ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৮ মে ২০২৫, ১৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

টুটুল মাহফুজ

জানতে হবে বিশদ বিদেশে উচ্চশিক্ষা

প্রকাশিত: ০০:০৮, ১৫ মে ২০২২

জানতে হবে বিশদ বিদেশে উচ্চশিক্ষা

উচ্চমাধ্যমিকের বা এইচএসসির পরই আসলে বাইরে পড়াশোনা করতে যাবার মোক্ষম সময়। তাছাড়া স্নাতক লেভেলে সব জায়গা থেকেই স্কলারশিপ পাওয়ার সুযোগ থাকে। উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা ও জীবনযাত্রা, গবেষণা ও চাকরির ভাল ক্ষেত্র থাকার কারণে অনেকেই বিদেশের দিকে ঝুঁকছেন। এইচএসসির পর বিদেশে পড়তে গেলে অনেক বিষয় সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে ভাবতে শেখা এবং স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতে শেখার ফলে শিক্ষার্থীরা অন্যদের তুলনায় অধিক দক্ষভাবে চিন্তা ও কাজ করতে শেখে। তাই দেখা যায়, বিদেশে থাকার অভিজ্ঞতা কখনও কখনও ব্যক্তির সামগ্রিক জীবনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। যারা বিদেশে থেকে পড়াশোনা করেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা অন্যদের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি স্বাধীনচেতা ও আত্মনির্ভরশীল হয়ে থাকেন এবং বুদ্ধিমত্তা ও সৃজনশীলতার দিক থেকে অনেক এগিয়ে থাকেন। বিদেশে থাকার অভিজ্ঞতা অনেক মূল্যবান, যদি দেশে এসে সেই অর্জিত জ্ঞান আপনি সঠিক জায়গায় কাজে লাগাতে পারেন। এইচএসসির পর বিদেশে স্নাতক করতে হলে আগে থেকে পরিকল্পনা করা জরুরী। অন্তত মাস ছয়েক আগে থেকেই সেই পরিকল্পনা শুরু করতে হবে। কারণ নিজের আর্থিক সামর্থ্য বুঝে শহর ও বিশ্ববিদ্যালয় বাছাই করার মতো বড় সিদ্ধান্ত একটু বুঝে শুনে নেওয়া উচিত। যেভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে : ‘কিভাবে নিজেকে প্রস্তুত করতে পারি’- বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্রে সবার আগে এই চিন্তাটাই মাথায় আসে। চলুন তাহলে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করা যাক। টার্গেট ঠিক রাখা : অমুক এইচএসসির পর বিদেশে পড়তে যাচ্ছে দেখে আপনারও যেতে হবে, ব্যাপারটা এমন না। জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে আমরা অনেকেই বাইরে যেতে চাই। কিন্তু এটা যেহেতু জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত, সেহেতু এটা নিতে হবে অনেক ভেবেচিন্তে। আপনার বয়স, শিক্ষাগত যোগ্যতা, অর্থ, পরিবারের সম্মতিসহ সবকিছুই বিবেচনায় রাখতে হবে। ভাল ফল : যদিও মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট সব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রয়োজন হয় না, তবুও ভাল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে চাইলে ভাল ফল করাটা জরুরী। আপনি যে প্রোগ্রাম বা কোর্সের জন্যই বিদেশে যান না কেন, আপনার রেজাল্ট যত ভাল হবে, বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আপনার ভর্তি এবং স্কলারশিপের সুযোগ তত বেশি হবে। সহশিক্ষা কার্যক্রম : ইসিএ বা এক্সট্রা কারিকুলার এ্যাক্টিভিটিস আপনার আবেদনপত্রে প্লাস পয়েন্ট হিসেবে কাজ করে। একজন শিক্ষার্থীর পড়াশোনার পাশাপাশি নাচ, গান, আবৃত্তি, খেলাধুলা, স্বেচ্ছাসেবা, লেখালেখি, রান্না, বিতর্ক, ফটোগ্রাফি, অলিম্পিয়াডের মতো বিভিন্ন বিষয়ে আগ্রহী হতে পারে। আর এই আগ্রহ থাকার ব্যাপারটি শুধু বললেই হবে না, দেখাতে হবে নিজের আবেদনপত্রে বিভিন্ন রচনার মাধ্যমে, শিক্ষকদের সুপারিশপত্র এবং সাক্ষাতকারে জীবনের ছোট ছোট গল্পের মধ্য দিয়ে। ভাষাগত দক্ষতা : বেশিরভাগ দেশে ইংরেজী ভাষা প্রচলিত হওয়ায় ওঊখঞঝ কিংবা ঞঙঋঊখ -এ ভাল স্কোর থাকতে হবে। এসব স্কোরের মেয়াদ থাকে দুই বছর। যুক্তরাষ্ট্রে যারা ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদে স্নাতকোত্তর করতে ইচ্ছুক, তাদের জন্য প্রয়োজন এজঊ (এৎধফঁধঃব জবপড়ৎফ ঊীধসরহধঃরড়হ)। আর যারা ব্যবসা অথবা মানবিক বিষয়ে পড়তে ইচ্ছুক তাদের জন্য আছে এগঅঞ (এৎধফঁধঃব গধহধমবসবহঃ অফসরংংরড়হ ঞবংঃ)। আর যারা উচ্চমাধ্যমিক পাস করে বিদেশে যেতে চান অথবা বিদেশে কোন কলেজে ভর্তি হতে চান, তারা ঝঅঞ (ঝপযড়ষধংঃরপ অঢ়ঃরঃঁফব ঞবংঃ) দিয়ে থাকেন। ইউরোপীয় দেশগুলোতে সাধারণত আমেরিকাভিত্তিক এজঊ বা এগঅঞ প্রয়োজন হয় না। এজঊ/ এগঅঞ এর মেয়াদ ৫ বছর থাকে। তবে যারা ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াশোনা করেন তারা ওঊখঞঝ স্কোর ছাড়াও বিদেশে পড়াশোনা করার সুযোগ পেতে পারেন, যেহেতু তাদের পড়াশোনার মাধ্যম বা গবফরঁস ড়ভ ওহংঃৎঁপঃরড়হ হলো ইংরেজী। বাইরের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় গবফরঁস ড়ভ ওহংঃৎঁপঃরড়হ কে ওঊখঞঝ বা ঞঙঊঋখ এর সমতুল্য হিসেবে গ্রহণ করে। সাধারণত বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সাম কন্ট্রোলার থেকে এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রি দফতর থেকে এই সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে হয়। চীন, জাপান, জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়া, ফ্রান্স ইত্যাদি দেশে যেতে চাইলে এসব দেশের ভাষা আগেভাগেই শিখে নেওয়াটা ভাল। ভাষা জানা থাকলে এসব দেশগুলোতে বৃত্তি পাওয়াটা যেমন সহজ হয়, তেমন পার্টটাইম কাজের ক্ষেত্রেও এই ভাষার দক্ষতা উপকারে আসে। প্রোগ্রাম নির্ধারণ : কোর্স বা প্রোগ্রাম নির্ধারণের সময় বেশ কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে। আপনি কোন বিষয়ে পড়তে চান, বিশ্ব প্রেক্ষাপটে কোনটার চাহিদা বেশি, দেশীয় চাকরি বাজারে কী ভাল হবে, কী পড়লে সহজেই পেশাগত উন্নতি ও লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব, আপনি যেই দেশে পড়তে যেতে আগ্রহী সেই দেশে আপনার পছন্দের বিষয়ে উচ্চশিক্ষার মান বা পদ্ধতি বিশ্বে কতটুকু গ্রহণযোগ্য বা কতটুকু সময়োপযোগী, ভবিষ্যতের পেশাগত জীবন, কোর্সটিতে পড়াশোনা শেষে কোথায় কর্মক্ষেত্র গড়ে তুলবেন, সেখানের সুযোগ-সুবিধা, সম্ভাবনা ও অসুবিধা বা প্রতিবন্ধকতার মাত্রা কতটুকু, আপনার বর্তমান যোগ্যতার সাপেক্ষে কোন কোর্সটি আপনার জন্য সবচেয়ে বেশি উপযোগী, এই কোর্সের কোন বিকল্প কোর্স আছে কি না, মেয়াদ ও টিউশন ফি কত, মূলত এসব বিষয়েই চোখ রাখতে হবে। এই প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর পাওয়ার জন্য আপনি উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তথ্য ও পরামর্শকেন্দ্রের সঙ্গে অথবা ওই কোর্সে পড়াশোনা করেছেন বা করছেন এমন কোন শিক্ষার্থীর সঙ্গে পরিচয় থাকলে আগে থেকেই আলাপ করে নিতে পারেন। ক্রেডিট ট্রান্সফার : দেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন একটি কোর্সে কিছুদিন পড়াশোনা করেছেন বা করছেন। এখন আপনি ওই কোর্সই বিদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আগ্রহী। সেই ক্ষেত্রে দেশে করা কোর্সটির ক্রেডিট গ্রহণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে অব্যাহতি পত্র দাবি করতে পারেন। আপনার কোর্সটির জন্য কতটুকু ক্রেডিট পাবেন তা নির্ধারণ করবে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ। এরজন্য যা যা লাগবে: - একাডেমিক সার্টিফিকেট, ট্রান্সক্রিপ্ট, প্রত্যয়নপত্র। - কোর্সের আউটলাইন ও পাঠ্যতালিকা। - কোর্স লেভেল সম্পর্কিত তথ্যাদি। - কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় অনুষদ কর্তৃক সুপারিশনামা। - কোর্স এ্যাসেসমেন্টের পদ্ধতি। - গ্রেডিং সিস্টেম সংক্রান্ত তথ্য। - কোর্সের মেয়াদ, লেকচার-ঘণ্টা, ল্যাবরেটরিতে কাজের ঘণ্টা, ফিল্ডওয়ার্ক ইত্যাদি। - পরীক্ষা, রচনা, প্রজেক্ট ওয়ার্ক ইত্যাদি। আবেদন প্রক্রিয়া : সব কাজ ঠিকঠাক হয়ে গেলে এবার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আবেদন করার পালা। একেক বিশ্ববিদ্যালয়ে একেক সময়ে সেশন শুরু হয়, তাই তাদের ভর্তি শুরুর সময় মনে রাখতে হবে এবং সেই অনুযায়ী আবেদন করতে হবে। স্টেটমেন্ট অব পারপাস (ঝঙচ- ঝঃধঃবসবহঃ ড়ভ চঁৎঢ়ড়ংব) : এইচএসসির পর বাইরে পড়তে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের যেসব বিষয় নিয়ে বেশি চিন্তা করতে হবে তার মধ্যে এসওপি বা স্টেটমেন্ট অব পারপাস অন্যতম। ঝঙচ হলো আপনার ব্যক্তিগত গল্প। এখানে সেই বিষয়টি কেন পড়তে চাচ্ছেন, পূর্ব অভিজ্ঞতা কী, গ্র্যাজুয়েশন শেষে দেশে ফিরে এসে কী করবেন, অন্য দশজনকে বাদ দিয়ে আপনাকে কেন নেওয়া উচিত- ইত্যাদি বিষয়গুলো ধারাবাহিকভাবে গল্পের মতো করে লিখতে হবে। আপনি মানুষ হিসেবে কেমন, উচ্চশিক্ষার চাপ সামলাতে আপনি কতটুকু প্রস্তুত আছেন, আপনার ব্যাকগ্রাউন্ড, প্রতিভা, অভিজ্ঞতা ও সক্ষমতার একটা প্রতিচ্ছবি এ্যাডমিশন কমিটি এই এসওপি থেকে জেনে নেয়। মিথ্যের আশ্রয় না নিয়ে আপনি যেমন, ঠিক তেমন করেই প্রাসঙ্গিক ও প্রেরণামূলকভাবে নিজেকে নিয়ে ও নিজের ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে লিখবেন। যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয় বাছাই করতে হবে : প্রথমেই যে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে, তা হলো দেশ নির্বাচন। অর্থাৎ আপনি কোন দেশের কোন শহরে যাবেন। আপনাকে জানতে হবে কোন দেশগুলো উচ্চশিক্ষার মানের দিক থেকে এগিয়ে আছে। বর্তমানে শিক্ষার গুণগতমান বিচারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, মালয়েশিয়া, জাপান এগিয়ে আছে। তবে এই দেশগুলোর মধ্যে যেকোন একটি বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে আপনাকে যথেষ্ট চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। কারণ একেকটি দেশের পড়াশোনার ধরন, টিউশন ফি, থাকা-খাওয়ার খরচ ও ভর্তি চাহিদায় পার্থক্য আছে। আপনার বাজেট, আগ্রহ ও যোগ্যতার সাথে সব দিক থেকে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে যে দেশটি, সেটিকেই বেছে নিতে হবে। দেশ নির্বাচনের পরবর্তী ধাপ হলো বিষয় নির্বাচন। বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমন অনেক বিষয়ে পড়াশোনার সুযোগ রয়েছে যেগুলো দেশে নেই। ফলে আপনাকে এমন একটা বিষয় বেছে নিতে হবে যেটির প্রতি আপনার আগ্রহ রয়েছে, ভাল করার সামর্থ্য রয়েছে এবং বিষয়টিতে পড়াশোনা করে পরবর্তীতে ভাল কোন চাকরির সুযোগও রয়েছে। ঝোঁকের মাথায় কোন বিষয় পছন্দ করলে চলবে না। এরপর আসে বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন। উন্নত দেশে পেছনের সারির ইউনিভার্সিটি যেমন রয়েছে, তেমনি তুলনামূলকভাবে একটু কম উন্নত দেশে আছে প্রথম সারির ইউনিভার্সিটি। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে টিউশন ফির তারতম্য আছে। অনেক দেশে ফুল ফ্রি স্কলারশিপের ব্যবস্থা প্রচলিত নেই। তাই শিক্ষার গুণগতমান, পরিবেশ, বৈশ্বিক র‌্যাংকিং, টিউশন ফি, বৃত্তি সুবিধা, কোর্সের মেয়াদ, পার্ট-টাইম চাকরির সুযোগ, নাগরিকত্ব, জীবনমান, আবাসন ব্যবস্থা, বিদেশী শিক্ষার্থীর সংখ্যা, আবহাওয়া ইত্যাদি বিষয় পর্যবেক্ষণ করেই আপনাকে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে। এগুলো দেখার একটা সহজ উপায় হলো যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে আপনি ইচ্ছুক, সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ওয়েবসাইট ঘাঁটা। ধৈর্য ধরে সব নোট নিতে হবে।
×