ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১০ জুন ২০২৫, ২৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

শরীয়তপুরে ‘জ্বীনের মসজিদ’: রহস্যে ঘেরা ৪৫০ বছরের স্থাপনা

বিপ্লব হাসান হৃদয়, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, শরীয়তপুর 

প্রকাশিত: ২১:৪৭, ৯ জুন ২০২৫

শরীয়তপুরে ‘জ্বীনের মসজিদ’: রহস্যে ঘেরা ৪৫০ বছরের স্থাপনা

শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলার নাগেরপাড়া ইউনিয়নের শিবপুর গ্রামে দাঁড়িয়ে আছে এক রহস্যময় মসজিদ, যা এলাকাবাসীর কাছে পরিচিত “জ্বীনের মসজিদ” নামে। এর প্রকৃত নাম তালুকদার বাড়ি জামে মসজিদ হলেও লোকমুখে প্রচলিত কিংবদন্তি, নির্মাণকাজে কোনো মানুষের হাত নেই—এটি নাকি জ্বীনদের তৈরি।

রহস্যঘেরা নির্মাণ ইতিহাস

স্থানীয় প্রবীণরা জানান, মসজিদটি প্রায় সাড়ে চারশ বছর পুরোনো। ইতিহাসের কোনো লিখিত দলিল না থাকলেও মুখে মুখে প্রচলিত আছে, একসময় যেখানে মসজিদটি দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে ছিল অথৈ পানি। এক রাতে সেই পানিতে মাটি ফেলে জ্বীনরা এই মসজিদ নির্মাণ করে। তবে কাজ শেষ হওয়ার আগে নিকটবর্তী গ্রামের এক ব্যক্তি মাছ ধরতে গেলে ভোররাতের আগেই জ্বীনরা মসজিদের কাজ অসমাপ্ত রেখেই চলে যায়। তাই এখনো মসজিদটির কিছু অংশ অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে।

ভয় ও বিস্ময়ের যুগ

মসজিদটি নির্মাণের পর দীর্ঘ ৫০-৬০ বছর কেউ সেখানে নামাজ পড়তে সাহস করেনি। জ্বীনের ভয় এতটাই গভীর ছিল যে মানুষ সেই স্থানের দিকে যেতেও কুঁকিয়ে থাকত। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এলাকার জনবসতি বাড়লে মানুষের ভয় কেটে যায় এবং নামাজ পড়া শুরু হয়। তবুও অনেকেই জানান, নামাজে প্রায়ই অপরিচিত মুখ দেখা যেত—যাদের কেউই চিনতেন না।

স্থাপত্য ও আকৃতি

মসজিদটি নির্মিত হয়েছে প্রায় পাঁচ কাঠা জমির উপর। এক গম্বুজবিশিষ্ট এই চতুর্ভুজ মসজিদের ভেতরে তিনটি কাতার রয়েছে, যেখানে একসঙ্গে ৩০ জন মুসল্লী নামাজ আদায় করতে পারেন। কাতারের বাইরে মসজিদের সামনে একটি প্রাচীন পাঁকা মাঠ আছে, যেটি সাড়ে চারশ বছরের পুরোনো বলে দাবি করা হয়। অতিরিক্ত মুসল্লীরা সেখানে নামাজ পড়েন।

মসজিদের পাশে একটি পুকুর এবং অজুর জন্য সাঁন বাঁধানো ঘাট রয়েছে, যা এর প্রাচীনত্ব ও ঐতিহ্যের সাক্ষ্য দেয়।

লোককথা ও অভিজ্ঞতা

স্থানীয় সালাম তালুকদার বলেন, “আমার দাদা-পরদাদাদের মুখে শুনেছি, মসজিদটির বয়স ৪০০ বছরের বেশি। এখানে আগে কোনো রাজা-বাদশার বাস ছিল না। এই মসজিদ আমরা জঙ্গলের মধ্যেই দেখে আসছি।”

আরেক স্থানীয় সেলিম মৃধা জানান, “ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি এটা জ্বীনের মসজিদ। আমরা নিয়মিত এখানে নামাজ পড়ি। সরকারের কাছে আমাদের অনুরোধ—মসজিদটির যথাযথ সংস্কার ও সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হোক।”

দর্শনার্থী মিতুল বলেন, “আমরা দূরদূরান্ত থেকে ঘুরতে আসি এই রহস্যময় মসজিদ দেখতে। সরকার যদি গবেষণা করে মসজিদের প্রকৃত ইতিহাস বের করত, তাহলে এই স্থানটি একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবেও গড়ে উঠতে পারত।”

রহস্যের ছায়া এখনো

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, প্রায় ২৭-২৮ বছর এক হাফেজ এই মসজিদে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বহুবার রাতের বেলা জ্বীনদের নামাজ পড়তে দেখেছেন বলে দাবি করেন। এমনকি আগে মসজিদের ভেতরে কেউ কিছু বললে সেই শব্দ বারবার প্রতিধ্বনিত হতো—যা অনেকেই জ্বীনের উপস্থিতির প্রমাণ হিসেবে দেখতেন। পরবর্তীতে কিছু সংস্কার করা হলে সেই প্রতিধ্বনি বন্ধ হয়ে যায়।

সংরক্ষণের দাবি

বর্তমানে মসজিদটির সৌন্দর্য্য ও স্থাপত্য ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। স্থানীয়রা মনে করেন, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর যদি এটি নিয়ে গবেষণা ও সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়, তবে মসজিদটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি ঐতিহ্যবাহী নিদর্শন হিসেবে টিকে থাকবে।

Jahan

×