
বিশ্বায়নের বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রায় প্রতিটি জাতিরাষ্ট্রই গণতন্ত্রকে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রধান নিয়ামক হিসেবে গ্রহণ করেছে। অধুনা উন্নয়নশীল দেশসমূহে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার রাজনৈতিক অঙ্গীকার প্রায় প্রতিটি দলেরই আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ব্যক্তি মানুষের স্বাধীনতা এবং সৃজনশীলতার প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ প্রতিটি রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্রের মৌলিক বিষয় হওয়া সত্তে¡ও এর প্রতিফলন কতটুকু প্রায়োগিক প্রাসঙ্গিকতায় গ্রহণযোগ্য, তা বিচার-বিশ্লেষণের দাবি রাখে। বিংশ শতাব্দীর সংঘটিত নানা ঘটনা প্রবাহের পর্যালোচনায় দেখা যায় মুক্তসমাজ প্রতিষ্ঠার বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক শিখরের গভীরে প্রোথিত ছিল মানবজাতির আইনের শাসন, সীমিত সরকার ও ক্ষমতার ভারসাম্যের চিন্তা-চেতনা-ধারণার সমন্বিত প্রয়াস। এরই ভিত্তিতে বিভিন্ন স্বৈরতন্ত্রের ঘৃণ্য নীতিমালাকে পর্যুদস্ত করে গণমানুষের ইচ্ছাশক্তি, ঋজুতা ও সৃষ্টিশীলতার অবারিত ক্ষেত্র মানবতাবাদের বিজয়কে নিশ্চিত করেছে। এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, মানবিক মর্যাদা-পরমতসহিষ্ণুতা, পরশ্রীকাতরতা-প্রতিহিংসাপরায়ণতা সংহার করে পর্যাপ্ত আলোচনা-আপোস-সমঝোতার ভিত্তিতে নাগরিক স্বাধীনতা ভোগের উদ্দেশ্যেই রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও কার্যক্রম সচল থাকে। জনগণের স্বাভাবিক জীবন নির্বাহের অধিকার নিশ্চিতকল্পে পবিত্র সংবিধান হয়ে থাকে রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার উৎসসূত্র। ‘বন্দুকের নল নয়, জনগণই ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু’ প্রতিপাদ্যকে পরিপূর্ণ ধারণ করেই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উৎকর্ষতা সভ্যসমাজের প্রাণিধানযোগ্য অনুষঙ্গ।
আধুনিক সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় মুক্ত রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনগণের অধিকার প্রয়োগ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকে গতিশীল করে সমাজের স্বয়ম্ভরতা অর্জনে মানুষ তার স্বাধীনতা এবং সাংস্কৃতিক বিবেককে জাগ্রত করা অপরিহার্য মনে করেছে। এর ধারাবাহিকতায় একুশ শতক ছিল সবচেয়ে সৃষ্টিশীল শতক যা বিশ্বের প্রায় সকল মানুষকে স্বাধীনতার মন্ত্রে স্পন্দিত এবং তা অর্জনে প্রচণ্ড শক্তি যুগিয়েছিল। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক মনীষী এরিস্টটল বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে বস্তুবাদী দর্শনের ঐতিহ্যিক মাত্রায় শুধু জীবনের প্রয়োজনে নয়, বরং উত্তম জীবন প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনেই রাষ্ট্রের উৎপত্তির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। ব্যক্তিকে সর্বোৎকৃষ্ট জীবনের দিকে পরিচালিত করার লক্ষ্যে মানুষ সকল সামাজিক সম্পর্ক এবং শক্তির বন্ধনে জীবনের জাগতিক ও সামগ্রিক প্রয়োজনে রাষ্ট্রশাসন ব্যবস্থা নির্মাণ করেছে। উল্লেখ্য, কার্যকরণ মিথস্ক্রিয়ায় রাষ্ট্র মানুষের জন্য একটি অনিবার্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে সমধিক গুরুত্বপূর্ণ। মানব সত্তার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ বা পরিবার-সমাজের অর্থবহ স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও মঙ্গল প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার সফলতা-সার্থকতা সর্বজনবিদিত। ব্যক্তি, শ্রেণী বা দলীয় স্বার্থ রক্ষার যে ধারণা তথা স্বৈরতন্ত্র, অভিজাততন্ত্রের বিপরীতে মানুষ প্রণয়ন করেছে জনন্যায়তন্ত্র বা গণতন্ত্র।
এটি সর্বজনস্বীকৃত, রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়টি সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই পরিশুদ্ধ সমাজ বিনির্মাণে চলমান সক্রিয়তায় পরিপুষ্ট। খ্রিস্টপূর্ব ২৪০০ বছর পূর্বে হেরোডেটাস (৪৮৪-৪২৪ //ইঈ) কর্তৃক প্রণীত গণতন্ত্রের ধারণাকে এখনও স্বাভাবিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার মৌলিক কাঠামোর অতি নিকটতর মনে করা হয়। আদিম মানবগোষ্ঠীর সহজ-সরল শাসন ব্যবস্থাকে স্বাভাবিক ধরে রাজতন্ত্র বা একনায়কতন্ত্র নামক অস্বাভাবিক রাষ্ট্রব্যবস্থার বিপরীতে জনগণ জীবন ব্যবস্থা রূপে গণতন্ত্রকে বেছে নেবে এই ইঙ্গিত প্রায় সকল সমাজ ও রাষ্ট্র দিয়ে গেছে। আমরা জানি, প্রাচীন গ্রীস ও রোম এর সরকার পরিচালনায় নাগরিকের অংশগ্রহণের অধিকার প্রচলিত ছিল। প্রাচীন গ্রীসে সীমিত সংখ্যক জনসংখ্যা অধ্যুষিত ছোট ছোট নগরকেন্দ্রিক রাষ্ট্রে নাগরিকেরা সরাসরি ভোট দিত। কিন্তু এসব গণতন্ত্রে নি¤œবিত্ত কিংবা ক্রীতদাসদের কোন স্থান ছিল না। জনপ্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার বহু পূর্বে ইংল্যান্ডে পার্লামেন্ট সরকার চালু ছিল। ইংল্যান্ডে প্রায় হাজার বছর পূর্বে হাউজ অব ল’স প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বেশ কয়েক শতাব্দী ধরে ইংল্যান্ডে আইন প্রণয়নে হাউজ অব কমন্স-এর অংশগ্রহণ কারো অজানা নয়।
সামগ্রিক অর্থে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বহু পূর্ব থেকেই অভিজাত শ্রেণীর প্রতিনিধিরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও সংখ্যালঘিষ্ঠতার বিভাজনে সংসদীয় শাসন পরিচালনা করত। এই সংসদীয় কাঠামো বজায় রেখে ইংল্যান্ডে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় অনেক পরে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরেও বহুকাল ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় নারীদের ভোটাধিকার ছিল না। আধুনিককালে প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকার প্রয়োগে নির্বাচিত ব্যক্তিবর্গের আইন পরিষদে প্রতিনিধিত্ব করার মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার যে ব্যবস্থা, তাকেই বর্তমানে গণতন্ত্রের মূল প্রত্যয় হিসেবে অভিহিত করা হয়। মূলত এর উৎপত্তির পিছনে রয়েছে শিল্প বিপ্লবের ধারাবাহিকতায় ফরাসী বিপ্লবের যে দার্শনিক ভিত্তির গোড়াপত্তন তথা সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার চেতনার বাস্তব অভিব্যক্তি। এর সর্বোত্তম স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে আব্রাহাম লিংকনের ইতিহাসসমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক সরকারের সংজ্ঞায়- “এড়াবৎহসবহঃ ড়ভ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব, নু ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব ধহফ ভড়ৎ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব” যদিও ইংল্যান্ডে বেশ কিছুকাল আগেই রাজা কর্তৃক নাগরিকদের সনাতন অধিকার খর্ব করার প্রতিবাদে সপ্তদশ শতাব্দীতে সংঘটিত সংঘাতের ফলশ্রæতিতে প্রণীত ঞযব চবঃরঃরড়হ ড়ভ জরমযঃ, ১৬২৮ এবং ঞযব ইরষষ ড়ভ জরমযঃং, ১৬৮৯ রাজার একচ্ছত্র ক্ষমতাকে খর্ব করে আইনসভা ও বিচারব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার দৃষ্টান্ত রয়েছে। গণতন্ত্রের আদর্শকে উজ্জীবিত করার নিরন্তর ধারাবাহিকতা ১৭৭৬ সালে আমেরিকার স্বাধীনতা আন্দোলন ও ১৭৮৯ সালে ফরাসী বিপ্লবের গৌরবগাথায় আবর্তিত।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর লাস্কির ভাষায় ‘কোন রাষ্ট্র পরিচালিত হয় সে রাষ্ট্রের নাগরিকদের প্রদত্ত অধিকার দ্বারা’ এবং গণতন্ত্রকে যথার্থ মর্যাদায় আসীন রাখতে পারে জনগণের সঠিক চেতনা ও সতর্ক পাহারা যেটি লাস্কির ভাষায়- বঃবৎহধষ ারমরষধহপব রং ঃযব ঢ়ৎরপব ড়ভ ষরনবৎঃু। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অনেক অন্তর্নিহিত দুর্বলতা বা গুটিকয়েক ব্যক্তি বা ক্ষুদ্রতর গোষ্ঠীর ক্ষমতা অধিগতের মাধ্যমে গণতন্ত্র অনুশীলন করা হলেও এটি গণতন্ত্রকে “ষবধংঃ ধৎনরঃৎধঃড়ৎু ধহফ সড়ংঃ ৎবংঢ়ড়হংরনষব, ষবধংঃ ফৎধংঃরপ ধহফ সড়ংঃ পড়হংরফবৎধঃব” অর্থাৎ ‘সবচেয়ে কম স্বৈরাচারী সবচেয়ে বেশি দায়িত্বশীল, সবচেয়ে কম কঠোর এবং সবচেয়ে বেশি সহানুভ‚তিশীল’ বৈশিষ্ট্যের কারণে প্যারেটো, র্যাকো এবং সমবার্টের মতো খ্যাতিমান সমাজ-রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ব্যতীত প্রথিতযশা প্রায় সকলেই গণতন্ত্রের দুর্বলতা, অপূর্ণতা ও অপপ্রয়োগ স্বীকার করেও এর অপরিহার্যতার প্রতি অকৃত্রিম সমর্থন দিয়েছেন।
আধুনিক গণতন্ত্রের বিকাশের ভিত্তিতে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর স্বাধীনতা ও মুক্তি তথা মানবজাতির মুক্তির সনদ হিসেবে জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ২১তম অনুচ্ছেদের ৩নং ধারা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ‘সরকারের কর্তৃত্বের ভিত্তি হবে জনগণের ইচ্ছা যা নির্দিষ্ট সময় অন্তর সার্বজনীন ও সমান ভোটাধিকারের ভিত্তিতে গোপন ভোটের মাধ্যমে অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠান অর্থাৎ জনগণের ইচ্ছার প্রকৃত প্রতিফলন’ জাতিসংঘ ঘোষিত এ নীতিমালা গণতান্ত্রিক ধারাকে সমগ্র বিশ্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। অনুচ্ছেদের ১ নং ধারা বিশ্বের প্রত্যেক ব্যক্তিই স্বাধীনভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে দেশের শাসনকার্য পরিচালনায় অংশগ্রহণের অধিকার অর্জন করেছে। যথার্থ অর্থে জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠার সমুজ্জ্বল গতি-প্রকৃতির অবগাহনে গণতন্ত্র শুধু যে সরকার গঠন সম্পর্কিত বিষয় তা কিন্তু নয়। আধুনিক গণতন্ত্রের বিজ্ঞতাত্তি¡ক লিন্ডসের ভাষায়, গণতন্ত্র একটি সামাজিক প্রক্রিয়াও বটে। এটি মূলত কতগুলো রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও সামাজিক মূল্যবোধের সমন্বিত পরিচর্যা-প্রতিফলন-রোডম্যাপ স্বরূপে বিবেচ্য।
গণতন্ত্রের প্রাথমিক মূল্যবোধ হচ্ছে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ অর্থাৎ ব্যক্তির মৌলিক স্বাধীনতা তথা চিন্তা-বাক-সংগঠন-ভোটপ্রদান-দলগঠন এবং অংশগ্রহণ-প্রার্থী-নির্বাচনে অংশগ্রহণ-স্বেচ্ছায় নির্বাচন গ্রহণ-বর্জনসহ অভিযোগ উত্থাপনের সমূহ স্বাধীনতা। সার্বিকভাবে জীবনধারণ-পরিবার গঠন-নিরাপত্তা-আইনের আশ্রয়-স্বাধীন মতামত প্রকাশ-নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা বা বিরোধিতার অধিকার সকল কিছুকেই অন্তর্ভুক্ত করার মধ্যেই গণতন্ত্রের গতিশীলতা-শক্তিমানতার বিকাশ ও বিস্তার লাভ করে। গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় ব্যক্তিত্বের উন্মেষ অধ্যায় তৈরির সঙ্গে অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধ হচ্ছে নির্ভরযোগ্য সহনশীলতা, অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতকে সাদরে গ্রহণ করার মানসিকতা। যে কোন সামাজিক প্রক্রিয়ায় ব্যক্তির স্বাভাবিক ব্যক্তিত্ব ও সৃজনশীল প্রতিভার বিকাশমানতার একমাত্র আশ্রয়স্থল হচ্ছে বিশ্বাস-আস্থাশীল গণতান্ত্রিক পরিবেশ। গণতান্ত্রিক পাঠ্যক্রমের মুখ্য শিক্ষাই হচ্ছে নিজের ইচ্ছার সঙ্গে অন্যের ইচ্ছার সমন্বয় ঘটানো বা অধিকাংশের ইচ্ছা বা আগ্রহকে যৌক্তিকভাবে নিজের বা ব্যক্তির অধিকারে সন্নিবেশন। ভল্টেয়ার বলেছেন, ‘তোমার মতের সঙ্গে আমি একমত নাও হতে পারি, কিন্তু তোমার মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে রক্ষার জন্য প্রয়োজন হলে প্রাণ দেব।’
এটি অধিকতর সত্য যে, গণতন্ত্রের প্রধান উদ্দেশ্য জনগণের শাসন শুধু প্রতিষ্ঠা নয়, শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানুষের অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-চিকিৎসা-বাসস্থানের নিশ্চয়তা প্রদানও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্যতম উদ্দেশ্য। বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী চিন্তা যা মানুষের অন্ধ বিশ্বাসের মূলে আঘাত হেনে সমাজদর্শন এবং রাষ্ট্রচিন্তার বিষয়ে মানুষের মানসিক-মানবিক শক্তিকে একীভূত করেছে, তারই সফল উচ্চারণ গণতন্ত্রায়ন ও এর সমকালীন পরিচর্যা। এরই যথার্থ বহির্প্রকাশ আমরা পর্যবেক্ষণ করেছি ইউরোপীয় রেঁনেসা বা পুনর্জাগরণে যা মানুষকে পার্থিব জগত ও পরিবেশের অপরিসীম সৌন্দর্য-আনন্দকে উপলব্ধি করার এক যুক্তিবাদী ধারণা এবং ক্ষমতায় অত্যুজ্জ্বল করেছে। সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তিতে যথাযথ রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ইত্যাদির যৌক্তিক পরিবর্তনে এর ইতিবাচক রূপই সংস্কার আন্দোলনের ধারাকে অতিশয় সমুজ্জ্বল করে আসছে। মানুষকে তার নিজের শক্তির প্রতি আস্থাশীল করা এবং সকল মানবীয় শক্তিকে জাগ্রত করে সমাজ উন্নয়নে এর মুক্ত বিকাশ-প্রয়োগ ছিল রেঁনেসার মুখ্য উদ্দেশ্য। কালক্রমে যা স¤প্রসারিত হয়েছে প্রাচ্যের এতদঞ্চলে এবং তারই বিকাশমান ধারায় উজ্জীবিত আজকের দক্ষিণ এশিয়ার স্বাধীন সত্তার সার্বভৌম দেশ বাংলাদেশ।
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশ তথা পূর্ব বাংলার আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস ব্যাখ্যা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে এর ভাঙ্গনের মূলে যে কারণগুলো বিদ্যমান ছিল তা হচ্ছে প্রধানত- গণতন্ত্র বিবর্জিত কেন্দ্রীয় এক দেশদর্শী শাসন ব্যবস্থা ও পূর্ব বাংলার প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ, এর ভাষার প্রতি অগণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সর্বোপরি শিক্ষিত সংস্কৃতিবান মধ্যবিত্তশ্রেণীর বিকাশকে রুদ্ধ করার অপচেষ্টা। দারিদ্র্য ও নিরক্ষরতা গণতন্ত্রের প্রধান শত্রæ হিসেবে বিবেচিত যার সমুদয় উত্তরণ পরিপূর্ণভাবে দেশে অনুভূত নয়। এর পিছনে রয়েছে অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের রাজনৈতিক ক্ষমতা কাঠামোয় অধিষ্ঠিতকরণ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ইত্যাদি এক অপরাজনৈতিক সংস্কৃতির উদ্ভাবন। বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ স¦াধীনতা সংগ্রাম ও তাঁর নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী চেতনার মূলমন্ত্র ছিল শোষণমুক্ত জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। এরই আলোকে ১৯৭২ সালের ১৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু সংবাদ সম্মেলনে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে পরিপূর্ণ অক্ষুণœ রেখে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন।
স্বাধীনতাকে পরিপূর্ণভাবে অর্থবহ করার লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানের কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ দেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেন। ৭ মার্চের নির্বাচন যাতে নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু, সুন্দর এবং রাজনৈতিক গণতন্ত্রে বিশ্বাসী সকল দলের অংশগ্রহণে যথার্থ প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করা যায় তার জন্য ১৯৭৩ সালের ১০ জানুয়ারি গণভবনে মন্ত্রীদের উদ্দেশে নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রদত্ত ভাষণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আমার দেশ চলবে। এটা যে শুধু আমার কথা তা নয়। যে শাসনতন্ত্র আমরা দিয়েছি সে শাসনতন্ত্রে সেটা প্রত্যেক অক্ষরে অক্ষরে গ্রহণ করা হয়েছে।...এটা শাসনতন্ত্রের মূলনীতি। যে শৃঙ্খলাকে ভিত্তি করে শাসনতন্ত্র দিয়েছি যার জন্য আমরা স্বাধীনতার সংগ্রাম করেছি এতো শহীদ হয়েছে, এত রক্ত দিয়েছি এটা মিথ্যা হয়ে যাবে যদি আমরা আমাদের আদর্শ এবং মূলনীতি থেকে দূরে সরে যাই।’
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সভ্যতার বর্বরতম হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর শাহাদাত পরবর্তী পর্যায়ে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর জাতীয়করণে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রবর্তনের ঐতিহাসিক উদ্যোগকে নস্যাৎ করে অর্থব্যবস্থা-শিল্পায়ন-বিনিয়োগে ব্যক্তিখাতকে অধিক মাত্রায় গুরুত্ব দেয়া হয়। সেনাশাসক জিয়াউর রহমান ব্যক্তিখাতের যে ধারাটি চালু করেছিলেন পরবর্তীতে স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের সময় এ ধারাটির উলঙ্গ প্রকাশ ঘটে। সার্Ÿিক পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, গণতন্ত্রের জয়-পরাজয়ের দোলাচলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র বার বারই ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। পক্ষান্তরে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ভয়ঙ্কর সন্ত্রাস-জঙ্গী ও মৌলবাদী শক্তির আস্ফালন ধর্মান্ধ- দেশবিধ্বংসী পরাজিত অন্ধকারের শক্তি এক ধরনের রাজনৈতিক উন্মাদনা তৈরি করে। ফলশ্রæতিতে চল্লিশ-পঞ্চাশ দশকের অবিচ্ছেদ্য গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে পরাস্ত করে ত্যাগী ও আদর্শ রাজনীতির স্থান দখল করেছে অবৈধ-অনৈতিক গুটিকয়েক বিপথগামী সামরিক-বেসামরিক আমলা-ঋণখেলাপী-ব্যবসায়ী-ঠিকাদার স¤প্রদায়।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনকালে দেশবাসী গভীর পরিতাপের সঙ্গে লক্ষ্য করছে উল্লিখিত অশুভ শক্তির বিনাশ সম্ভব হয়নি, অধিকন্তু বর্ণচোরা-অনুপ্রবেশকারী-অর্থ ও ক্ষমতালিপ্সু-দলবদলে পারদর্শী-পাপিষ্ঠ রাজনীতিকদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে এরা সর্বত্রই শুধু সমাদৃত নয়, ছলচাতুরী-অনৈতিক লেনদেনের মাধ্যমে বিভিন্ন পদ-পদক-পদবী দখলে নিয়ে দেশকে প্রায় করায়ত্ত করেছে বলে প্রবল জনশ্রæতি রয়েছে। ৪ অক্টোবর ২০২১ কোন এক গুরুত্ব¡পূর্ণ অনুষ্ঠানে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের সম্মানিত সাধারণ সম্পাদককেও বলতে হচ্ছে, দলে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য টাকা খেয়ে যেন খারাপ লোকের নাম কেন্দ্রে পাঠানো না হয়। ৫ অক্টোবর ২০২১ অন্য এক গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, ধর্মান্ধ মৌলবাদী রাজনৈতিক দলের উঁচু পর্যায়ের এক নেতা দাবি করেছেন, ‘বাংলাদেশে টাকার খেলা। টাকা দিয়ে জামায়াত প্রার্থী কেন, নৌকার মনোনয়নও পাওয়া কোন ব্যাপার না। প্রয়োজন হলে টাকা দিয়ে নৌকার মনোনয়ন নিয়ে নেব। তারপরও চেয়ারম্যান পদে নেতৃত্ব দিতে চাই।’ এটি অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির অপপ্রয়োগে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের স্খলন সর্বনি¤œ পর্যায়ে পৌঁছেছে। হাতেগোনা কিছু পেশী-বাহিনী পরিচালক, মাফিয়া-সন্ত্রাসী-জঙ্গীবাদীদের নিয়ন্ত্রণে চলমান রাজনীতি-রাজনীতিকদের চরিত্র বিশ্লেষণে ন্যূনতম দেশপ্রেম বা জনকল্যাণের কোন বৈশিষ্ট্যেরও লেশমাত্র প্রতিফলন দৃশ্যমান নয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর আদর্শিক চেতনায় যথোপযুক্ত ঋদ্ধ হয়ে সচেতন জনগোষ্ঠীর ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস অতীব জরুরী। আগামী নির্বাচনে নিখাঁদ ত্যাগী নেতৃত্বের হাতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব তুলে দেয়া না হলে জাতিকে কঠিন মূল্য দিতে হবে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়