ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৯ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

গ্রামে ব্যাংকিং সেবা বাড়ছে

ড. মিহির কুমার রায়

প্রকাশিত: ০০:৪১, ২৩ অক্টোবর ২০২২

গ্রামে ব্যাংকিং সেবা বাড়ছে

শহরের তুলনায় গ্রামে আমানত ও ঋণ দুই-ই বাড়ছে

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, শহরের তুলনায় গ্রামে আমানত ও ঋণ দুই-ই বাড়ছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই এই ছয় মাসে গ্রামে আমানত প্রবাহ বেড়েছে ২ দশমিক ১৭ শতাংশ এবং শহরে ১ দশমিক ৯৮ শতাংশ। শহরের তুলনায় গ্রামে আমানত বেশি বেড়েছে শূন্য দশমিক ১৯ শতাংশ।

অপরদিকে গত বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাইয়ে গ্রামে আমানত প্রবাহ বেড়েছিল ৩ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং একই সময়ে শহরে বেড়েছে ২ দশমিক ৬৮ শতাংশ, শহরের চেয়ে গ্রামে আমানত বেশি বাড়ে শূন্য দশমিক ৫৭ শতাংশ। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন সময়ে গ্রামে ঋণপ্রবাহ বেড়েছে ৩ দশমিক ৭৮ শতাংশ, একই সময়ে শহরে বেড়েছে ৩ দশমিক ৩৬ শতাংশ।

ওই সময়ে শহরের চেয়ে গ্রামে ঋণপ্রবাহ বেশি বেড়েছে শূন্য দশমিক ৪২ শতাংশ, গত বছরের একই সময়ে গ্রামে ঋণ বেড়েছিল ১ দশমিক ৮৬ শতাংশ এবং শহরে ২ দশমিক ০৭ শতাংশ এবং এই সময়ে গ্রামের চেয়ে শহরে ঋণপ্রবাহ বেশি বৃদ্ধি পায়। অবশ্য সরকার করোনার ক্ষতি মোকাবিলা এবং বিদ্যমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে গ্রামে ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছে।

যে কারণে এখন গ্রামে ঋণপ্রবাহ বেশি বাড়ছে। প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ব্যাংকের সেবা গ্রামেও বেশ সম্প্রসারিত হয়েছে। শাখার প্রায় অর্ধেক এখন গ্রামে। গ্রামীণ শাখাগুলো থেকে আগে ঋণ বিতরণের ক্ষমতা কম থাকলেও এখন বেড়েছে।
সারাদেশে ব্যাংকগুলোর মোট শাখা রয়েছে ১০ হাজার ৭৯৩টি। এর মধ্যে শহরে শাখা ৫ হাজার ৫৫৪টি এবং গ্রামীণ শাখা ৫ হাজার ২৩৯টি। মোট শাখার সাড়ে ৫১ শতাংশ শহরে এবং গ্রামে সাড়ে ৪৮ শতাংশ। মোট আমানত ও ঋণের সিংহভাগই ঢাকা বিভাগে। এর পরেই রয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগের অবস্থান।

মোট আমানতের ৭৯ শতাংশই শহরের, গ্রামের আমানত ২১ শতাংশ। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৬২, চট্টগ্রাম বিভাগে ২১, খুলনা বিভাগে ৪ দশমিক ২২, রাজশাহী বিভাগে ৪, বরিশাল বিভাগে ১ দশমিক ৮৭, সিলেট বিভাগে ৩ দশমিক ৭৬ এবং রংপুর বিভাগে ২ শতাংশ আমানত রয়েছে। সবচেয়ে কম আমানত ময়মনসিংহ বিভাগে মাত্র দেড় শতাংশ।

মোট ঋণের ৮৯ শতাংশই শহর এলাকায় বিতরণ করা হয়, গ্রামে মাত্র ১১ শতাংশ। ঋণের ৬৮ শতাংশই ঢাকা বিভাগে, চট্টগ্রামে সাড়ে ১৮, খুলনায় ৩ দশমিক ৮১, রাজশাহীতে ৩ দশমিক ৭১, সিলেটে ১ দশমিক ১৪, রংপুরে ২ দশমিক ৩৮ এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ১ দশমিক ৩৬ শতাংশ। সবচেয়ে কম ঋণ বিতরণ করা হয় বরিশাল বিভাগে ১ দশমিক ১২ শতাংশ।

এ ব্যাপারে অর্থনীতিবিদদের মন্তব্য হলো গ্রামে ঋণপ্রবাহ বেশি বাড়ছে এবং এই ধারা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে গ্রামকে অর্থনৈতিক কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা সম্ভব হবে। বর্তমানে অর্থনৈতিক কর্মকা- পরিচালিত হয় শহর থেকে যে কারণে শহরে ঋণ ও আমানত দুটোই বেশি। কিন্তু কৃষি বা শিল্প উৎপাদন সবই গ্রামকেন্দ্রিক, কেননা শিল্পের বেশিরভাগ কারখানাই গ্রামে তথা কৃষি উৎপাদন তো পুরোটাই গ্রামভিত্তিক।’

আগে গ্রামে আমানত বেড়েছে; কিন্তু ঋণ বাড়েনি। ফলে গ্রামের টাকা শহরে চলে এসেছে। এখন গ্রামে আমানত বাড়ার পাশাপাশি ঋণও বাড়তে শুরু করায় গ্রামে টাকার প্রবাহ বাড়বে, যা গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে সহায়ক হবে। করোনার ক্ষতি মোকাবিলায় গ্রামে ঋণপ্রবাহ বাড়াতে নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা বাড়ানো যাচ্ছিল না। কারণ গ্রামে ঋণের চাহিদা কম।

২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে বিশ্বব্যাপী খাদ্যসামগ্রীর দাম বেড়ে যায়, খাদ্য আমদানি করতে গিয়ে বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে পড়ে। তাই বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় দেশে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ জন্য কৃষিভিত্তিক পণ্য উৎপাদনে কম সুদে ঋণ দিতে ২৫ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল গঠন করা হয়েছে।

তৈলবীজ উৎপাদনে গঠন করা হয়েছে আরও ৫ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল। এ ছাড়া চলতি অর্থবছরে ৩১ হাজার কোটি টাকার পল্লী ও কৃষি ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। আরও কিছু তহবিলের আওতায় গ্রামে ঋণপ্রবাহ বাড়ানো হচ্ছে।
দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাম্প্রতিক ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বেসরকারি/ সরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়াতে  উদ্যোগী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। কাজেই এই প্রেক্ষাপটে আমরা যদি গ্রামীণ অর্থনীতিতে কেবল দাতা সংস্থা কর্তৃক বিনিয়োগ কিংবা এর মাধ্যমে উন্নয়নের কথা চিন্তা করি তা হলে দেখা যাবে যে, উন্নয়ন সহযোগীরা তাদের মডেলের মাধ্যমে একটি সময়ের আবর্তে কাজ করে দেয়।

কিন্তু চুক্তি মোতাবেক কাজ সমাপনান্তে সরকারকেই তার প্রাতিষ্ঠানিক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাস্তায়নের দায়িত্ব নিতে হয়। আবার সেগুলো যদি বিনিয়োগ প্রকল্প হয় তখন ঘূর্ণায়মান তহবিল হিসেবে সেগুলো কাজ করে থাকে। কিন্তু দেশ স্বাধীনতার ৫২ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, যে গতিতে গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন হওয়ার কথা ছিল তা হয়ে ওঠেনি কেবল উদ্যোক্তা সৃষ্টির দীনতার কারণে।
গ্রামীণ ব্যাংক কর্তৃক প্রায় ৮৫ লাখ গরিব পরিবারকে ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে তাদের কর্মক্ষমতার উন্নয়নে অবদান রাখছে যার সবটুকুই প্রায় বিনিয়োগ কর্মসূচি যা আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। এখন তাদের স্থায়িত্বশীলতার অবস্থাটা কি হবে যদি গ্রামীণ ব্যাংক তাদের ঋণ সহায়তার দরজাটি বন্ধ করে দেয়।

গ্রামীণ অর্থনীতির একটি বড় খাত হলো শস্য উৎপাদন, পশু পালন, মৎস্য খামার তৈরি, বনায়ন ইত্যাদি। কিন্তু সনাতনী কায়দায় পরিবারভিত্তিক কৃষি কাজে বিনিয়োগের তেমন খুব একটা সুযোগ থাকে না প্রথাগত ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে। আবার গ্রীন হাউসভিত্তিক কৃষি কাজের অপূর্ব সুযোগ থাকলেও উদ্যোক্তা পাওয়া যেমন দুষ্কর অপরদিকে বিনিয়োগ প্রাপ্তির রাস্তাটিও খুব সহজতর নয় অথচ চীন, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কৃষি কাজ করে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে অনেক সফলতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে যা আমরা পারছি না। তার পরও গ্রামীণ অর্থনীতিতে কিছুটা রূপান্তর এসেছে মৎস্য উৎপাদনসহ অন্যন্যা এসএমই সেক্টরে।

×