ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ৩১ মে ২০২৫, ১৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ই-কমার্স প্রতারণা: ছবির পণ্য আর বাস্তবতা

আবু রায়হান, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, রাজশাহী

প্রকাশিত: ০১:০৮, ৩০ মে ২০২৫

ই-কমার্স প্রতারণা: ছবির পণ্য আর বাস্তবতা

ছবিঃ সংগৃহীত

বর্তমান ডিজিটাল যুগে ই-কমার্স মানুষের জীবনকে সহজ করেছে। পছন্দের পণ্য ঘরে বসেই অর্ডার করা যায়, সময় বাঁচে, ঝামেলাও কম হয়। তবে অনলাইন কেনাকাটার সুবিধার পাশাপাশি প্রতারণার ঘটনাও বেড়ে চলেছে। সবচেয়ে বেশি যে প্রতারণার শিকার হয়, তা হলো পণ্যের ছবির সঙ্গে বাস্তব পণ্যের অমিল। 

কতবার এমন হয়েছে যে, আপনি অনলাইনে একটি সুন্দর পোশাকের ছবি দেখে অর্ডার করেছেন, কিন্তু হাতে পাওয়ার পর দেখলেন সেটি নিম্নমানের, রঙ মলিন, অথবা ডিজাইনে আকাশ-পাতাল পার্থক্য? অথবা একটি ব্র্যান্ডেড ইলেকট্রনিক পণ্যের অর্ডার দেওয়ার পর হাতে পেয়েছেন এমন কিছু, যা একেবারেই ভিন্ন বা নকল? এই ধরনের অভিজ্ঞতা অনেকেরই হয়েছে, এবং দিন দিন এই প্রতারণার মাত্রা বাড়ছে।

অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোতে পণ্যের যে ছবি দেওয়া হয়, সেগুলো সাধারণত উচ্চমানের ক্যামেরায় তোলা হয় এবং আকর্ষণীয় করে এডিট করা হয়। এতে করে পণ্যটি বাস্তবে যেমন, তার চেয়ে অনেক ভালো দেখায়। তবে সমস্যাটা হয় তখন, যখন পণ্যের ছবি আর বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন হয়ে যায়। অনেক সময় দেখা যায়, ছবিতে দেখানো পণ্যের সঙ্গে বাস্তব পণ্যের তুলনাই চলে না গুণগত মান কম, আকার ছোট, রঙের পার্থক্য স্পষ্ট। এই প্রতারণা শুধু অখ্যাত বা অজানা অনলাইন শপেই হয় না, অনেক বড় ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মেও মাঝে মাঝে এমন ঘটনা ঘটে। কিছু অসাধু বিক্রেতা ইচ্ছে করেই ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে সুন্দর, ব্র্যান্ডেড, বা দামি পণ্যের ছবি ব্যবহার করে, কিন্তু বাস্তবে কম দামের নকল বা নিম্নমানের পণ্য সরবরাহ করে।

ই-কমার্স প্রতারণার ধরনগুলো মূলত কিছু নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে হয় যেমন- এডিটিং ও ফিল্টারের অপব্যবহার। অনেক বিক্রেতা পণ্যের রঙ, গঠন, বা টেক্সচার আরও আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য ছবি এডিট করেন। এতে পণ্যের আসল চেহারা পরিবর্তিত হয়ে যায় এবং ক্রেতা বিভ্রান্ত হন। উদাহরণস্বরূপ, একটি পোশাকের ছবিতে খুব উজ্জ্বল রঙ দেখানো হয়, কিন্তু হাতে পাওয়ার পর দেখা যায়, রঙ ফিকে বা সম্পূর্ণ ভিন্ন। নকল পণ্য সরবরাহ, এই কৌশল সবচেয়ে বেশি দেখা যায় ব্র্যান্ডেড পণ্যের ক্ষেত্রে। কোনো নামী ব্র্যান্ডের মোবাইল ফোন, ঘড়ি, ব্যাগ বা পোশাকের ছবি দিয়ে অর্ডার নেওয়া হয়, কিন্তু ডেলিভারির সময় দেওয়া হয় সস্তা নকল বা চায়না কপি পণ্য। ভুল বা বিভ্রান্তিকর পণ্যের বিবরণ, ওয়েবসাইটে পণ্যের যে বিবরণ দেওয়া হয়, সেটির সঙ্গে বাস্তব পণ্যের মিল থাকে না। উদাহরণস্বরূপ, একটি লেদার ব্যাগের বিবরণে লেখা থাকে "জেনুইন লেদার," কিন্তু ডেলিভারির পর দেখা যায়, সেটি সস্তা কৃত্রিম লেদারের তৈরি। অর্ডার কনফার্ম করার পর যোগাযোগ বন্ধ: বেশ কিছু প্রতারক অনলাইন পেজ বা ওয়েবসাইট শুধু একবারের জন্য ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে তৈরি হয়। তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় আকর্ষণীয় ছবি ও অফারের মাধ্যমে প্রচারণা চালায়। যখন ক্রেতা পেমেন্ট করে অর্ডার কনফার্ম করেন, তখন তারা কোনো পণ্য পাঠায় না বা নিম্নমানের কিছু পাঠিয়ে পরে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। রিটার্ন ও রিফান্ড সুবিধা থাকে না।

অনেক প্ল্যাটফর্মের রিটার্ন ও রিফান্ড পলিসি অস্পষ্ট বা একেবারেই অনুপস্থিত। ফলে প্রতারণার শিকার হলেও ক্রেতা অভিযোগ করতে পারেন না বা টাকা ফেরত পাওয়ার সুযোগ থাকে না।

ই-কমার্স প্রতারণা থেকে বাঁচতে হলে ক্রেতাদের আরও সচেতন হতে হবে এবং কিছু কৌশল অবলম্বন করতে হবে। পরিচিত ও বিশ্বাসযোগ্য প্ল্যাটফর্ম থেকে কেনাকাটা করুন। যেসব ই-কমার্স সাইট বা পেজের সুনাম আছে, সেখান থেকেই কেনাকাটাি করা ভালো। নতুন বা অখ্যাত ওয়েবসাইট বা ফেসবুক পেজ থেকে অর্ডার করার আগে তাদের রিভিউ ও গ্রাহক প্রতিক্রিয়া যাচাই করুন। রিভিউ ও রেটিং ভালোভাবে দেখুন।
কোনো পণ্য কেনার আগে সেটির রিভিউ ও রেটিং ভালোভাবে দেখুন। শুধু ওয়েবসাইটে থাকা রিভিউ নয়, গুগল বা সোশ্যাল মিডিয়াতেও খোঁজ করুন, যাতে বাস্তব ক্রেতাদের মতামত জানা যায়। বাস্তব কাস্টমার ফিডব্যাক যাচাই করুন। অনেক অনলাইন পেজ ফেক রিভিউ ব্যবহার করে। তাই ক্রেতাদের আপলোড করা বাস্তব ছবি ও কমেন্ট ভালোভাবে পড়ুন। যদি বাস্তব ছবি বা ভিডিও রিভিউ না থাকে, তাহলে সতর্ক থাকুন। ক্যাশ অন ডেলিভারি (COD) অপশন বেছে নিন। যতটা সম্ভব ক্যাশ অন ডেলিভারি অপশন বেছে নিন, যাতে পণ্য হাতে পাওয়ার পর মূল্য পরিশোধ করতে পারেন। এতে প্রতারণার সম্ভাবনা কমে যায়। রিটার্ন ও রিফান্ড পলিসি নিশ্চিত করুন। যেসব ই-কমার্স সাইটের রিটার্ন ও রিফান্ড পলিসি নেই, সেগুলো থেকে কেনাকাটা করা উচিত নয়। কেনার আগে দেখে নিন, যদি পণ্য সমস্যা হয় তাহলে ফেরত দেওয়া যাবে কিনা। সন্দেহজনক অফার ও ডিসকাউন্ট থেকে সতর্ক থাকুন। যেসব পণ্যের দাম অবিশ্বাস্যভাবে কম দেওয়া হয় বা "লিমিটেড টাইম অফার" বলে চাপ সৃষ্টি করা হয়, সেগুলোতে প্রতারণার সম্ভাবনা বেশি থাকে। অতিরিক্ত কম দামে আসল ব্র্যান্ডের পণ্য পাওয়া সম্ভব নয়, তাই লোভনীয় অফার দেখলে ভালোভাবে যাচাই করুন।

ই-কমার্স প্রতারণা রোধে আমাদের সবাইকে আরও বেশি সচেতন হতে হবে। সব অনলাইন প্ল্যাটফর্ম প্রতারক নয়, তবে কিছু অসাধু বিক্রেতার কারণে অনেকেই প্রতারিত হন এবং অনলাইন কেনাকাটার ওপর আস্থা হারান। তাই কেনাকাটার আগে ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করা জরুরি। বাস্তব ক্রেতাদের রিভিউ দেখা, বিশ্বাসযোগ্য ওয়েবসাইট নির্বাচন করা এবং নিরাপদ লেনদেন নিশ্চিত করাই প্রতারণা থেকে রক্ষা পাওয়ার মূল উপায়। অনলাইন কেনাকাটা হোক আনন্দদায়ক ও ঝামেলামুক্ত।

মুমু

×