ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৯ মে ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

রঘু রাইয়ের আলোকচিত্রে একাত্তরের মর্মস্পর্শী দিনলিপি

​​​​​​​সংস্কৃতি প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২২:১৬, ৫ মে ২০২৪

রঘু রাইয়ের আলোকচিত্রে  একাত্তরের মর্মস্পর্শী  দিনলিপি

ছবি দেখছেন দর্শনার্থীরা

সাদা-কালো মাধ্যমে ধারণ করা হয়েছে ছবিগুলো। প্রতিটি আলোকচিত্রে রয়েছে আলো-ছায়ার খেলা। চোখে মায়া ছড়ানো সেসব ছবিতে মূর্ত হয়েছে ঐতিহাসিক এক অধ্যায়। সেটি হচ্ছে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ। আর বাঙালি জাতিসত্তার সংগ্রাম, ত্যাগ গৌরবময় সে অধ্যায়ের নানা মুহূর্তকে ক্যামেরাবন্দি করেছেন রঘু রাই। একাত্তরে মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সঙ্গে পায়ে হেঁটে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করেন বিশ্বখ্যাত এই ভারতীয় আলোকচিত্রী। এরপর তিনি অসংখ্য চিত্র ধারণ করেন। অসীম সাহসে ভর করে রণাঙ্গনের যোদ্ধাদের ছবি ফ্রেমবন্দি করেন। সেই সুবাদে তার ক্যামেরাবন্দি হয়েছে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযানে যাওয়ার পূর্বের মুহূর্ত। আছে নয় মাসের লড়াই শেষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের উচ্ছ্বাসময় মুহূর্তের ছবি। রণাঙ্গন চষে বেড়ানোর সমান্তরালে শরণার্থী জীবনের দুর্দশাকেও ফ্রেমবন্দি করেছেন।

তুলে এনেছেন বাস্তুহারা মানুষের বেদনার্ত জীবনের ছবি। সেখানে ধরা দিয়েছে নারী-শিশু থেকে বৃদ্ধ কিংবা বৃদ্ধার যন্ত্রণাকাতর মুখচ্ছবি। এভাবেই আলোকচিত্রে ঐতিহাসিক সময়ের মর্মস্পর্শী বয়ান মেলে ধরেছেন পদ্মশ্রী পুরস্কারজয়ী এই আলোকচিত্রী। মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি মেলে ধরা সেই ছবিগুলো ঝুলছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের জয়নুল গ্যালারিতে। পূর্বে প্রদর্শিত হয়নি এমন বেশিরভাগ অপ্রদর্শিত ছবি নিয়ে চলছে প্রদর্শনী। রাইজ অব নেশন শিরোনামের প্রদর্শনীটির কিউরেট করেছেন শিল্পী জিহান করিম। চারুকলা অনুষদের ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে যৌথভাবে প্রদর্শনীটির আয়োজন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দুর্জয় বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন (ডিবিএফ) স্বাধীনতা সংগ্রামের ফটোগ্রাফিক রেকর্ডে পরিণত হওয়া এসব ছবিসহ রঘু রাইয়ের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আরও ছবির সম্মিলনে বই প্রকাশ প্রকাশ করেছে ডিবিএফ।

রবিবার এই শিল্পায়োজনের সূচনা হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক। বিশেষ অতিথি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ডা. সারওয়ার আলী, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের উপাচার্য রুবানা হক, স্কয়ার গ্রুপের পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী এবং ডিবিএফের প্রতিষ্ঠাতা দুর্জয় রহমান। সভাতিত্ব করেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফ। স্বাগত বক্তব্য দেন চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন।

মোজাম্মেল হক বলেন, হানাদারদের হাত থেকে বাঁচতে প্রায় কোটি মানুষ ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। সেই চিত্র যারা স্বচক্ষে দেখেননি তাদের বোঝানো কঠিন। আলোকচিত্রী রঘু রাই তার ছবির মাধ্যমে সেই দিনগুলো মেলে ধরেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এমন ছবি তোলা সহজ ছিল না। এসব ছবিতে স্বাধীনতা সংগ্রামের সেই খরস্রোতা সময় উঠে এসেছে। বাঙালির ওপর হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের অকাট্য প্রমাণ হয়ে উঠেছে কিছু ছবি। সে প্রেক্ষাপটে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য আমরা যে আবেদন করছি সে ব্যাপারে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে এসব আলোকচিত্র।

ডা. সারওয়ার আলী বলেনবর্তমানে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের তৃতীয় প্রজন্ম চলছে। যারা স্বাধীন দেশে জন্মগ্রহণ করেছে তাদের মুক্তিযুদ্ধের কাছে ফিরে যাওয়া দরকার। এখানে দুই ধরনের ছবি আছে। একটা মানুষের দুর্দশার। সল্ট লেকের পরিত্যক্ত স্থানে শরণার্থীদের দুর্বিষহ জীবনচিত্র উঠে এসেছে এসব ছবিতে। আরেকটি উল্লাসের। পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের ছবি। সঙ্গে রয়েছে মুক্তিবাহিনী বীরত্বগাথার চিত্র। আছে বাংলাদেশের বিজয় অর্জনে মিত্রবাহিনীর সংগ্রামী ভূমিকার চিত্র।  এই ধরনের প্রদর্শনী নতুন প্রজন্মকে যেমন মুক্তিযুদ্ধের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে তেমনি দেশ গঠনে একাত্তরের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে সবাইকে। পাশাপাশি এই ছবিগুলো গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে ভূমিকা রাখবে।

অঞ্জন চৌধুরী বলেন, বইটার কিছু অংশ যখন দেখেছি তখন আমি সেই সময়ে চলে গেছি। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া একটা বিরল সুযোগ। এটা সবার ভাগ্যে ঘটেনি। রঘু রাই সেই সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন এবং সেই সময়কে তুলে ধরেছেন। তাই আমাদের এবং নতুন প্রজন্মের জন্য এই বইটি গুরুত্বপূর্ণ।

দুর্জয় রহমান বলেন, প্রদর্শনীর অনেক ছবি সম্প্রতি চিহ্নিত হয়েছে। কেন এত সময় লাগল আমি জানি না। পোস্ট কভিডের পরে দুটো ছবি সংগ্রহ করে রঘু রাইয়ের সঙ্গে দেখা করি, তখন তিনি একটু ইতস্তত করেছিলেন। পরে এই বই করতে তিন থেকে সাড়ে তিন বছর লেগেছে।

 নিসার হোসেন বলেন, বিশ্বমানের শিল্পীর কাজ কীভাবে বিশ্বমানের করে উপস্থাপন করতে হয় তা আমরা দেখছি এই প্রদর্শনীতে। এটি একটি বিস্ময়। চারুকলার ৭৫ বছর পূর্তি আয়োজনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে থাকবে এই প্রদর্শনী।

নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, আমাদের আনন্দের পিঠে বেদনা আছে। রঘু রাইয়ের ছবিগুলো সে কথাই বলে। সময়কে ধরে সময়কে অতিক্রম করেছে। আর শিল্পকর্ম যখন সময়কে অতিক্রম করে তখন কালোত্তীর্ণ হয়ে যায়।

স্বাধীনতার ৫৩ বছর পূর্তি উপলক্ষে ৫৩টি আলোকচিত্রে সজ্জিত এই প্রদর্শনী চলবে ১৯ মে পর্যন্ত। সকাল ১১টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের উন্মুক্ত থাকবে।

প্রসঙ্গত, মুক্তিযুদ্ধের ওপর প্রশংসনীয় কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ভারত সরকারের বেসামরিক সম্মাননা পদ্মশী অর্জন করেন রঘু রাই।

×