
একটা সময় ছিল স্কুলে যাওয়ার পথে কাদায় পিছলে যেত ছোট্ট এক শিশুর পা। আজ সে শিশু নিজেই বাবার হাত ধরে সন্তানকে নিয়ে যাচ্ছে স্কুলে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, সেই রাস্তাটি এখনও বদলায়নি। সময় পেরিয়ে গেছে, প্রজন্ম বদলেছে, কিন্তু রাস্তাটি রয়ে গেছে আগের মতোই কাঁচা, কর্দমাক্ত, আর গর্তে ভরা।
এ যেন শুধুমাত্র একটি রাস্তার গল্প নয়। এটি এক প্রজন্মের প্রতীক্ষা, প্রতিশ্রুতির অপূর্ণতা আর উন্নয়ন বঞ্চনার জীবন্ত প্রতিচ্ছবি।
পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলার টেপ্রীগঞ্জ থেকে ভাউলাগঞ্জ পর্যন্ত এই ৬ কিলোমিটার রাস্তা একসময় ছিল গ্রামের গর্বের প্রতীক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। অথচ তার অর্ধেক পথ এখনও পিচের মুখ দেখেনি। গ্রামের হাজারো মানুষের জীবন-জীবিকার পথ হয়ে উঠেছে দুর্ভোগের দীর্ঘযাত্রা।
২০০৫ সালে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে মাত্র ১ কিলোমিটার রাস্তা পাকা করা হয়। এরপর কেটে গেছে দুই দশক। মাঝে মাঝে কিছুটা কাজ এগোলেও, কখনো দুই কিলোমিটার, কখনো আধা, কিন্তু উন্নয়নের চাকা থেমে গেছে মাঝপথে। এখনো রয়ে গেছে প্রায় ৩ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা, যা বর্ষা এলেই রূপ নেয় কর্দমাক্ত বিভীষিকায়।
অর্থনীতির গলায় কাঁটা:
ভাউলাগঞ্জ হাট, পঞ্চগড়ের অন্যতম বড় একটি হাট। এখানে প্রতিটি হাটবারে ভিড় জমান আশপাশের গ্রামের কৃষক, খামারি ও ব্যবসায়ীরা। গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি থেকে শুরু করে চাল-ডাল, সবজি সবই আসে এই হাটে। টেপ্রীগঞ্জ ও চিলাহাটি ইউনিয়নের কয়েক হাজার মানুষ তাদের চিকিৎসা, শিক্ষা, ও ব্যবসায়িক কার্যক্রমের জন্য এই রাস্তার ওপর নির্ভরশীল। অথচ এই রাস্তা এখন যেন তাদের স্বপ্ন আর সংগ্রামের প্রধান প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কাঁদে শিশুরা, থেমে যায় রিকশা, থেমে থাকে স্বপ্ন:
ভেলাকোপা, বানিয়াপাড়া, সরকারপাড়া ও ভুজারীপাড়া গ্রামের মানুষ প্রতিদিন পাড়ি দেয় এই কষ্টকর রাস্তা। বর্ষায় বাইসাইকেল ঠেলেও চলা যায় না, অ্যাম্বুলেন্স বা রিকশাও আটকে পড়ে কাদার ফাঁদে। বানিয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুরা কাঁদে, পড়ে যায়, ওঠে আবার হাঁটে। কারণ পড়াশোনা থেমে থাকলে তো চলবে না! ছোট্ট শিশুদের এই প্রতিদিনের সংগ্রাম যেন এক করুণ বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি।
প্রতিশ্রুতির রাজনীতি, প্রতিশ্রুতির ধোঁকা:
গ্রামবাসীদের অভিযোগ, নির্বাচনের আগে নেতারা বারবার আসেন, বলেন, “এইবার হবে”। কিন্তু ভোটের পর আর কারো দেখা মেলে না। এক প্রজন্ম কেটেছে সেই আশ্বাসের অপেক্ষায়। এখনও চোখে স্বপ্ন, এইবার বোধহয় সত্যি হবে!
এই রাস্তা শুধু রাস্তা নয় এটা বঞ্চনার প্রতীক:
এই ৩ কিলোমিটার রাস্তা যেন ধুলা ও কাদায় গড়া এক জীবন্ত স্মারক অবহেলার, রাজনৈতিক উদাসীনতার এবং পিছিয়ে পড়া এক অঞ্চলের প্রতিচ্ছবি।
চিলাহাটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. হারুন অর রশিদ বলেন, “২০০৫ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকারের সময়ে রাস্তাটির কাজ শুরু হলেও এখনো পর্যন্ত অর্ধেকও সমাপ্ত হয়নি। আমরা প্রতিবছর এই রাস্তার জন্য প্রস্তাব দেই, কিন্তু কাজ হয় না।”
এই বিষয়ে দেবীগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয়, এলজিইডির দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-সহকারী প্রকৌশলী গৌতম রায় বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা নির্বাহী কার্যালয় থেকে আমাদের কাছে চাহিদা আসে আমরা চাহিদা অনুযায়ী কাজ করি।
সময় এসেছে দায়িত্ব নেওয়ার:
সময় এসেছে প্রজন্মের এই দীর্ঘ স্বপ্ন বাস্তবায়নের। প্রতিশ্রুতিকে পরিণত করতে হবে কার্যকর উদ্যোগে। না হলে ভবিষ্যতের প্রজন্মও হয়তো শুনবে “এই রাস্তা তো তোমার দাদাও কাঁচা দেখেছে।”
শেষ প্রশ্ন: একবার কি ফিরেও তাকাবে কেউ?
একটিবার কি শোনা যাবে এমন কোনো ঘোষণা, যা শুধু মুখের কথা নয় হৃদয়ের প্রতিশ্রুতি? সময়ই দেবে সেই উত্তর।
Jahan