
কালো টাকা সাদা করার ঢালাও সুযোগ থাকছে না
রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট আজ রবিবার পাস হচ্ছে। আগামী ১ জুলাই থেকে শুরু হবে নতুন অর্থবছর। সংসদ না থাকায় গত ২ জুন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বিটিভিতে প্রস্তাবিত বাজেট জাতির সামনে উপস্থাপন করেন।
ওই সময়ের পর থেকে ১৯ জুন পর্যন্ত অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওয়েব সাইটে প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সকল পেশা ও শ্রেণির মানুষের মতামত, পরামর্শ ও এ সংক্রান্ত দিকনির্দেশনা গ্রহণ করা হয়েছে। সেগুলো যাচাই-বাছাই করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে এবারের বাজেটে ঢালাওভাবে বহুল আলোচিত কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হচ্ছে না। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
জানা গেছে, শর্তসাপেক্ষে করহার বাড়িয়ে শুধু আবাসন খাতে অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হচ্ছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। আবাসন খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, কালো টাকা সাদা করতে নয়, অপ্রদর্শিত অর্থের বিনিয়োগ আহ্বান তাদের। এদিকে কালো টাকা সাদা করার সুযোগকে অনৈতিক, অর্থনৈতিকভাবে অলাভজনক উল্লেখ করে তা পুরোপুরি বাতিলের পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। স্বাধীনতার পর থেকেই জাতীয় বাজেটে বহুল আলোচিত এমন অর্থ সাদা করার বিধান রাখা হচ্ছে।
সুযোগ দেওয়া সত্ত্বেও খুব সামান্য অংশই কর দিয়ে সাদা করা হয়। তবে প্রস্তাবিত বাজেটে ঢালাওভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ না থাকলেও জমি কেনাবেচার ক্ষেত্রে সরকার কিছুটা শিথিলতা রাখতে চায় বলে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, এটি একেবারে বন্ধ করে দেওয়া যাবে না। তবে এটি ঢালাওভাবেও থাকবে না। নির্দিষ্ট কিছু খাতে থাকবে। আগে ১৫ শতাংশ অর্থ দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ ছিল। এখন সেটি থাকছে না। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের এমন সিদ্ধান্ত থাকলেও শেষ পর্যন্ত বিধান রেখেই বাজেট প্রস্তাব চূড়ান্ত করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
এনবিআর সূত্র বলছে, এক্ষেত্রে বর্তমান করহার বাড়তে পারে কয়েকগুণ। অন্যদিকে জমি ও ফ্ল্যাট নিবন্ধনের কর কমানোর সুপারিশ করা হয়েছে। নতুন নিয়ম অনুযায়ী বাজারমূল্যে দলিল নিবন্ধন করার বিধানও রাখা হচ্ছে। আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের দাবি, কালো টাকা নয়, অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ চান তারা। এক্ষেত্রে মৌজা মূল্যে নিবন্ধন ফি রাখার দাবিও তাদের। এ প্রসঙ্গে রিহ্যাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়া বলেন, বিদেশ থেকে অনেক সময় পাঠানো টাকার ডিক্লেয়ারেশন দেন না প্রবাসীরা। এই অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ দিতে হবে।
সম্প্রতি সচিবালয়ে অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে আবাসন খাতের ব্যবসায়ীরা বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে ব্যবসায়ীরা বলেন, বেশ কয়েক বছর ধরে আবাসন খাতে ব্যবসায় অনেকটা মন্দা যাচ্ছে। অনেক প্লট এখনো অবিক্রীত অবস্থায় রয়েছে। বিশেষ করে গত এক বছর ধরে এই খাতে ব্যবসা একেবারেই নাই বললেই চলে। রিহ্যাবের ব্যবসায়ীরা এখানে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে তার কোনো রিটার্ন পাচ্ছেন না।
এ পরিস্থিতিতে সরকার যদি এ খাতে অপ্রদর্শিত (কালো টাকা) অর্থ বিনিয়োগ করার বিদ্যমান সুবিধা বাতিল করে দেয় তবে তাদের পথে বসা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। তারা আরো বলেন, এ খাতে হাজার হাজার শ্রমিক কাজ করছেন, তারাও বেকার হয়ে পড়বে এবং এতে করে সমাজে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। তাই সরকারের কাছে রিহ্যাব নেতারা অনুরোধ করেন- আগামী বাজেটে বিদ্যমান সুবিধা যেন প্রত্যাহার করে না নেওয়া হয়। তবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগকে অনৈতিক ও অলাভজনক বলছেন অর্থনীতিবিদরা।
আবাসন খাতে মৌজা ও বাজারমূল্যের জটিলতা নিরসনের পরামর্শ তাদের। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এটি নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। অর্থনৈতিকভাবেও লাভজনক নয়। পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবেও এটি কোনো সুফল আনবে না। তাই যে মূল্যগুলো স্থির করা হয়, সেগুলোকে বাজারের দামের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে। তাহলে কালো টাকা হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা কমানো সম্ভব হবে।
এনবিআর সূত্র বলছে, ২০২৩ সাল পর্যন্ত মোট ১১ হাজার ৮৫৯ ব্যক্তি ৪৭ হাজার কোটি কালো টাকা সাদা করার সুযোগ নিয়েছেন। উল্লেখ্য, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরেও কালো টাকা সাদা করার সুযোগ ছিল। তবে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকার বিদায় নিলে অন্তর্বর্তী সরকার গত ২৯ আগস্ট উপদেষ্টা পরিষদের সভায় এ সুযোগ বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয়। ২ সেপ্টেম্বর এনবিআর ১৫ শতাংশ কর দিয়ে ঢালাওভাবে অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা করার সুযোগ বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে।
তবে সে সময় স্থাপনা, বাড়ি, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট, ফ্লোর স্পেস ও ভূমি আয়কর রিটার্নে অপ্রদর্শিত থাকলে তা নির্ধারিত হারে আয়কর দিয়ে বৈধ করার বিধানটি বহাল রাখা হয়। এর মধ্যে আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে কর বাড়িয়ে কিছু কাটছাঁট করে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এক্ষেত্রে বিভিন্ন অঞ্চলভেদে তিন থেকে পাঁচ গুণ কর বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এতেই দেখায় দেয় বিপত্তি, অর্থনীতিবিদসহ বিভিন্ন পর্যায় থেকে সরকারের এই প্রস্তাবের ব্যাপক সমালোচনা করা হয়। অর্থ বিলে বলা হয়েছে, সরকারিভাবে নির্ধারিত এলাকা ভেদে ফ্ল্যাট বা ভবন কেনা এবং নির্মাণে কালো টাকা সাদা করতে হলে প্রতি বর্গফুটে নির্দিষ্ট হারে কর দিতে হবে। ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানী, বারিধারা, মতিঝিল ও দিলকুশায় দুই হাজার বর্গফুটের বেশি আয়তনের অ্যাপার্টমেন্ট বা ভবনের ক্ষেত্রে কর হবে প্রতি বর্গফুটে দুই হাজার টাকা।
একই এলাকায় দুই হাজার বর্গফুটের কম আয়তনের ক্ষেত্রে কর নির্ধারিত হয়েছে ১৮০০ টাকা। ধানমন্ডি, উত্তরা, মহাখালী, লালমাটিয়া, বসুন্ধরা, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, কাওরানবাজারসহ অন্যান্য অভিজাত এলাকায় দুই হাজার বর্গফুটের বেশি আয়তনের অ্যাপার্টমেন্ট বা ভবনের ক্ষেত্রে কর হবে ১৮০০ টাকা এবং অনধিক আয়তনের ক্ষেত্রে ১৫০০ টাকা।
অপর দিকে, ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীর বাইরে সিটি করপোরেশন এলাকাগুলোতে বড় ফ্ল্যাটের (১৫০০ বর্গফুটের বেশি) ক্ষেত্রে কর প্রতি বর্গফুটে ৭০০ টাকা এবং ছোট ফ্ল্যাটে (১৫০০ বর্গফুটের কম) কর ৬০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। জেলা সদরের পৌর এলাকায় বড় ফ্ল্যাটের জন্য কর প্রতি বর্গফুটে ৩০০ টাকা এবং ছোট ফ্ল্যাটের জন্য ২৫০ টাকা। দেশের অন্যান্য অঞ্চলে বড় ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে কর ১৫০ টাকা এবং ছোট ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে ১০০ টাকা।
শুধু অ্যাপার্টমেন্ট বা ফ্ল্যাট কেনা নয়, ভবন নির্মাণেও কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকছে। এলাকাভেদে প্রতি বর্গফুটে ৫০ থেকে ৯০০ টাকা পর্যন্ত কর দিয়ে এই সুবিধা নেওয়া যাবে। শর্তসাপেক্ষে বৈধতা দেওয়া হবে। তবে দুটি শর্ত উল্লেখযোগ্যÑ এই অর্থ যদি অপরাধমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে অর্জিত হয়, তবে তা বৈধ করা যাবে না। তবে অর্থের উৎস বৈধ না হলে, আইনের এই ধারায় সুবিধা প্রযোজ্য হবে না।
এদিকে, জাতীয় বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চেতনাবিরোধী বলে আখ্যায়িত করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। এ ছাড়া কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ রাখার তীব্র সমালোচনা করেছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশও (টিআইবি)। সংস্থাটি বলেছে, এ সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রীয় সংস্কার, বিশেষ করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কারের মূল উদ্দেশ্যের সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী।
টিআইবি বলে, যেভাবেই ব্যাখ্যা করা হোক না কেন, এটি স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, রাষ্ট্র সংস্কার বিশেষ করে দুর্নীতিবিরোধী সংস্কারের মূল উদ্দেশ্যকে রীতিমতো উপেক্ষা করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রহমান খান বলেন, অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা করার সুযোগ বাতিলের বিষয়ে সক্রিয় বিবেচনা করছে সরকার। অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে রিহ্যাবের পক্ষ থেকে এ সুযোগ অব্যাহত রাখার বিষয়ে জোর দাবি জানানো হয়েছে। সরকার সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে যৌক্তিকভাবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।