ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৭ জুন ২০২৫, ১৩ আষাঢ় ১৪৩২

অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনাময় খাত: বাঁশ

নিজস্ব সংবাদদাতা, ফটিকছড়ি

প্রকাশিত: ১১:৩৩, ২৭ জুন ২০২৫

অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনাময় খাত: বাঁশ

ছবি: সংগৃহীত

আমাদের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কাজে লাগে বাঁশ। বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলেই বাঁশ পাওয়া যায়। অতি প্রয়োজনীয় এই বাঁশ বাড়ির আশপাশে বা পেছনের জঙ্গলে বড় অযত্ন আর অবহেলায় বেড়ে ওঠে। দুর্যোগ প্রতিরোধী, জলবায়ুসহিষ্ণু, ভূমিক্ষয় রোধী এবং পরিবেশের বন্ধু হিসেবে পরিচিত এই বাঁশ দিন দিন অনেক কমে যাচ্ছে। এতে বাঁশ-বেত দিয়ে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী কুটিরশিল্পের উৎপাদনও কমছে। অথচ এই বাঁশ শিল্পের রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা।

অবহেলায় বেড়ে ওঠা বাঁশের প্রতি একটু নজর দিলে এ থেকে বছরে কোটি কোটি ডলার আয় হতে পারে। মধ্য আমেরিকার ক্যারিবীয় দ্বীপরাষ্ট্র জ্যামাইকা টেকসই বাঁশ উৎপাদন ও বিপণনের মাধ্যমে করোনায় বিপর্যস্ত তাদের অর্থনীতিকে পুনর্গঠন করতে সক্ষম হয়েছে। কাঠের বিকল্প হিসাবে বাঁশের সজ্জা এবং অন্যান্য সরঞ্জাম তৈরি করে দেশটি ইতোমধ্যে বছরে ১.৫ মিলিয়ন ডলার আয় করছে। আগামী এক দুই বছরের মধ্যে এ আয় তিনগুণ থেকে চারগুণে পৌঁছবে। এছাড়া চীনও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাঁশ ও বাঁশজাত পণ্য রফতানি করে বিপুল অর্থ আয় করছে। বাঁশের ফার্নিচার ও আসবাবপত্র পরিবেশবান্ধব।

বাংলাদেশে বাঁশের তৈরি নিত্যব্যবহার্য বিভিন্ন হস্তশিল্প বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি হচ্ছে। উত্তরা ইপিজেডে তৈরি হচ্ছে বাঁশের কফিন, যা রফতানি হচ্ছে ইউরোপে। রফতানি হচ্ছে বাঁশের বাঁশি। কাগজ তৈরি হচ্ছে বাঁশ দিয়ে। বাঁশের তৈরি পণ্য পরিবেশবান্ধব হিসেবে বিশ্বজুড়ে স্বীকৃতি পেয়েছে।

তাই টেকসই বাঁশ উৎপাদনের মাধ্যমে কাঠের বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরি করে এগুলো রফতানির মাধ্যমে বছরে কোটি কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। টেকসই বাঁশ দিয়ে তৈরি আসবাবপত্র সহজে ঘুণে ধরে না। এটি কাঠের চেয়ে অনেক টেকসই এবং সুন্দর। এর বিকাশের জন্য প্রয়োজন টেকসই বাঁশের উদ্ভাবন এবং এর বাণিজ্যিক চাষাবাদ। দেশে বাঁশ সংরক্ষণ ও গবেষণার জন্য একটি গবেষণা ইনস্টিটিউট রয়েছে। তারপরও সম্ভাবনাময় বাঁশ শিল্পের আশানুরূপ বিকাশ ঘটছে না। এর জন্য তাদের অবহেলা ও উদাসীনতাই দায়ী বলে অনেকে মনে করেন।

বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) বাঁশ সংরক্ষণের লক্ষ্যে নিয়মিত গবেষণা করছে। প্রতিষ্ঠানটি ৩৩ জাতের বাঁশও সংরক্ষণ করেছে চট্টগ্রামের ষোলশহরে ইনস্টিটিউটের বাঁশ উদ্যানে। তাদের দাবি, এসব বাঁশ সারা দেশে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত হচ্ছে। তবে বাস্তবে এ চিত্র দেশের বেশিরভাগ অঞ্চলেই দেখা যায় না। বিএফআরআই কিছু জাতের বাঁশ সংরক্ষণ করলেও চাষি পর্যায়ে এর উৎপাদনের বিষয়ে তাদের কোনো ভূমিকাই নেই। এমনকি সরকারের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরেরও এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেই।

বাঁশ নিয়ে আমাদের বিভিন্ন গবেষণা অব্যাহত আছে। ইতোমধ্যে নতুন নতুন প্রজাতির বাঁশ উদ্ভাবন করছে। বাঁশ যেমন পরিবেশবান্ধব, তেমনি এটি অর্থকরীও বটে। গাছের ওপর চাপ কমানোর জন্য বাঁশের তৈরি ফার্নিচার প্রক্রিয়াজাত হচ্ছে। দীর্ঘস্থায়ী ও দৃষ্টিনন্দন এসব ফার্নিচার বিদেশেও রফতানি হচ্ছে। টেকসই বাঁশ উৎপাদন ও অন্যান্য বিষয়ে আলাদা একটি প্রকল্পও রয়েছে।

উসাইন বোল্ট বা বব মারলেদের দেশ জ্যামাইকার অর্থনীতি মূলত পর্যটন নির্ভর। দেশটির পর্যটন সেক্টর জিডিপির প্রায় ৩৫ শতাংশ আয় করে। তবে করোনা মহামারিজনিত কারণে ২০২০ সালে সুখী এই দেশটির অর্থনীতিতে ব্যাপক বিপর্যয় নেমে আসে। তবে সরকার টেকসই বাঁশ উদ্ভাবন ও এর বাণিজ্যিক উৎপাদনের মাধ্যমে অর্থনীতিকে পনর্গঠনে সক্ষম হয়েছে। এক সময় চিনি উৎপাদনের জন্য দেশটিতে ব্যাপক আখ চাষ হতো। এখন সেব আখ ক্ষেত পরিত্যাক্ত। সরকার উদ্যোগ নিয়ে সে সব আখ ক্ষেতে টেকসই বাঁশ চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করেছে এবং তাতে সফল হয়েছে।

জ্যামাইকার কৃষি ও মৎস্যমন্ত্রী ফ্লয়েড গ্রিন দাবি করেছেন, টেকসই বাঁশ চাষের এই প্রকল্পটি পুরো দেশজুড়ে ছড়িয়ে দেবে এবং এতে কৃষকদের জীবনের আরও ব্যাপক উন্নতি হবে। পাশাপাশি ভবিষ্যতে এই কৃষি-শিল্পের এই বৈচিত্র্যকে কাজে লাগিয়ে আরও বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা তারা অর্জন করতে সক্ষম হবে। বাংলাদেশও টেকসই বাঁশ উদ্ভাবন করে এবং এর বাণিজ্যিক চাষাবাদের মাধ্যমে অর্থনীতিতে বিপ্লব ঘটাতে পারে।

নতুন নতুন বাঁশ উদ্ভাবন ও সংরক্ষণের জন্য নীলফামারিতে রয়েছে আঞ্চলিক বাঁশ গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। পাঁচ বছর মেয়াদি এ প্রকল্পের কাজ আগামী ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। তবে করোনামহামারির কারণে গত কয়েক বছর থেকে এ প্রকল্পের কাজ স্থবির হয়ে রয়েছে। এজন্য সময় বাড়ানোর আবেদনও করা হয়েছে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) গ্লোবাল ব্যাম্বু রিসোর্সেস এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, জীবনধারণের নানা কাজে প্রয়োজনীয় উদ্ভিদ বাঁশের প্রজাতি-বৈচিত্র্যের দিক থেকে বাংলাদেশ পৃথিবীতে অষ্টম। বাংলাদেশে ৩৩ প্রজাতির বাঁশ রয়েছে। ৫০০ প্রজাতির বাঁশ নিয়ে বিশ্বে প্রথম অবস্থানে রয়েছে চীন। ২৩২ প্রজাতি নিয়ে দ্বিতীয় ও ১৩৯ প্রজাতি নিয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে যথাক্রমে ব্রাজিল ও জাপান। জলবায়ু পরিবর্তন, দুর্যোগ মোকাবিলা ও ভূমিক্ষয় রোধেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বাঁশঝাড়। এটি দ্রুত বর্ধনশীল একটি উদ্ভিদ। কম বিনিয়োগে বাঁশ চাষে বেশি লাভ হয়।

বাঁশকে বলা হয় মিরাকল প্ল্যান্ট। কারণ এর রয়েছে প্রভূত অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনা। বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ করে বিপুল পরিমাণ আয় ও কর্মসংস্থান করা সম্ভব। আধুনিক প্রযুক্তি অবলম্বন করে পৃথিবীর অনেক দেশই টিস্যু কালচারের মাধ্যমে উন্নত জাতের বাঁশের চারা উৎপাদন করার ফলে একর ২০ টন পর্যন্ত বাঁশ আহরণ সম্ভব হচ্ছে।

বাঁশের মণ্ড কাগজ তৈরির জন্য বিখ্যাত এ কথা সকলেরই জানা। নতুন খবর হচ্ছে ইদানিং বাঁশের মণ্ড থেকে বস্ত্র শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ যথা তুলা ও সুতা তৈরি হচ্ছে। পৃথিবীজুড়ে বাঁশ ও বাঁশজাত পণ্যের চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশেও বাঁশ সংশ্লিষ্ট শিল্প গড়ে উঠছে। আধুনিক প্রযুক্তিতে বাঁশ দিয়ে প্লাইবোর্ড, পার্টিকেল বোর্ড, সিমেন্ট বন্ডেড পার্টিকেল বোর্ডসহ গৃহস্থালির আসবাবপত্র তৈরি করা হচ্ছে।

এক তথ্যে জানা গেছে, বিশ্বে প্রায় ১৫০০ প্রজাতির বাঁশ রয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মূলী, মিতিয়া, ছড়ি, আইক্কা, বাইজা, বররা, মাকাল, বড়বাঁশা, মাতলা তল্ল্যা, উড়া, কাঞ্চন, মুলাই, করমজাসহ প্রায় ২৬ প্রজাতির বাঁশ পাওয়া যায়।

 

ইউনুস মিয়া/রাকিব

×