ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৪ মে ২০২৫, ২১ বৈশাখ ১৪৩২

আসন্ন বাজেট

সামাজিক নিরাপত্তায় প্রাধান্য

ড. মিহির কুমার রায়

প্রকাশিত: ১৯:৫৩, ৩ মে ২০২৫

সামাজিক নিরাপত্তায় প্রাধান্য

আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটের আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। এটি চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় ৭ হাজার কোটি টাকা কম। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার ছিল ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। বাজেটের এ আকার চূড়ান্ত হলে স্বাধীনতার পর এবারই প্রথম পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় বাজেটের আকার কমবে। এদিকে এতদিন জুনের প্রথম বৃহস্পতিবার বাজেট ঘোষণার রেওয়াজ থাকলেও এবার ২ জুন সোমবার বাজেট ঘোষণা করা হবে। সংসদ কার্যকর না থাকায় রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করবেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ। তবে রেওয়াজ অনুযায়ী বাজেট ঘোষণার পরদিন বাজেট-উত্তর সংবাদ সম্মেলন করবেন তিনি। সূত্রগুলো জানায়, রাজস্ব আহরণে কাক্সিক্ষত অগ্রগতি না হওয়া এবং বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান কমে যাওয়ার কারণে আগামী বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার কমছে। এবার এডিপির আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর এখাতে বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা।
অন্যান্যের মধ্যে নতুন অর্থবছরের বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৫ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতির হার ৬ দশমিক ৫ শতাংশ প্রাক্কলন করেছে অর্থ বিভাগ। চলতি অর্থবছরের বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৫ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ প্রাক্কলন করা হয়েছিল। অবশ্য সংশোধিত বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৫ শতাংশ প্রাক্কলন করেছে অর্থবিভাগ। মূল্যস্ফীতির প্রভাবে গত ২ বছরে দেশে অতি দরিদ্র হয়েছে ৩৮ লাখ মানুষ। আর শীঘ্রই মূল্যস্ফীতির পারদ কমছে না বিশ্বব্যাংক এমন আভাস দিয়ে বলেছে নতুন করে আরও ৩০ লাখ মানুষ হবে অতি দরিদ্র। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আসন্ন বাজেটে (২০২৫-২৬) ‘সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি’র উদ্যোগ থাকছে সীমিত। চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫) তুলনায় সুবিধাভোগীর সংখ্যা কমছে ৪ লাখ ২ হাজার। এই কর্মসূচিতে যোগ হয়েছিল ১০ লাখ ২৬ হাজার সুবিধাভোগী যা আগামী অর্থবছরে হবে ৬ লাখ ২৪ হাজার। এছাড়া আসন্ন বাজেটে (২০২৫-২৬) সব ধরনের ভাতা সর্বনিম্ন ৫০ থেকে সর্বোচ্চ একশ’ টাকা বেড়ে ভাতার অঙ্ক ৬৫০ থেকে ৯০০ টাকায় উন্নীত করেছে, যা দিয়ে দারিদ্র্য বিমোচন খুবই কঠিন। পাশাপাশি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির সংখ্যা কমানো হচ্ছে। আগামী বাজেটে ১২ ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে ব্যয় মেটাতে বরাদ্দ থাকছে ১৯ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ আছে ১৭ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে নতুন অর্থবছরে এক হাজার ৭৫০ কোটি টাকা বাড়ছে।
এদিকে অব্যাহত মূল্যস্ফীতির চাপের কারণে গত দুই বছরে মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে। রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র‌্যাপিড) গবেষণার তথ্য অনুযায়ী অন্তত ৭৮ লাখ মানুষকে দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে, যার মধ্যে ৩৮ লাখ লোক অতি দরিদ্র হয়ে পড়েছে। আর ৯৮ লাখ ৩০ হাজার মানুষ অতিমাত্রায় দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা এবং ভাতার অঙ্ক বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, অর্থ সংকটের কারণে বড় ধরনের উদ্যোগ থাকছে না সরকারের পক্ষ থেকে। অন্তর্বর্তী সরকারের বলয় বাড়ানোর উদ্যোগ নিলেও এ খাত ঘিরে দুর্নীতির বিষয়টি প্রথমে আলোচনায় নিয়ে আসেন সমাজ কল্যাণ উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ নিজেই। সম্প্রতি তিনি বলেছেন, শুধু অর্থ বরাদ্দ দিয়ে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সফল হবে না। সামাজিক সুরক্ষা খাতে দুর্নীতি বড় বাধা, ফলে শক্তিশালী তদারকি প্রয়োজন। এ খাতে উপকারভোগীদের তালিকায় দুর্নীতি আছে। ড্যাশবোর্ড তৈরি হলে সামাজিক সুরক্ষার কর্মসূচিগুলোর কার্যক্রম জোরালো নজরদারির মধ্যে রাখা সম্ভব হবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ সিপিডির গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে ৩৩ লাখ বয়স্ক ও ২৫ লাখ বিধবা ভাতা পাচ্ছেন না। অন্যদিকে প্রায় ৩০ শতাংশ বয়স্ক ও ৩৩ শতাংশ বিধবা ভাতা পাওয়ার অনুপযোগী হওয়া সত্ত্বেও নিয়মিত ভাতা পাচ্ছেন। এতে করে তাদের পেছনে বছরে দেড় হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। এ টাকা দিয়ে প্রায় ১৫ লাখ বয়স্ক ও বিধবাকে ভাতার আওতায় আনা সম্ভব। জানতে চাইলে সিপিডির মোস্তাফিজুর রহমান সংবাদ মাধ্যমকে জানান, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ভিত্তি, প্রার্থী ও স্থায়িত্ব পূর্ণ বিবেচনা করে ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকারের সক্ষমতা থাকলে এ কর্মসূচির আওতা আরও বাড়ানো দরকার। তিনি আরও বলেছেন, মূল্যস্ফীতির কারণে গত কয়েক বছরে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমছে। অনেকে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে, দারিদ্র্য মানুষগুলো হয়েছে অতি দরিদ্র। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে মূল্যস্ফীতির কারণে ৩০ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। অর্থ বিভাগের হিসাবে আগামী অর্থবছরে ৯৯ হাজার জনকে যুক্ত করে ৬১ লাখ বৃদ্ধকে বয়স্ক ভাতা দেওয়া হবে। এতে বরাদ্দ থাকছে চার হাজার ৭৯১ কোটি ৩১ লাখ টাকা, চলতি বাজেটে বরাদ্দ আছে চার হাজার ৩৫০ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। এ কর্মসূচিতে ভাতার অঙ্ক ৫০ টাকা বাড়িয়ে ৬৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এদিকে বিধবা ভাতাভোগীতে নতুন মুখ যুক্ত হচ্ছে এক লাখ ২৫ হাজার জন। এতে মোট উপকারভোগীর সংখ্যা ২৭ লাখ ৭৫ হাজার জন থেকে বেড়ে ২৯ লাখে উন্নীত হবে। অর্থ বরাদ্দ থাকছে ২ হাজার ২৭৭ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। চলতি বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ আছে এক হাজার ৮৪৪ কোটি ৩২ লাখ টাকা। তবে ভাতার অঙ্ক একশ’ বেড়ে ৬৫০ টাকা করা হচ্ছে। প্রতিবন্ধী ভাতার কার্যক্রমও বাড়ছে। উপকারভোগী ৩২ লাখ ৩৪ হাজার থেকে বেড়ে ৩৪ লাখ ৫০ হাজারে উন্নীত করা হচ্ছে। ভাতার অঙ্ক ৫০ টাকা বাড়িয়ে ৯০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ কার্যক্রম পরিচালনা করতে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে তিন হাজার ৭৫২ কোটি টাকা, চলতি অর্থবছরে এ খাতে তিন হাজার ৩২১ কোটি ৭৭ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা আছে। মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচির মাধ্যমে সমাজে দরিদ্র মাকে ভাতা দেওয়া হয়। আগামী অর্থবছরে এ কর্মসূচিতে এক লাখ ১৫ হাজার ৯২০ জনকে নতুন করে যুক্ত করা হবে। এতে মোট উপকারভোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ১৭ লাখ ৭১ হাজার ২০০ জন। তাদের ভাতার অঙ্ক ৫০ বেড়ে ৮৫০ টাকায় উন্নীত হয়েছে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার মেগা প্রকল্প গ্রহণ না করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এছাড়া বিগত সরকারের সময় রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া প্রকল্পগুলো বাতিল করায় আগামী অর্থবছর প্রকল্পের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। ফলে নতুন অর্থবছরে উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় কমবে। বরাদ্দের দিক থেকে আগামী বাজেটে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি এবং সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে। বাজেটের আকার কমানো হলেও সমাজে বৈষম্য কমানোর পাশাপাশি মূল্যস্ফীতির চাপে নিম্ন আয়ের মানুষদের স্বস্তি দিতে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে উপকারভোগী ও কিছু ক্ষেত্রে ভাতার পরিমাণ বাড়ানোর উদ্যোগ থাকছে নতুন অর্থবছরের বাজেটে। একই সঙ্গে কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। তবে এডিপির আকার কমলেও পরিচালন বা অনুন্নয়ন খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে। নতুন অর্থবছরের বাজেটে এ খাতের ব্যয় ধরা হতে পারে ৫ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রয়েছে ৫ লাখ ৬ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। এদিকে বাজেট ও এডিপির আকার কমলেও রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে।
রেকর্ড রাজস্ব ঘাটতি, ঋণ পরিশোধের চাপ, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্তের বেড়াজালসহ নানা চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়ন করতে যাচ্ছে অন্তর্বতী সরকার। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন এ সরকারের প্রথম বাজেটে জনগণের প্রত্যাশাও বিপুল। বাজেটের আকার কমিয়ে আনার প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে আইএমএফ। আর নতুন বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে প্রধান লক্ষ্য ধরা হয়েছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ।

প্যানেল

×