ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২১ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

চট্টগ্রামে ব্যাটারিচালিত  অটোরিক্সা নিয়ন্ত্রণহীন

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২০:৪৬, ১০ মে ২০২৪

চট্টগ্রামে ব্যাটারিচালিত  অটোরিক্সা নিয়ন্ত্রণহীন

মহাসড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অটোরিক্সা

কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না বেপরোয়া গতির ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সা। প্রায়ই ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। প্রথম দিকে নগরের বিভিন্ন অলি-গলিতে চলাচল করলেও এখন মহাসড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এসব অটোরিক্সা। এতে একদিকে যেমন বিদ্যুতের অপচয় হচ্ছে, অন্যদিকে বাড়ছে কিশোর অপরাধ।
কিছুদিন আগেও এসব অটোরিক্সা অলি-গলি থেকে মূল সড়কে এলেই পুলিশ তাড়া করত। সেই অটোরিক্সা এখন মহাসড়কেও চলছে। অনেকে অটোরিক্সার সামনে বেঁধে রাখছে ক্র্যাচ (যা বগলের নিচে রেখে ভর দিয়ে খোঁড়া লোকেরা চলাচল করে)। নগরে প্রায় ৩০ হাজার ব্যাটারিচালিত রিক্সা চলাচল করছে। পুলিশ ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের টাকা দিয়ে তারা রাস্তায় নামে। প্রতিবন্ধী সেজে সহানুভূতি আদায় করে। অনেকে আবার টোকেন দিয়ে মহাসড়কে চালাচ্ছে এসব অবৈধ অটোরিক্সা। যার কারণে ঘটছে দুর্ঘটনা, যাচ্ছে প্রাণ।  
বাকলিয়া এক্সেস রোড নামে পরিচিত জানে আলম দোভাষ সড়কটি নগরের যানজট কমানোর পাশাপাশি দক্ষিণ চট্টগ্রামের সঙ্গে নগরের যোগাযোগ সহজ করার জন্য নির্মাণ করা হয়। কিন্তু এ সড়কে এখন ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সার জন্য অন্য গাড়ি চালানো দায়। সড়কের দুই প্রান্তে প্রতিনিয়ত ২০ থেকে ৩০টি অটোরিক্সা জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এতে চকবাজার থেকে আন্দরকিল্লামুখী ও আন্দরকিল্লা থেকে চকবাজারমুখী গাড়িগুলো সবসময় যানজটের মুখোমুখি হচ্ছে। এ ছাড়া এসব অটোরিক্সার চালকদের কারণে  স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা পড়ছে বিড়ম্বনায়।  
অভিভাবকরা বলছেন, যে পরিমাণ বেপরোয়া গতিতে ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সাগুলো চলে তা দেখার যেন কেউ নেই। প্রায় সময় উঠতি বয়সী চালকরা মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে। এক্সেস রোডের দুই মুখে বিশেষ করে চকবাজারের দিকের মুখে ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সার কারণে যানজট লেগেই থাকে। এ সড়ক তৈরি করা হয়েছে যাতায়াতের সুবিধার জন্য। আর সেই সড়কই এখন বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। রেহাই পাচ্ছে না গার্মেন্টসকর্মীরাও। পথ আগলে ধরে প্রেমের প্রস্তাবসহ নানাভাবে হয়রানি করছে তারা।
চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি হাটহাজারী-নাজিরহাট মহাসড়কের মিরেরহাট সংলগ্ন বড়ুয়াপাড়া এলাকায় প্রাইভেটকার ও ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সার মুখোমুখি সংঘর্ষে মো. রফিক (৬০) নামে এক বৃদ্ধ নিহত হন। গত ১৯ মার্চ উপজেলা সদরের বাসস্টেশন এলাকায় বেপরোয়া গতিতে আসা মোটরসাইকেলের সঙ্গে অটোরিক্সার মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই যাত্রী আহত হন। ১৪ এপ্রিল ফটিকছড়ি উপজেলার ঝংকার মোড়ে রাস্তা পারাপারের সময় চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস লেগে আহত হন এক কলেজছাত্রী। ২৭ মার্চ নগরের চকবাজার প্যারেড কর্নারে দাঁড়িয়ে থাকা মোটরসাইকেলে ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে যায় অটোরিক্সার চালক। এতে মোটরসাইকেলের পেছনের অংশ দুমড়ে-মুচড়ে যায়। আহত হন মোটরসাইকেলে থাকা রিজভী ও তার ভাগিনা আব্দুল্লাহ। প্রায়ই এ রকম দুর্ঘটনায় অনেকে হতাহত হলেও রিক্সাগুলো বন্ধে কোনো ব্যবস্থা নেই।
বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ দিয়ে নগরের হামজারবাগ এলাকার বিভিন্ন স্থানে এসব অটোরিক্সায় চার্জ দেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। শুধু হামজারবাগই নয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জিরো পয়েন্টসংলগ্ন পাহাড়ি হাউজিং সোসাইটির রাস্তায় টিন শেড একটি কক্ষে অবৈধ সংযোগ থেকে ৪০ থেকে ৫০টি অটোরিক্সায় চার্জ দেওয়া হয়। সাধারণত একটি অটোরিক্সা চালানোর জন্য চার থেকে পাঁচটি ১২ ভোল্টের ব্যাটারি প্রয়োজন। প্রতি সেট ব্যাটারি চার্জের জন্য গড়ে ৯০০ থেকে ১১০০ ওয়াট হিসাবে পাঁচ থেকে ছয় ইউনিট বিদ্যুৎ খরচ হয়। ৮০ ভাগ গ্যারেজে মূল সংযোগ থেকে তার দিয়ে চুরি করে বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয়।  
জানা যায়, চান্দগাঁও, বাকলিয়া, বায়েজিদ, খুলশী, কোতোয়ালি, পাহাড়তলী, হালিশহর, আকবরশাহ থানা এলাকায় বেশি চলে ব্যাটারিচালিত রিক্সা। চান্দগাঁও মৌলভীবাজার থেকে কালুরঘাট ব্রিজ এবং ওয়াসা রোড, পাঠাইন্না গোদা থেকে হামিদচর, ওসমানিয়াপুল থেকে সিঅ্যান্ডবির আশপাশের এলাকায় তিন-চার হাজার রিক্সা চলাচল করে।  
বাকলিয়া থানাধীন এক্সেস রোড, চকবাজার ধুনিরপুল থেকে সৈয়দ শাহ রোড ও বড় কবরস্থান, পুলিশ বিট, আব্দুল লতিফ হাট থেকে চেয়ারম্যান ঘাট এবং আন্দরকিল্লা ও টেরিবাজার থেকে কালামিয়া বাজার পর্যন্ত পাঁচ হাজার রিক্সা চলাচল করে। চকবাজার এলাকার ডিসি রোড, কেবি আমান আলী রোড, নবাব সিরাজউদ্দৌলা রোড এবং এক্সেস রোডে চলাচল করে কয়েক হাজার ব্যাটারিচালিত রিক্সা। খুলশী থানাধীন জালালাবাদ থেকে ওয়্যারলেস হয়ে সেগুনবাগান রেলওয়ে স্কুল, বিজিএমইএ ভবনের সামনে থেকে ঝাউতলা বাজার হয়ে আমবাগান রেলগেট, সাউদার্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এলাকা থেকে পলিটেকনিক মোড় পর্যন্ত দুই-তিন হাজার রিক্সা চলাচল করে।  বায়েজিদ জামশেদ শাহ মাজার রোড, কুলগাঁও আবাসিক এলাকা হতে খাজা রোড, অক্সিজেন মোড় থেকে আতুরার ডিপু, চন্দ্রনগর, আরেফিন নগর, বাংলাবাজার টেক্সটাইল মোড় ও হিলভিউ আবাসিক এলাকা, রৌফাবাদ কলোনি, বাংলাবাজার বশর কোম্পানির গ্যারেজ পর্যন্ত তিন-চার হাজার ব্যাটারিচালিত রিক্সা চলছে। হালিশহর ও পাহাড়তলী থানাধীন ফইল্যাতলী বাজার থেকে সবুজবাগ পেট্রোল পাম্পের মুখ, হালিশহর বি-ব্লক শাহজাহান বেকারি এলাকা, শারীরিক শিক্ষা কলেজ থেকে সাগরপাড়, আইয়ুব খানের গ্যারেজ থেকে পাহাড়তলী থানা এলাকার সাগরিকা রোড, বেপারিপাড়া কাসেম কোম্পানির গ্যারেজ হয়ে আগ্রাবাদ আবাসিক এলাকার সড়কে দুই হাজারের অধিক ব্যাটারিচালিত রিক্সা চলাচল করছে বলে জানা গেছে।  
প্রতিটি রিক্সা থেকে গ্যারেজ মালিকরা চাঁদা বাবদ ১৫০-১৮০ টাকা আদায় করেন। এ টাকা গ্যারেজ মালিক, লাইনম্যান, নেতা ও পুলিশের মধ্যে ভাগ হয়। মালিকরা লাভবান হলেও ব্যাটারিচালিত রিক্সায় চড়তে গিয়ে ঝুঁকিতে পড়ছেন যাত্রীরাই। হঠাৎ ব্রেক করলে ঘটছে দুর্ঘটনা।
সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) প্রকৌশলী আবদুল মান্নান মিয়া বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে আমরা অবগত আছি। খুব শীঘ্রই চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ এবং আমাদের সমন্বয়ে অভিযান পরিচালিত হবে।
২০১৪ সালে ঢাকা ও চট্টগ্রামে ব্যাটারিচালিত রিক্সা বন্ধের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। ২০১৭ সালে এসব পরিবহন বন্ধে আরেক দফা নির্দেশনা আসে। ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর অটোরিক্সা বন্ধ ও আমদানি নিষিদ্ধ করেন সর্বোচ্চ আদালত।
ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সা বন্ধসহ ১৩ দফা দাবিতে চট্টগ্রামে সিএনজি অটোরিক্সার মালিক ও চালকরা সমাবেশ করেছেন বিভিন্ন সময়ে। তারা সিটি মেয়র, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ কমিশনার বরাবর স্মারকলিপিও দিয়েছিলেন।

×