
দোকানে সাজানো হরেক রকম জগার মিষ্টি
জগার মিষ্টি। এক নামেই পরিচয়। আমলা, রাজনীতিক, মন্ত্রী, সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সবাইকে তুষ্ট করতে এর যেন কোনো বিকল্প নেই। প্রতিষ্ঠানের পুরো নাম জগবন্ধু মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। মিষ্টির জন্য এখানে প্রতিদিন বহু দামি ব্রান্ডের গাড়ি ব্রেক কষে। সরকারি-বেসরকারি দপ্তরে আটকে থাকা ফাইলের গতিও সচল করতে জগবন্ধুর মিষ্টির সুনাম রয়েছে। বড় সাহেবকে তুষ্ট করতে এর কোনো জুড়ি নেই। পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলা সদরের নতুনবাজার পুবের গলিতে অবস্থান এই প্রতিষ্ঠানের। যেমন কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত কলাপাড়াবাসীকে বিশ্বের কাছে পরিচিত করেছে, তেমনি জগার মিষ্টিও সুনাম কুড়িয়েছে সর্বত্র। গরুর খাঁটি দুধের ছানা ও চিনির তৈরি জগবন্ধু মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মিষ্টির স্বাদই আলাদা; যা না খেলে কাউকে বোঝানো সম্ভব নয়। জগার মিষ্টির পরিচয় নিজেই।
এ মিষ্টি তৈরির রয়েছে শত বছরের দীর্ঘ ইতিহাস। জড়িয়ে রয়েছে জগবন্ধু হাওলাদারের পরিচিতি। প্রচলিত ছিল এখানে জগার মিষ্টি এক টাকায় চারটি পাওয়া যেত, তাও অনেকে পয়সা দিত না। উদার প্রকৃতির মানুষ ছিলেন জগবন্ধু হাওলাদার। বহু মানুষ বিনা পয়সায় তার মিষ্টি খেয়েছেন। তিনি সবার কাছে জগা দাদু কিংবা কাকু নামে পরিচিত ছিলেন। কখনো রাগ করে কাউকে কিছু বলতেন না।
কখন, কীভাবে, কবে মিষ্টির দোকানটির শুরু হয়েছে তার সঠিক দিনক্ষণ কেউ বলতে পারেননি। তবে এখানকার প্রবীণ মানুষরা বলেছেন, ’৪৭ সালে দেশ বিভাগের আগে কলাপাড়ায় ব্রিটিশ প্রতিনিধি কলোনাইজেশন অফিসার ছিলেন। তার নাম ছিল ডিকে পাওয়ার ডোনাবান। সমাজসেবক ও বাঙালিত্বের তিনি প্রিয় মানুষ ছিলেন। সে সময়ে (সম্ভবত ১৯২০-১৯২৩ সালে) পূর্ববাজারে (বর্তমানে নতুনবাজার পুবের গলি) জগবন্ধু হাওলাদার অন্যের ছোট্ট একটি চায়ের দোকান পরিচালনা করতেন। প্রতিসন্ধ্যায় ওই চায়ের দোকানে আড্ডা দিতেন গণ্যমান্য লোকজনরা। তখনকার এই শহরে থাকা একজন শিক্ষক পিনাকী চক্রবর্তী ও ডোনাবান সাহেবও বসতেন। তাদের উৎসাহেই গড়ে তোলেন মিষ্টির দোকান। পিনাকী বাবু ছিলেন কলকাতার মানুষ। জীবনসায়াহ্নে এসে জগবন্ধু হাওলাদারও এ তথ্য জানিয়েছিলেন।
দুধ দিয়ে ছানা তৈরি করে চিনি ও পানির মিশ্রণে রস (সিরা) দিয়ে বানানো হয় (রসগোল্লা) মিষ্টি। জগবন্ধু হাওলাদারও তাদের কাছ থেকে মিষ্টি বানানোর কৌশল জেনে নেন। তৈরি করেন, করেন বিক্রি। ক্রমশ প্রসার লাভ করে তার দোকানের। বাড়তে থাকে মিষ্টির চাহিদা। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ থাকে এই মিষ্টি। অতিথি আপ্যায়নে জগবন্ধুর মিষ্টি হয়ে ওঠে অপরিহার্য। এরপর কলাপাড়ার বাইরেও ছড়াতে থাকে এর সুনাম। নিজেরা তৃপ্তি ভরে খায়। নিয়ে যায় তাদের স্বজন-পরিজনদের জন্য। এখন দিনভর চলে মিষ্টির বেচাকেনা। প্যাকেটে প্যাকেটে মিষ্টি যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। বিশিষ্ট রাজনীতিক, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা; একবার যারা এই মিষ্টির স্বাদ পেয়েছেন তাদের মেন্যুতে থাকছেই জগার মিষ্টির তালিকা। তবে সন্ধ্যেবেলায় পাওয়া যায় গরম গরম মিষ্টি। কুয়াকাটায় যারাই আসেন তাদের একটি বড় অংশ জগার মিষ্টি নিতে ভোলেন না। অধিকাংশ কর্মকর্তাই অফিস ভিজিট, ট্যুরসহ বিভিন্ন প্রোগ্রামে এলে তাদের মনে না থাকলেও এখানকার (অধঃস্তন) কর্মকর্তারা স্যারকে খুশি করতে জগার মিষ্টি খাওয়াতে কিংবা সঙ্গে দিয়ে দিতে ভোলেন না। জগবন্ধু হাওলাদার নেই। পরলোকে গেছেন ১৯৯১ সালে। শক্ত হাতে দোকানের হাল ধরেছেন বড় ছেলে নিখিল চন্দ্র হাওলাদারসহ অন্যরা। রেখে গেছেন যোগ্য অনেক কারিগর। তখন প্রধান কারিগর ছিলেন নেপাল চন্দ্র। তিনিও ইহলোক ছেড়েছেন। এখন রয়েছে অসংখ্য উদ্যমী কারিগর। নিখিল চন্দ্রের মতে, তাদের এই দোকানের বয়স অন্তত শত বছর। দেখালেন তার বাবার ব্যবহারের কাঠের তৈরি শত বছরের পুরনো ক্যাশবাক্সটি সযত্নে কাউন্টারের ডান পাশেই রেখেছেন। দৈনিক কী পরিমাণ কিংবা কত সংখ্যক মিষ্টি বিক্রি হয় এটির সঠিকভাবে জানাতে না পারলেও ভালোই বেচাকেনা হয় বলে জানান নিখিল চন্দ্র হাওলাদার। তবে খাঁটি দুধের সংকটের কথা জানালেন। বেশি দামে সংগ্রহ করতে হয়।
সব জিনিসের দামও এখন অনেক বেশি বলে দাবি তার। খরচ বহুগুণে বেড়ে গেছে। তারপরও বাবার ঐতিহ্য ও মানসম্পন্ন মিষ্টি এখনো তারা তৈরি করছেন বলে নিশ্চিত করেন। কলাপাড়ার একজন গুণী মানুষ, খেপুপাড়া সরকারি মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বাংলা বিষয়ের অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র শিক্ষক আব্দুল খালেক জানান, শত বছরের এই মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের স্বত্বাধিকারী প্রয়াত জগবন্ধু হাওলাদার এখানকার কয়েক প্রজন্মের দাদা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তার সবচেয়ে বড় গুণ ছিল- ওনার জীবদ্দশায় প্রতিদিনের তৈরি করা কোয়ালিটি সম্পন্ন মিষ্টি ক্রেতার কাছে তুলে দিতেন।
যদি কখনো একদিনের বানানো মিষ্টি পরের দিন অবিক্রীত থাকত তা আর বিক্রি করতেন না। তিনি কাস্টমারের জন্য এতটাই স্যাক্রিফাইস করতেন। আর ওনার মিষ্টি বিনা পয়সায় না খেয়েছে তখনকার সময় এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যেত না। তবে তার উত্তরসূরিরা এখনও সেই সুনাম ধরে রেখেছেন। এটি কলাপাড়ার মানুষের জন্য একটি ভালো দৃষ্টান্ত।
জানা গেছে, পাকিস্তান আমলে ১ টাকায় ৮টি রসগোল্লা বিক্রি হতো। স্বাধীনের পরে টাকায় ৪টি। পরে ২টাকা করে বিক্রি হয়। পরে ৫ টাকা। বর্তমানে সাইজ ভেদে ২০-৩০ টাকা। তবে রসমালাইসহ অন্য মিষ্টির দাম আরো বেশি। অনেক সময় মিষ্টির সংকট পড়ে যায়। বহুজনে আগাম অর্ডার দেন। এখানকার রসমালাই-সন্দেশও খুব স্বাদের। থাকে হরেক রকম মিষ্টি। পথ চেনেন না এমন অনেক লোকজন এসে খোঁজেন জগার মিষ্টির দোকান কোনটি। আজ এই মিষ্টির দোকানের মূল উদ্যোক্তা নেই। তবুও ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন উত্তরসূরিরা। জগবন্ধু মিষ্টান্ন ভাণ্ডার তার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে সুনামের সঙ্গে। আপনিও খেতে কিংবা পরিজনের জন্য নিতে ভোলেন না যেন। জগবন্ধু মিষ্টান্ন ভাণ্ডার এখন কলাপাড়ার ঐতিহ্য ও গৌরবময় ইতিহাসের অধ্যায় হয়ে আছে। আর এর সুখ্যাতিও বাড়ছে দিনকে দিন।
প্যানেল