগের এক শিক্ষকের চেম্বারে নারী শিক্ষার্থী ‘আটকের’ ঘটনায় সমন্বয়ক-সাংবাদিকসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ এসেছে । আজ বেলা ১১ টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন মার্কেটের আমতলা চত্বরে এক সংবাদ সম্মেলনে এবং গতকাল শুক্রবার নগরের মতিহার থানায় লিখিত অভিযোগে এ দাবি করেন ওই নারী শিক্ষার্থী। অপরদিকে একই জায়গায় আজ দুপুর ১২টায় পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন অভিযুক্ত দুই সাংবাদিক।
অভিযোগকারী শিক্ষার্থী হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের ২০১৮-১৯ বর্ষের শিক্ষার্থী মারিয়া খাতুন। অন্যদিকে অভিযুক্তরা হলেন, আইন বিভাগের ২০১৭-১৮ বর্ষের শিক্ষার্থী নাজমুস সাকিব, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সমন্বয়ক মো. আতাউল্লাহ, বিশ্ববিদ্যালয়ের খবরের কাগজের প্রতিনিধি সিরাজুল ইসলাম সুমন এবং কালবেলার প্রতিনিধি সাজ্জাদ হোসেন সজীব।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত ১১ মে সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একাডেমিক ভবনে ফাইনান্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. হেদায়েত উল্লাহর চেম্বারে অনৈতিক সম্পর্কের অভিযোগে ওই নারী শিক্ষার্থীকে আটক করে অভিযুক্তরা। গত ১৪ মে ওই ঘটনার একটি ৭ সেকেন্ডের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। বিষয়টির নিন্দা জানিয়ে ওই বিভাগের শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন করেন এবং দুজনকে শাস্তির দাবি জানান। এ ঘটনায় গতকাল শুক্রবার দুপুরে বিভাগের একাডেমিক কমিটি তদন্ত চলাকালীন উভয়কে একাডেমিক কার্যক্রম থেকে বিরত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। পরে ওইদিন বিকেলে তিন লাখ টাকা চাঁদা আদায়সহ হেনস্তা করার অভিযোগ তুলে নগরের মতিহার থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন ওই নারী শিক্ষার্থী। এরপরিপ্রেক্ষিতে আজ পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলন করেন উভয়পক্ষ।
ওই নারী শিক্ষার্থী সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আমি একটা টিউটোরিয়াল পরীক্ষার কিছু পড়াশোনা বুঝে নেওয়ার জন্য গত ১১ তারিখ বিকেলে স্যারের কক্ষে যাই। স্যারের কক্ষে প্রবেশ করার কিছু সময় পরেই উনারা চারজন স্যারের কক্ষে প্রবেশ করেই আমার গায় হাত তোলে এবং শরীর থেকে ওড়না পড়ে যায়। এতে আমি বিব্রত হয়ে পড়ি এবং টেবিলের আড়ালে লুকিয়ে পড়ি। তবুও তারা আমাকে হত্যা, ধর্ষণসহ বিভিন্নভাবে হুমকি দেয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই ঘটনায় তাদের হুমকিতে স্যার তাদের জিজ্ঞাসা করে ‘বসো আমরা আলোচনা করি।’ তখন তারা এই ঘটনা আড়াল করতে ৫ লাখ টাকা দাবি করে। তবে স্যার এত টাকা এক সঙ্গে দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে তারা হুমকি-ধামকি চালিয়ে যায়। একপর্যায়ে ওই দিন রাতেই স্যার তাদের এক লাখ টাকা এটিএম থেকে তুলে এবং নিজের মানিব্যাগ থেকে আড়াই হাজার টাকা দেন। এর পরদিন সুমন এবং সাকিব এসে আরও দুই লাখ টাকা নেয়। এ ঘটনায় আগামী ১৮ মে তাদের আরও ২ লাখ টাকা দেওয়ার কথা ছিল।’
ঘটনায় জড়িতদের শাস্তির দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এতগুলো টাকা নেওয়ার পরেও বিকৃতভাবে আমার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এ সকল ঘটনায় আমি একবার আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছি। তবে সে জায়গা থেকে ফিরে এসে আমি আইনের আশ্রয় নিতে থানায় একটি অভিযোগ করেছি। এ ঘটনায় জড়িত সকলের আমি বিচার চাই।’
দুই সাংবাদিকের সংবাদ সম্মেলন
অন্যদিকে এ ঘটনায় চাঁদাবাজির অভিযোগ অস্বীকার করে সংবাদ সম্মেলনে তাঁদের অবস্থান তুলে ধরেছেন দুই সাংবাদিক। লিখিত বক্তব্যে কালবেলার সাংবাদিক সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘গত ১১ মে সন্ধ্যার দিকে আমরা একজন স্যারের সূত্রে জানতে পারি, হেদায়েত উল্লাহ স্যার তার চেম্বারে এক ছাত্রীসহ অবস্থান করছেন। এতে আমরা প্রক্টর স্যারের অনুমতিক্রমে সেখানে গিয়ে দেখি কক্ষের লাইট বন্ধ। পরে আমরা দরজায় নক করলে কিছুক্ষণ পর স্যার নিজেই দরজা খুলে দেন। কক্ষের ভেতর আমরা স্যারের সঙ্গে কথা বলার সময় দেখি, টেবিলের নিচে ওই নারী শিক্ষার্থীকে লুকিয়ে আছেন।’
সাজ্জাদ হোসেন আরও বলেন, ‘পরে স্যার নিজেই ছাত্রীকে টেবিলের নিচ থেকে বের করে আনেন। এ সময় ওই শিক্ষার্থী সংবাদ প্রকাশিত হলে তিনি ‘আত্মহত্যা’ করবেন এমন হুমকি দেন। এতে তাৎক্ষণিকভাবে আমরা প্রক্টর স্যারকে কল করি বিষয়টি জানানোর জন্য। তবে হেদায়েত উল্লাহ স্যারের অনুরোধে আমরা প্রক্টর স্যারকে বিস্তারিত বলিনি। এ ঘটনায় শিক্ষার্থীর নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করে ভিডিও বা সংবাদ প্রকাশ করা হয়নি। পরবর্তীতে বিষয়টি আমরা উপাচার্য স্যারকে জানাই এবং উপাচার্য আমাদের একটি লিখিত অভিযোগ লিখিত অভিযোগ জমা দিতে বলেন।’
চাঁদাবাজির অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যে একটি অজ্ঞাত সোর্সের মাধ্যমে ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর আমরা লক্ষ্য করি, উক্ত শিক্ষক ও ছাত্রী কর্তৃক আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তোলা হয়েছে। সেখানে আমাদের বিরুদ্ধে আর্থিক লেনদেনের মতো গুরুতর গুজব ছড়ানো হয়েছে। আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই, আমাদের সঙ্গে ওই শিক্ষক বা শিক্ষার্থীর কোনো ধরনের আর্থিক লেনদেন হয়নি। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল কেবলমাত্র একটি অনৈতিক ঘটনার যথাযথ প্রতিবাদ ও প্রশাসনকে অবহিত করা।’
এ ব্যাপারে ফাইন্যান্স বিভাগের শিক্ষক হেদায়েত উল্লাহ বলেন, ‘আমি গত কয়েকদিন যাবৎ শুনেছি, কোনো একজন শিক্ষক আমার বিরুদ্ধে লেগেছেন। তবে একাডেমিক ব্যস্ততা থাকায় আমি বিষয়টি খোঁজ নিতে পারিনি। সেদিন ওই শিক্ষার্থী আমার কাছে পড়া বুঝতে আসলে হঠাৎ তারা চারজন আমার চেম্বারে ঢুকে আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করে। একপর্যায়ে ঘটনা আড়াল করতে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। ইতোমধ্যে আমার থেকে তিন লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তারা আমার ও ওই নারী শিক্ষার্থীর ভবিষ্যত নষ্ট করার চেষ্টা করছে।’
ঘটনা সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীব বলেন, ‘আমার কাছে এক শিক্ষকের সঙ্গে দুই ছাত্র এসেছিলেন। তবে তারা সাংবাদিক কিনা আমি বলতে পারব না। তারা যে অভিযোগ দিয়েছিলেন, তা পূর্ণাঙ্গ ছিল না। এজন্য আমি একটি লিখিত অভিযোগ দিতে বলেছি। সার্বিক বিষয়ে বিভাগে একটি তদন্ত কমিটি হয়েছে। সেই কমিটি এবং পুলিশ প্রশাসন ঘটনাটি খতিয়ে দেখবেন।’
রাজু