ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৯ মে ২০২৫, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

সিন্ডিকেটের অভিযোগ ভিত্তিহীন

ব্রয়লার মুরগি ও বাচ্চার দামে বিপর্যয়

মাইনুদ্দিন আহমেদ

প্রকাশিত: ১৩:৫১, ২৮ মে ২০২৫; আপডেট: ১৬:৪০, ২৯ মে ২০২৫

ব্রয়লার মুরগি ও বাচ্চার দামে বিপর্যয়

ছবি:সংগৃহীত

 ব্রয়লার মুরগির দর পতনে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন খামারিরা। ফলশ্রুতিতে খামার পরিচালনায় আগ্রহ হারিয়েছেন অধিকাংশ খামারি। ফলে চাহিদায় তীব্র ভাটা পড়েছে ব্রয়লার মুরগির এক দিন বয়সী বাচ্চার। এতে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙ্গে কমেছে বাচ্চার দাম। জানা যায়, খামারি পর্যায়ে ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ কেজি প্রতি ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা হলেও চলতি মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে খামারিরা পাচ্ছে ১২০ টাকার নিচে।

 

অতীতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর থেকে বিভিন্ন সময় পোল্ট্রি কোম্পানি ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে যোগসাজশ (সিন্ডিকেট) করে ডিম আর মুরগির দাম বাড়ানোর অভিযোগ করা হয়েছে।  
তবে এ খাতে সংশ্লিষ্টরা যুক্তি তুলে ধরে বলেছেন, যদি এ খাতে সিন্ডিকেট তাহলে হ্যাচারিগুলো অতিরিক্ত বাচ্চা উৎপাদন করত না এবং বাচ্চার দামও কমতো না। তারা আশঙ্কা ব্যাক্ত করে বলেছেন, উৎপাদন খরচের তুলনায় ব্রয়লার বাচ্চা ও  মুরগির অতিরিক্ত কম দাম অব্যাহত থাকলে পোল্ট্রি শিল্প ধ্বংসের মুখে পড়তে পারে।  তাদের মতে, যে হারে খামারিরা পোল্ট্রি ব্যবসা ছাড়ছেন তা অব্যাহত থাকলে অনেক হ্যাচারি বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে নিকট ভবিষ্যতে একদিন বয়সী বাচ্চা এবং ব্রয়লার মুরগির ঘাটতি দেখা দেবে। গত ১৬ মে কিশোরগঞ্জ জেলার বিভিন্ন এলাকার খামার ঘুরে আলাপচারিতায় বেশ কয়েকজন খামারি ব্রয়লার মুরগির চলমান বাজার দরে হতাশা ব্যক্ত করেছেন।  বর্তমান অবস্থা দীর্ঘদিন অব্যাহত থাকলে তাদের পক্ষে এ ব্যবসায় টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়বে বলেও মন্তব্য করেছেন। 
এর মধ্যে জেলার করিমগঞ্জ থানার সিদলারপাড়ে ২ দশকের অভিজ্ঞ খামারি মোসলেহ উদ্দিন (৫৮) জানান, "অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় বর্তমানে মুরগির খামার ব্যবসায় যে ধস নেমেছে।  খরচ বৃদ্ধি ও দর পতনসহ নানা কারনে গত রোজার ঈদের পর থেকে অনেকে খামার করায় আগ্রহ হারিয়েছেন।  

 

 

শেডে বাচ্চা তুলছেন না। ৩০ টাকা দরে কেনা বাচ্চায় ১৪০ টাকা উৎপাদন খরচের মুরগী ১২০ টাকা করে বিক্রি করে গত এক ব্যাচে ৬০ হাজার টাকা লোকসানের তথ্য দিয়ে এই খামারি জানান, " বাচ্চার দাম সীমাহীন ভাবে কমলেও বিক্রির সময় সময় বেশি লোকসানের ভয়ে দুটি শেডের একটি বন্ধ রেখেছি"। 
একই এলাকার তরুণ খামারি সাদ্দাম হোসেনের (৩৪) তিনটি শেডে সাড়ে ৬ হাজার পালন ক্ষমতা থাকলেও মাথ একটিতে ১২শ' ব্রয়লার করেছেন। তিনি জানান, ২৬ দিন আগে ২৭ টাকা দরে কেনা বাচ্চা পালন করেও নিশ্চিত লোকসানের ভয়ে রয়েছি। কোরবানির ঈদের দেড় মাসের পরও এ বাজার ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনাও ক্ষীণ " বলে উল্লেখ করেন তিনি। সারেজমিন আলাপচারিতায় দেখা যায়, এ খাত সম্পর্কে গত কয়েক বছর ধরে পোল্ট্রি শিল্প উদ্যোক্তাদের বলা কথাগুলো এখন তৃণমূলের খামারিদের মুখেও প্রতিধ্বনি হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে কাজী ফার্মসের পরিচালক কাজী জাহিন হাসান বলেন, "এক দিনের বাচ্চার দাম ব্রয়লার মুরগির দামের উপর নির্ভর করে। ব্রয়লার মুরগির বাজার দর কম থাকলে খামারিরা বাচ্চা কিনতে চান না, তাই বাচ্চা মুরগির দাম ও কমে যায়। যখন ব্রয়লারের দাম বেশি থাকে তখন সকম খামারিই বাচ্চা কিনতে আগ্রহী হয়ে উঠেন, ফলে উৎপাদনের চাহিদা বেড়ে যায় এবং বাচ্চার দাম ও বাড়ে। 

 


চাহিদার তুলনায় উৎপাদন অনেক বেশি হওয়ার এখন ব্রয়লারের দাম কম উল্লেখ করে তিনি বলেন, " চাহিদা ও যোগাবের ভিত্তিতে দাম নির্ধারণ হয়ে থাকে। গত বছর এক দিনের বাচ্চার দাম যখন বেশি ছিল হ্যাচারিগুলো  বাচ্চার উৎপাদন বাড়ানোর ব্যাবস্থা করেছিল, ফলে বর্তমানে বাজারে সরবরাহ বেশি। যদি যোগসাজশ করে উৎপাদন কমিয়ে দাম বাড়ানোর সিন্ডিকেট থাকতো  তা হলে উৎপাদন কখনো এতো বেশি হতো না এবং দাম ও এতো কম হতো না"। 
এ খাতের অপর অন্যতম উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান  পোল্ট্রি লিমিটেড এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মশিউর রহমান বলেন, উদ্যোক্তাদের পক্ষ্য থেকে দীর্ঘদিন ধরে বলা হচ্ছে যে, মুরগীর বাচ্চার দাম ব্রয়লার মুরগির দামের উপর নির্ভর করে। কিন্তু মহল বিশেষ দাম বৃদ্ধির জন্য অযৌক্তিকভাবে কথিত সিন্ডিকেটের ওপর দায় চাপিয়ে আসছে, যা এ খাত সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব উষ্কে দিচ্ছে। এখন এ খাত প্রকৃত অর্থেই সংকটে রয়েছে। এখান থেকে উত্তরনের অভিযোগকারী মহল কোন  পথ দেখাতে পারছে না।

 


বর্তমান পরিস্থিতিকে পোল্ট্রি খাতের জন্য বিপর্যয়  উল্লেখ করে ব্রিডার্স আ্যসোসিয়েসনস এর সভাপতি  মাহবুবুর রহমান বলেন, উদ্যোক্তা থেকে শুরু করে, প্রান্তিক খামারি সবাই বাজারে করুণার উপর নির্ভরশীল।  তিনি বলেন, হ্যাচারি কোম্পানিগুলো ৪৫ টাকা উৎপাদন খরচের এক দিবের বাচ্চা বিক্রি করছে পাঁচ টাকা দরে। এতে প্রতি বাচ্চায় লোকসান ৪০ টাকা। হ্যাচারিগুলো সপ্তাহে ১ কোটি ৯০ লাখের বেশি ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা উৎপাদন করে এবং বর্তমান বাজার দরে প্রতি সপ্তাহে কোটি কোটি লোকসান গুনছে। নিকট ভবিষ্যতে পোল্ট্রি পণ্যে আরও সংকটের পূর্বাভাস দিয়ে মাহবুবুর রহমান বলেন,  "যারা পোল্ট্রি বাজার বোঝেন, না তারা সব সময় উদ্যোক্তাদের কল্পিত সিন্ডিকেটের ওপর দোষারোপ করেন, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক।"

আঁখি

×