‘একদিন সকালে আমি ও রেণু বিছানায় বসে গল্প করছিলাম। হাচু ও কামাল নিচে খেলছিল। হাচু মাঝে মাঝে খেলা ফেলে আমার কাছে আসে আর ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ বলে ডাকে। কামাল চেয়ে থাকে। একসময় কামাল হাছিনাকে বলছে, ‘হাচু আপা, হাচু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি।’ আমি আর রেণু দু’জনই শুনলাম। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে গিয়ে ওকে কোলে নিয়ে বললাম, ‘আমি তো তোমারও আব্বা।’ কামাল আমার কাছে আসতে চাইত না। আজ গলা ধরে পড়ে রইল। বুঝতে পারলাম, এখন আর ও সহ্য করতে পারছে না। নিজের ছেলেও অনেক দিন না দেখলে ভুলে যায়! আমি যখন জেলে যাই তখন ওর বয়স মাত্র কয়েক মাস। রাজনৈতিক কারণে একজনকে বিনা বিচারে বন্দী করে রাখা আর তার আত্মীয়স্বজন ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে দূরে রাখা যে কত বড় জঘন্য কাজ তা কে বুঝবে? মানুষ স্বার্থের জন্য অন্ধ হয়ে যায়।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রচিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থের উল্লিখিত পঙ্ক্তিটি পাঠ করলে এক যুগেরও দীর্ঘসময় বঙ্গবন্ধুর বন্দী জীবনের যে যন্ত্রণাগাথা, তা অনুধাবনে ন্যূনতম বিবেকবান মানুষ অবশ্যই আবেগ তাড়িত হবেন। অধিকন্তু অশ্রুসজল নয়নে স্বাধীনতার বিশাল প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর আত্মত্যাগের ক্যানভাস বিশ্লেষণে নিজেকে নিবেদন করবেন- এটিই প্রত্যাশিত। বঙ্গবন্ধু রচিত উল্লিখিত অসাধারণ গ্রন্থের প্রতিটি পৃষ্ঠায় বাঙালী জাতির আত্মপ্রত্যয়, অধিকার আদায় এবং সকল ক্ষেত্রে বঞ্চনার বিরুদ্ধে দ্রোহের প্রতিধ্বনি করুণ অনুরণনে উদ্ভাসিত হয়েছে। জীবন মরণ অবিচল আন্দোলন-সংগ্রাম ও বাঙালীর বিরুদ্ধে সামরিক, বেসামরিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক নানাবিধ ষড়যন্ত্রের নির্দয় পটভূমি এবং সামগ্রিক ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর উপলব্ধি, উর্বর চিন্তা-চেতনা, নিখাঁদ দেশপ্রেম ও বাংলার মাটি-মানুষের প্রতি মমত্ববোধ এবং সার্বিক অঙ্গীকার বিশ্লেষণে তাঁর মহান আত্মত্যাগ ভাস্বর হয়ে উঠে।
ইউরোপের নাট্যজগতে শেক্সপিয়ারের পর যিনি সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি হলেন হেনরিক ইবসেন। সমাজের তথাকথিত উঁচুতলার ক্ষমতাবান মানুষের শোষণ প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে শোষিতের যন্ত্রণার উচ্চারণকে বিকশিত করার লক্ষ্যে তিনি“অহ ঊহবসু ড়ভ ঃযব চবড়ঢ়ষব’ নাটকটি রচনা করে নির্যাতিত সমাজকে যে বার্তাটি পৌঁছনোর চেষ্টা করেছিলেন তা ছিল ‘The strongest man in the world is the man who stands most alone.’ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পাঠসমাপ্তে ইবসেনের নাটকের বার্তাটি সবচেয়ে প্রণিধানযোগ্য বিষয়ে বিবেচিত হয়। অসামান্য সাহসী মহাপুরুষ হিসেবে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং বাঙালী জাতির অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর মতো এত ত্যাগ-বিসর্জন অন্য কারও পক্ষে সম্ভব হয়নি। এজন্য বঙ্গবন্ধু বাঙালী জাতির মহান কিংবদন্তি নেতা ও বাঙালী জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান।
ইতিহাসের স্রোত যে বিকল্প কোন অপকৌশলে শাসক-শক্তির ইচ্ছের অনুকূলে প্রবাহিত করা যায় না অথবা ইতিহাস যে কারও ক্রীতদাস নয়, সমাজ-সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় ইতিহাসে বারবারই সেই অমোঘ সত্যই প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য- ‘ইতিহাসের শিক্ষাই হচ্ছে এই যে কেউ ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে না।’ বস্তুতপক্ষে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির নগ্ন দাপটে সামরিক শাসক গোষ্ঠীর ধর্মান্ধ এবং পাকিস্তান প্রীতির প্রতি আনুগত্যের বিকাশই প্রতিফিলিত হয়েছিল। প্রকৃত ইতিহাস উন্মোচনে জাতিকে বিশেষ করে জাতির তরুণ প্রজন্ম-শিশু-কিশোরদের হৃদয়গভীরে প্রোথিত করার লক্ষ্যেই স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর বিশাল ও বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক-প্রশাসনিক অপরিমেয় সফল অধ্যায়ের কিছু বিষয় নতুন করে উপস্থাপনের প্রাসঙ্গিকতা এখনও কার্যকর।
১৯৭২ সালের বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানের মূলনীতি বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাতিস্তম্ভ তথা গণতন্ত্র, বাঙালী জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর বৈশিষ্ট্য প্রতিষ্ঠায় বাঙালীর সকল নিপীড়ন-নির্যাতন-বিসর্জন আড়াল করে পরাজিত পাকিস্তান ধারার প্রচলন ঘটানোর ষড়যন্ত্রের ফসল হিসেবে ঘটানো হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। মূলত স্বাধীনতা অর্জনের পরবর্তী পর্যায়ে কোন সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী গোষ্ঠী কোনভাবেই কোথাও কোন সক্রিয় ভূমিকা পালন করার ক্ষমতা রাখেনি। সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উশৃঙ্খলতা-বিশৃঙ্খলতা সৃষ্টি করে হটকারী বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ধারক-বাহকরা যে বঙ্গবন্ধু হত্যার ক্ষেত্র তৈরি করেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এটি সর্বজনবিদিত যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে যে কলঙ্ককজনক কালো সামরিক অধ্যায় সূচনা, তারই ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাজিত বাহিনীর কূট প্ররোচনায় তৎকালীন সামরিক রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৭৮ সনের ২য় ঘোষণাপত্র আদেশ নং- ৪ এর দ্বিতীয় তফসিল বলে সন্নিবেশিত সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানে অতি জঘন্য ও ন্যক্কারজনকভাবে ইতিহাসের সাবলীল ও শাশ্বত ধারাকে পাল্টানোর অশুভ প্রয়াস অব্যাহত ছিল।
পবিত্র সংবিধানের শুরুতেই যে প্রস্তাবনা লিপিবদ্ধ ছিল, তার দ্বিতীয় লাইনে ‘জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রাম (a historic struggle for national libaration)’ উল্লেখের মাধ্যমে মহান মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে সকল আন্দোলন সংগ্রামকে স্বীকৃতি দেয়ার অভূতপূর্ব যুক্তি ও চেতনা সক্রিয় ছিল। ১৯৭৮ সালে সংবিধানে সন্নিবেশ করা হয়- ‘জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধ’ (a historic war for national independence) এবং এর মাধ্যমে ১৯৭১ সালে চূড়ান্তভাবে সংঘটিত মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামকে শুধু নয় মাসের একটি নির্দিষ্ট সময়ের ফ্রেমে বন্দী করার ঘৃণ্য-কদর্য অপকৌশলের আশ্রয় নেয়া হয়। যার প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ সংগ্রামী জীবন, জেল-জুলুম, নির্যাতন-নীপিড়ন এবং ত্যাগ-তিতিক্ষার যে গৌরবগাথা, তাকে ম্লান-মলিন করার জন্য ইতিহাস বিকৃতির অনাকাক্সিক্ষত-অনভিপ্রেত ও অশুভ ষড়যন্ত্রের অবাঞ্চিত যাত্রা শুরু হয়।
বঙ্গবন্ধুর শ্রেষ্ঠত্ব - তিনি শুধু বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের একজন স্বপ্নদ্রষ্টাই ছিলেন না, অনন্যসাধারণ এক ঐক্যের বন্ধনে বাঙালী জাতিকে একতাবদ্ধ করে হাজার বছরের বাঙালী জাতির স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদান করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আগে ও পরে বহু খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ এসেছেন কিন্তু এমন করে কেউ বাঙালীকে জাগাতে পারেননি। তাই বঙ্গবন্ধুকে প্রতিষ্ঠার জন্য শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজন পড়ে না, তেমনি তাঁকে ইতিহাস থেকে নির্বাসিত করাও অসম্ভব। ভারতের মহাত্মা গান্ধী, যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন, চীনের মাও সেতুং, ভিয়েতনামের হো চি মিন, কিউবার ফিদেল ক্যাস্ট্রো, ঘানার পেট্রিস লুমাম্বা ও কওমী নক্রুমা, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, সোভিয়েত ইউনিয়নের লেনিন, যুগোস্লাভিয়ার মার্শাল টিটোর মতো বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তাঁর অবদানের জন্য বিশ্ব- ইতিহাসের এক অনিবার্য স্থানে যথার্থই মর্যাদাসীন হয়ে আছেন।
বঙ্গবন্ধুকে স্বীকৃতি দিতে গিয়ে ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট লন্ডনের ‘দি ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস’ উল্লেখ করেছিল, “এই করুণ মৃত্যুই যদি মুজিবের ভাগ্যে অবধারিত ছিল তাহলে বাংলাদেশের জন্মের মোটেই প্রয়োজন ছিল না”। ১৯৭৫ এর ২৮ আগস্ট তারিখে লন্ডনের ‘দি লিসনার’ পত্রিকায় বিবিসির সংবাদদাতা ব্রায়ান ব্যারন এর ভবিষ্যতবাণী- ‘বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের হৃদয়ে উচ্চতর আসনেই অবস্থান করবেন। তাঁর বুলেট-বিক্ষত বাসগৃহটি গুরুত্বপূর্ণ ‘স্মারক-চিহ্ন এবং কবরস্থানটি পূণ্যতীর্থে’ পরিণত হবে’ আজ সত্যবাণীতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের সর্বজনশ্রদ্ধেয় প্রগতিশীল সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী আবুল ফজলের ভাষায়, ‘বাংলাদেশের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় ও সর্বাধিক উচ্চারিত নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের ইতিহাসের তিনি শুধু নির্মাতা নন, তার প্রধান নায়কও। ঘটনাপ্রবাহ ও নিয়তি তাঁকে বার বার এ নায়কের আসনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। বলা যায়, যেন হাত ধরে টেনে নিয়ে গেছে। শত চেষ্টা করেও তাঁর নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যাবে না। ইতিহাস দেয় না তেমন কিছু করতে। ইতিহাস নিজের অঙ্গ নিজে করে না ছেদন। শেখ মুজিব ইতিহাসের তেমন এক অচ্ছেদ্য অঙ্গ। বাংলাদেশের শুধু নয়, বিশ্ব-ইতিহাসেরও।’
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়