
ছবিঃ সংগৃহীত
দাবদাহে পুড়ছে চারপাশ। একটু স্বস্তির আশায় কেউ নদীতে, কেউ পুকুরে, আবার কেউ বা সুইমিং পুলে ঝাঁপ দিচ্ছেন। এই প্রচণ্ড গরমে তুলনামূলক ঠান্ডা পানির পরশে ঝাঁপাঝাঁপি করতেও ভুলছেন না অনেকে। কিন্তু এই পানির মধ্যেই লুকিয়ে থাকতে পারে ভয়ঙ্কর এক শত্রু।
একটি অসতর্ক মুহূর্তে যদি পানি নাক দিয়ে ঢুকে যায়—তাহলেই সর্বনাশ। এই শত্রু একবার নাক দিয়ে ঢুকলেই মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত। ধীরে ধীরে আপনার মস্তিষ্ক খেয়ে ফেলবে সে। এর থেকে বাঁচার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। নেই কার্যকর কোনো চিকিৎসাও। বিষয়টি হরর সিনেমার গল্প মনে হলেও, দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটি একেবারে বাস্তব।
এই ভয়ঙ্কর জীবাণুর নাম— ‘ব্রেইন ইটিং অ্যামিবা’ বা ‘মগজখেকো অ্যামিবা’। বৈজ্ঞানিক নাম নিগলারিয়া ফাউলারি (Naegleria fowleri)। এককোষী এই পরজীবী মূলত উষ্ণ মিঠা পানিতে বাস করে। পুকুর, নদী, ঝরনা, হ্রদ এমনকি অপরিষ্কার সুইমিং পুল, স্পা, ওয়াটার পার্ক কিংবা পানির পাইপেও এর অস্তিত্ব থাকতে পারে।
গরম ও আর্দ্র পরিবেশ এই অ্যামিবার বেঁচে থাকার জন্য একেবারে আদর্শ। আমাদের অঞ্চলের আবহাওয়া তাই এটিকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য যথেষ্ট অনুকূল। বিপদের শুরু তখনই, যখন কেউ পানিতে ডুব দেন এবং সেই পানি নাক দিয়ে শরীরের ভেতরে প্রবেশ করে। সেই পানিতে যদি নিগলারিয়া ফাউলারি থাকে, তাহলে তা সরাসরি নাকের মাধ্যমে মস্তিষ্কে পৌঁছে যেতে পারে।
বাংলাদেশেও রয়েছে এই অ্যামিবার অস্তিত্ব
২০১৯ সালে বাংলাদেশের এক কিশোর এই অ্যামিবার আক্রমণের শিকার হয়েছিল বলে রিপোর্ট প্রকাশ হয়। ১৫ বছরের ওই কিশোর নিয়মিত অপরিশোধিত পানিতে নাক পরিষ্কার করত। ধারণা করা হয়, সেখান থেকেই অ্যামিবাটি তার শরীরে প্রবেশ করে। ঘ্রাণ স্নায়ু ব্যবহার করে এটি খুলির ভেতর দিয়ে মস্তিষ্কে প্রবেশ করে এবং ধ্বংস করতে থাকে ব্রেন টিস্যু।
শুরুর দিকে কোনো উপসর্গ না থাকায় রোগী বুঝতে পারেন না সমস্যার গভীরতা। এরপর হঠাৎ করেই দেখা দেয় মাথাব্যথা, জ্বর, বমি, ঘাড় শক্ত হয়ে যাওয়া, বিভ্রান্তি, খিঁচুনি এবং হ্যালুসিনেশনের মতো উপসর্গ। রোগীর দ্রুত কোমায় চলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
রোগটির নাম প্রাইমারি অ্যামিবিক মেনিনগোএনসেফালাইটিস (PAM)। মৃত্যুহার প্রায় ৯৭ শতাংশ। লক্ষণ শুরু হওয়ার এক থেকে পাঁচ দিনের মধ্যেই রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
বিশ্বজুড়ে এখন পর্যন্ত ৪০০’র বেশি রোগী শনাক্ত হলেও বেঁচে ফিরেছেন মাত্র ৯ জন।
ভারতের কিশোরের বাঁচার গল্প
২০২৪ সালে ভারতের কেরালায় ১৪ বছর বয়সী আফনান জসিম PAM-এ আক্রান্ত হয়। কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরেও রোগ শনাক্ত করা যায়নি। অবশেষে তার বাবা জানান, ছেলেটি পুকুরে সাঁতার কাটার পর থেকেই মাথাব্যথা ও খিঁচুনিতে ভুগছে। এরপর বেবি মেমোরিয়াল হাসপাতালের চিকিৎসকরা দ্রুত পিসিআর টেস্ট করে নিগলারিয়া ফাউলারি শনাক্ত করেন এবং মিলটোফোসিনসহ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা শুরু করেন। দ্রুত চিকিৎসা পাওয়ার কারণে আফনান ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে।
প্রতিরোধই প্রধান অস্ত্র
এই রোগ এখনো বিরল, কিন্তু মারাত্মক। আক্রান্ত হলে সময়মতো সঠিক চিকিৎসা না পেলে বাঁচার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তাই সচেতনতাই একমাত্র প্রতিরোধের উপায়।
যা করণীয়:
-
সাঁতার কাটার সময় নাকে যাতে পানি না ঢোকে, সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে।
-
নাক পরিষ্কারের জন্য অবশ্যই ফুটানো ও ঠান্ডা করা পানি ব্যবহার করতে হবে।
-
অপরিষ্কার বা অপরিশোধিত পানিতে সাঁতার কাটা বা ডুব দেওয়া থেকে বিরত থাকুন।
-
ডুব দেওয়ার পর মাথাব্যথা, জ্বর বা খিঁচুনির মতো উপসর্গ দেখা দিলে দেরি না করে চিকিৎসকের কাছে যান।
সিডিসি (CDC) এর তথ্যমতে, মিলটোফোসিন (Miltefosine) নামের একটি ওষুধ কিছু ক্ষেত্রে কার্যকর হতে পারে, তবে এটি দ্রুত ব্যবহার না করলে কোনো কাজেই আসে না।
শেষ কথা
ব্রেইন ইটিং অ্যামিবা হয়তো খুব সহজে ছড়ায় না, কিন্তু একবার শরীরে প্রবেশ করলে তার পরিণতি ভয়াবহ। তাই সচেতনতা, সতর্কতা এবং সময়মতো চিকিৎসাই পারে আমাদের রক্ষা করতে এই নীরব ঘাতকের হাত থেকে।
ইমরান