
বিশ্বব্যাংক প্রতি ছয় মাসে খাদ্যনিরাপত্তা ও মূল্যস্ফীতি-সম্পর্কিত হালনাগাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। বাংলাদেশ দুই বছর ধরে বিশ্বব্যাংকের খাদ্য মূল্যস্ফীতি ঝুঁকির ‘লাল শ্রেণিতে রয়েছে। এই শ্রেণি মানে হচ্ছে, দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৫ থেকে ৩০ শতাংশের মধ্যে রয়েছে, যা বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী বাংলাদেশে খাদ্যনিরাপত্তার জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশের পাশাপাশি লাল শ্রেণিতে রয়েছে ভারত, কঙ্গো, অ্যাঙ্গোলা, ইথিওপিয়া, গাম্বিয়া, গিনি, মাদাগাস্কার, ঘানা, লাওস, লেসেথো, তিউনিসিয়া, জাম্বিয়া, বেলারুশ ও রাশিয়া।
বিশ্বব্যাংকের খাদ্য পরিস্থিতি নির্ণয়ের মানদণ্ড
খাদ্য মূল্যস্ফীতি কোন দেশে কত বেশি তা বোঝাতে বিভিন্ন দেশকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করেছে বিশ্বব্যাংক। যেসব দেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৩০ শতাংশ বা তার বেশি, সেসব দেশকে ‘বেগুনি’ শ্রেণিতে; ৫ থেকে ৩০ শতাংশের মধ্যে যেসব দেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতি, তাদের ‘লাল’ শ্রেণিতে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া ২ থেকে ৫ শতাংশের মধ্যে মূল্যস্ফীতির দেশগুলোকে ‘হলুদ’ ও ২ শতাংশের কম মূল্যস্ফীতির দেশগুলোকে ‘সবুজ’ শ্রেণিতে রাখা হয়েছে। সব মিলিয়ে ১৭২টি দেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে সংস্থাটির প্রতিবেদনে।
বিশ্ব খাদ্য মূল্যস্ফীতি
প্রতিবেদন বলছে, বছর দুয়েক আগে পাকিস্তানও অর্থনীতি নিয়ে বিপদে পড়ে। পাকিস্তানেও মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকে। ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতি ৩০ শতাংশে পৌঁছায়। মূলত খাদ্যপণ্যের মূল্যৃবৃদ্ধি পাওয়ায় সার্বিক মূল্যস্ফীতি বাড়ে। পরিস্থিতি সামাল দিতে পাকিস্তানও আইএমএফের কাছ থেকে ৭০০ কোটি ডলার ঋণ নেয়। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, গত ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তানের খাদ্য মূল্যস্ফীতি মাইনাস ৪ দশমিক ১ শতাংশ। সর্বশেষ ১০ মাসের মধ্যে পাঁচ মাসই খাদ্য মূল্যস্ফীতি মাইনাস ছিল। বিশ্বব্যাংকের সবুজ তালিকায় রয়েছে পাকিস্তান। আর কয়েক বছর ধরে অর্থনীতি নিয়ে ভারতও চাপে আছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি না থাকলেও মূল্যস্ফীতি নিয়ে চাপে ছিল দেশটি।
দেশটির মূল্যস্ফীতি কয়েক মাস ধরে কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, গত জানুয়ারি মাসে ভারতের খাদ্য মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৭ শতাংশে। যদিও ভারত এখনো বিশ্বব্যাংকের ‘লাল’ তালিকায় রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, ভারতে খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখন ৬ শতাংশের কম। পাকিস্তানে মূল্যস্ফীতি এখন ‘মাইনাস’ (নেতিবাচক), অর্থাৎ খাদ্যপণ্যের দাম কমছে। শ্রীলঙ্কায়ও একই চিত্র। নেপাল ও মালদ্বীপে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের কম। সার্কভুক্ত দেশ আফগানিস্তানেও খাদ্য মূল্যস্ফীতি সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারি মাসে ছিল মাইনাস ৩ শতাংশ । জানা গেছে, ২০২২ সালের শুরুতে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্বজুড়ে নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকে। অনেক দেশ নিজেদের অর্থনীতি নিয়ে বিপদে পড়তে শুরু করে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ভারতের মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকে। খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার অনেক বেশি ছিল। বেশি বিপাকে পড়েছিল শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান। তারা এখন মূল্যস্ফীতি সামাল দিতে পেরেছে।
বিশ্বব্যাংক আরও বলছে, নেপালে গত এক বছরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৪ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে ছিল। সর্বশেষ ফেব্রুয়ারি মাসে নেপালে খাদ্যমূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৭ শতাংশ হয়েছে। মালদ্বীপে এক বছর ধরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৫ থেকে ৮ শতাংশের মধ্যে ছিল। ভুটানের খাদ্য মূল্যস্ফীতির হিসাব দেয়নি বিশ্বব্যাংক। উচ্চ খাদ্যমূল্যস্ফীতি বিবেচনায় বিশ্বব্যাংকের তালিকায় টানা এক বছর ধরে সবচেয়ে খারাপ শ্রেণি বেগুনিতে রয়েছে ছয়টি দেশ। এই দেশগুলো হলো মালাবি, দক্ষিণ সুদান, হাইতি, মিয়ানমার, আর্জেন্টিনা ও তুরস্ক। খাবারের দাম নিয়ে সবচেয়ে ভালো আছে আটটি দেশ। সবুজ শ্রেণিভুক্ত দেশগুলো হলো সুইজারল্যান্ড, সুইডেন, সৌদি আরব, ম্যাকাও, চীন, ফ্রান্স, ফিনল্যান্ড ও বেনিন। তালিকায় থাকা অন্য দেশগুলো গত এক বছরে কখনো লাল, কখনো বেগুনি, কখনো-বা হলুদ বা সবুজ তালিকায় ছিল। কেউ নিজেদের খাদ্য মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতির উন্নতি করেছে, কারও হয়েছে অবনতি।
বাংলাদেশের পরিস্থিতি
বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতির হয়েছে অবনতি। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, দেশের আর্থিক ব্যবস্থার সঙ্গে জনসম্পৃক্ততা কম। এ কারণে বাংলাদেশে উন্নত বিশ্বের মতো কেবল সুদহার বাড়ানোর পদক্ষেপে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে চাঁদাবাজি ও সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বন্ধের পাশাপাশি কার্যকর বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, মার্চ শেষে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯ শতাংশ। সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক সর্বশেষ ১০ থেকে ১২ মাসের খাদ্য মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে খাদ্যনিরাপত্তা-বিষয়ক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে থাকে। এর আগের টানা এক বছর বাংলাদেশ লাল তালিকায় ছিল। প্রতি ছয় মাস পর এই চিত্র প্রকাশ করে থাকে সংস্থাটি। সেই অনুসারে, প্রায় দুই বছর ধরে বাংলাদেশ লাল তালিকায় অর্থাৎ অবস্থানের পরিবর্তন হয়নি।
কি করণীয়
শ্রীলঙ্কার উদাহরণ
২০২২ সালে বিদেশী ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে দেউলিয়া হয়ে যায় শ্রীলঙ্কা। এরপর ২০২৩ সালের মার্চ মাসে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ২৯০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়ার পর ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে দেশটি। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি উঠেছিল প্রায় ৭০ শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির প্রভাব সবচেয়ে বেশি। সেই অবস্থা থেকে এখন উত্তরণ হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারি মাসে শ্রীলঙ্কার খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে মাইনাস দশমিক ২ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুসারে, শ্রীলঙ্কা এখন সবুজ তালিকায়। এক বছর ধরে শ্রীলঙ্কার খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশের বেশি হয়নি। মূল্যস্ফীতি কমাতে জ্বালানি তেলসহ সরকারি পরিষেবার বিলের খরচ কমিয়েছে শ্রীলঙ্কা সরকার। শ্রীলংকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদহার বৃদ্ধি, মুদ্রার বিনিময় হারকে নমনীয় করা এবং কঠোর আর্থিক ও মুদ্রানীতির মতো পদক্ষেপ নেওয়ায় এর সুফল মিললেও তাতে এক বছরেরও বেশি সময় লেগেছে।
বাজার ব্যবস্থাপনা
সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজি বাজার ব্যবস্থাপনার ৩০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। যা মোকাবেলায় কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। অ্যাডহক ভিত্তিতে হয়তো পণ্যমূল্যের দাম বেঁধে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু মুক্তবাজার অর্থনীতিতে এটি ভুল চিন্তা। বরং সিন্ডিকেট কমিয়ে বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ানোয় জোর দিতে হবে। যথাযথ বাজার ব্যবস্থাপনা ও প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ভালো ভূমিকা রাখতে পারে। সরকারকে পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করার মাধ্যমে বাজার ব্যবস্থাপনায় জোর দিতে হবে। নিত্যপণ্যের সরবরাহ নিশ্চিতকরণ প্রয়োজন। নীতি সুদহার বাড়ানোর মাধ্যমে ব্যাংক খাতের তারল্য প্রবাহে লাগাম টানা হয়েছে এবং এতে করে মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণে আসবে। তবে এর সুফল পেতে হলে ১২ থেকে ১৮ মাস সময় লাগবে।
প্যানেল