ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০৯ জুন ২০২৫, ২৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ক্যারিয়ার হিসাবে ভেটেরিনারি চিকিৎসক

মো. লিখন ইসলাম

প্রকাশিত: ০০:৩১, ২০ আগস্ট ২০২৩

ক্যারিয়ার হিসাবে ভেটেরিনারি চিকিৎসক

একজন ভেটেরিনারিয়ানের শিক্ষার হাতেখড়ি

তীব্র ব্যথায় জর্জরিত, নীরবে সয়ে যাওয়া অব্যক্ত কষ্টে কাতর প্রাণীকুলের সেবার ব্রত নিয়েই শুরু হয় একজন ভেটেরিনারিয়ানের শিক্ষার হাতেখড়ি। প্রাণী চিকিৎসকরাই সাধারণত ভেটেরিনারিয়ান হিসেবে পরিচিত। সমগ্র প্রাণী জগতের চিকিৎসক বলা হয়ে থাকে একজন ভেটেরিনারিয়ানকে। একজন প্রাণী চিকিৎসকের প্রধান কাজ প্রাণীর রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা, রোগের প্রাদুর্ভাব রোধ এবং ক্ষেত্র বিশেষে সার্জারি করা। এছাড়া প্রাণী চিকিৎসকরা বিভিন্ন রোগতত্ত্ব গবেষণা, প্রাণীর নতুন জাত উদ্ভাবন ও জাত উন্নয়ন, উৎপাদন বৃদ্ধি যেমন দুগ্ধ উৎপাদন, ডিম উৎপাদনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। এনথ্রাক্স, র‌্যাবিস, নিপাহ ভাইরাস, ব্রসলেওসিস, বার্ডফ্লু প্রভৃতির মতো ভয়াবহ জুওনোটিক (যা প্রাণী থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়) রোগের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ও রোধ এবং চিকিৎসা দিয়ে থাকেন একজন ভেটেরিনারিয়ান। একটি দেশের পুষ্টি বিশেষ করে প্রোটিন বা আমিষের চাহিদার সঙ্গে প্রাপ্যতার ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করেন প্রাণী চিকিৎসকরাই। 
সৃষ্টির উষালগ্নে সেই আদিকাল হতে আদিম বনবাসী বা গুহাবাসী মানুষ সভ্যতার আলো দেখেছিল পশুপাখির হাত ধরে। যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী, বছরের পর বছর মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজনে যেমন যাতায়াত ও যোগাযোগ, অর্থনৈতিক নির্ভরতা, খাদ্যে নির্ভরতা, সৌন্দর্যচর্চা, একাকিত্বের সঙ্গী, পাহারাদারি, অব্যর্থ গোয়েন্দাগিরি ইত্যাদিতে পশুপাখি ব্যবহৃত হচ্ছে। তাই কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অগ্রগতির জন্য সবার আগে প্রয়োজন এই প্রাণিসম্পদ সেক্টরে বিপ্লব আর এজন্য প্রয়োজন দক্ষ ভেটেরিনারিয়ান। এই গুরুত্বপূর্ণ ভেটেরিনারি শিক্ষা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা না থাকায় শিক্ষার্থী এমনকি অভিভাবকরাও ক্যারিয়ার গঠনে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়।
উপমহাদেশে ভেটেরিনারি পেশার ইতিহাস : ভেটেরিনারি পেশা অনেক পুরনো একটা পেশা। কর্নেল জে.এইস.বি হ্যালেনের প্রচেষ্টায় ১৮৬২ সালে ভারতবর্ষের পুনেতে সর্বপ্রথম সামরিক ভেটেরিনারি হাসপাতাল স্থাপন করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ১৮৮২ সালে লাহোরে, ১৮৮৬ সালে বোম্বে এবং ১৮৯৩ সালে কলকাতা ও মাদ্রাজে ভেটেরিনারি কলেজ স্থাপন করা হয় যেখানে ৩ বছর মেয়াদি ভেটেরিনারি কোর্স (ডিপ্লোমা ইন ভেটেরিনারি সায়েন্স) প্রদান করা হতো। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগ হওয়ার পর বর্তমান বাংলাদেশ (তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান) এর কুমিল্লায় ওই বছরের ৭ ডিসেম্বর একটি ভেটেরিনারি কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়। যার নাম ইস্ট পাকিস্তান কলেজ অব ভেটেরিনারি সায়েন্স অ্যান্ড অ্যানিমেল হাজবেন্ড্রি। যেখানে ৩ বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইন ভেটেরিনারি মেডিসিন অ্যান্ড সার্জারি (ডিভিএমএস) নামে ডিগ্রি দেওয়া হতো। এই কলেজ পরবর্তীতে তেজগাঁও ঢাকা থেকে ১৯৫৫ সালের কাছাকাছি সময়ে ময়মনসিংহে স্থানান্তর করা হয়। 
পরবর্তীতে ১৯৬১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় শিক্ষা কমিশন এবং খাদ্য ও কৃষি কমিশনের যৌথ সুপারিশের ভিত্তিতে ময়মনসিংহস্থ ইস্ট পাকিস্তান কলেজ অব ভেটেরিনারি সায়েন্স অ্যান্ড এনিমেল হাজবেন্ড্রিকে কেন্দ্র করে ইস্ট পাকিস্তান কৃষি বিশ^বিদ্যালয় (বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষি বিশ^বিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৬৩ সালে বি.এস.সি ( ভেট সায়েন্স অ্যান্ড এ. এইচ ) ডিগ্রিকে ডিভিএম (ডক্টর অব ভেটেরিনারি মেডিসিন ) এবং বি.এস.সি ইন (এ. এইচ) নামক দুটি পুথক ডিগ্রি দেওয়া শুরু করে।
ভেটেরিনারি ডিগ্রি প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান : বাংলাদেশে একটি বিশেষায়িত ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়সহ মোট ১১টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। যেখানে ভেটেরিনারি মেডিসিনে ¯œাতক, ¯œাতকোত্তর ও পিএইচডি ডিগ্রি গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। এগুলো হলোÑ 

১. বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ। 
২. শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা। 
৩. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর। 
৪. চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম (বিশেষায়িত)। 
৫. সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট। 
৬. খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা। 
৭. হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, হবিগঞ্জ। 
৮. পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী। 
৯. হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর। 
১০. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ। 
১১. রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী। 
ভেটেরিনারি কলেজ
১. ঝিনাইদহ ভেটেরিনারি কলেজ, ঝিনাইদহ। (যা বর্তমানে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষদভুক্ত করা হয়েছে। 
২. সিরাজগঞ্জ ভেটেরিনারি কলেজ, সিরাজগঞ্জ। (যা বর্তমানে মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষদভুক্ত করা হয়েছে) এছাড়াও দেশের একমাত্র বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গণবিশ্ববিদ্যালয়, সাভারে ভেটেরিনারি শিক্ষা কার্যক্রম চালু রয়েছে। 
কি কি পড়ানো হয় : একজন ভেটেরিনারি ডাক্তার হতে হলে তাকে অধ্যয়ন করতে হয় এনাটমি, হিস্টোলজি, অ্যানিমাল সায়েন্স, নিউট্রিশন, পোল্ট্রি সায়েন্স, ডেইরি সায়েন্স, ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, ফার্মাকোলজি, টক্সিকোলজি, প্যাথলজি, প্যারাসাইটোলজি, মাইক্রোবায়োলজি, ব্যাক্টেরিওলজি, ভাইরোলজি, সেরোলজি, অ্যানিমাল জেনেটিক্স ও ব্রিডিং, মেডিসিন, সার্জারি, ভেটেরিনারি এপিডিমিওলজি, গাইনিকোলজি ও অবস্ট্রাট্রিক্স, থ্রেরিওজেনোলজি, রেডিওলজি, অপারেটিভ সার্জারি, পরিসংখ্যান, গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান, কৃষি অর্থনীতি, মার্কেটিং, কৃষি সম্প্রসারণ বিদ্যা, ভেটেরিনারি পাবলিক হেলথসহ প্রভৃতি বিষয় ।
ক্যারিয়ার ও চাকরি : কারিকুলামের অংশ হিসেবে ভেটেরিনারি শিক্ষার্থীদের ৬ মাস ( চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমাল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে ১ বছর) ইন্টার্নি করতে হয়। (ইন্টার্নি ভাতা মাসিক প্রায় ১৮,০০০ টাকা)। ভেটেরিনারি পড়াশোনার শেষ বছরে কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশের বাইরে ইন্টার্নশিপের সুযোগ রয়েছে, যা ছাত্র-ছাত্রীদের ভবিষ্যৎ জীবন উন্নয়নে অনেক ভূমিকা রাখে। ভেটেরিনারি পাস করার পর নিজস্ব বিষয়সহ যেকোনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাইক্রোবায়োলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, ফার্মেসিসহ অন্য বিষয়গুলোতে শিক্ষকতা ও উচ্চশিক্ষার সুযোগ রয়েছে।  

বিসিএস (বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস) এ ভেটেরিনারি গ্র্যাজুয়েটদের জন্য স্পেশাল ক্যাডার (ভেটেরিনারি সার্জন)। এছাড়া বিসিএস এ ভেটরা অনান্য ক্যাডারেও প্রতিযোগিতা করতে পারবে। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান যেমন ইন্টার ন্যাশনাল সেন্টার ফর ডাইরিয়াল ডিজিজ রিসার্চ সেন্টার, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি), বাংলাদেশ লাইভস্টক রিসার্চ ইনস্টিটিউট (বিএলআরআই), প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান (এলআরআই), বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (এফআরআই)গুলোতে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করার ও বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ রয়েছে। দেশের বাইরে বিভিন্ন দেশে যেমন অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, জাপান, কানাডা, ফিনল্যান্ড, আমেরিকাসহ উন্নত দেশগুলোতে সম্মানজনক চাকরির সুযোগ রয়েছে। 
এছাড়াও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিন, পাবলিকেশন, সংস্থা এবং মিডিয়া যেমন ইউনেস্কো, ইউনিসেফ, বিশ^ স্বাস্থ সংস্থা, বিশ^ খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ফাও), অ্যানিমাল প্লানেট, ডিসকভারি, ন্যাশনল জিওগ্রাফি ইত্যাদিতে মোটা বেতনের চাকরির সুযোগ রয়েছে। একজন ভেটেরিনারিয়ানের পেট হাসপাতালে প্রাইভেট প্র্যাকটিস, ফার্ম ব্যবসা ও ল্যাবরেটরি ভ্যাকসিনে কাজ করার সুযোগও রয়েছে।
এছাড়া বিভিন্ন ফার্মাসিউটিকাল কোম্পানিতে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ভেটেরিনারিয়ানদের জন্য রয়েছে নির্দিষ্ট কোর যার নাম রিমাউন্ট ভেটেরিনারি অ্যান্ড ফার্ম কোর ( আরভি অ্যান্ড এফসি) যেখানে একজন ভেটেরিনারিয়ান নির্দিষ্ট প্রশিক্ষণ শেষে লেফটেন্যান্ট হিসেবে যোগ দিতে পারবেন। বর্তমানে স্মার্ট কৃষি বিপ্লবের যুগে পেশা হিসেবে ভেটেরিনারি চিকিৎসক পছন্দ করা একটি যুগোপযোগী এবং স্মার্ট সিদ্ধান্ত। একজন দক্ষ ভেটেরিনারিয়ানই কেবল দেশের প্রাণিসম্পদ এবং মানুষের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটিয়ে সমৃদ্ধশালী, সুস্থবান জাতি ও দেশ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন।

×