
বিদায় শব্দটি বিষাদময় হলেও প্রতিটি মানুষের জীবনচক্রে বারবার ঘুরেফিরে আসে বিদায়ের আবেগঘন মুহূর্ত। যা শুরু হয় তার এক সময় পরিসমাপ্তি ঘটে। আবার প্রত্যেকটা শুরুই অন্য কোন শেষের থেকে হয়। জীবনপথের বাঁকে বাঁকে কত যে বিদায় মুহূর্ত রয়েছে- গৃহ থেকে শুরু করে বিদ্যাপীঠ, কর্মস্থল কিংবা প্রিয়জনের নিকট হতে বিদায়, সবই যেন বেদনাবিধুর। যাদের কাছ থেকে বিদায় নেয় তারাও আবেগতাড়িত হয়, কখনও অশ্রুসিক্ত হয়। তবে যিনি বিদায় নিচ্ছেন তার আবেগ, অনুভূতি, বেদনা অনেক বেশি। তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেন তার এতদিনের স্পর্শ, ভালবাসার কাজ, সৃজনশীলতা, সহপাঠী, সহকর্মী, সহচরদের মধ্যে গড়ে ওঠা দীর্ঘদিনের ভালবাসা, কত চেনা মুখ, কি মায়ার বন্ধন, সুখ-দুঃখের ভাগাভাগি, কত খুনসুটি, কারও সঙ্গে কখনও কঠোরতা ও অসহিষ্ণুতা ইত্যাদি অনেক স্মৃতি। প্রতিষ্ঠান, অফিস, চার দেয়াল, চেয়ার, আসবাবপত্র, সকল কিছুই তাকে মনে করিয়ে দেয় তারাও ছিল এতদিন তারই সাথী। আজ তিনি চলে যাচ্ছেন- এই পরিবেশ ও প্রকৃতি তাকে দারুণভাবে মর্মাহত করে। স্রষ্টা মানুষকে এই এক নিভৃত অনুভূতি দিয়েছেন উপলব্ধির জন্য। যখন একজন বিদায় নেন তখন তাকে সত্যিই অসহায় মনে হয়, যা কিছু আজ ছেড়ে যাচ্ছেন তার সবই এতদিন তার আপন ছিল। কিন্তু বিদায় মুহূর্তের পর থেকে আর আপন থাকছে না। এমন নাজুক মুহূর্তে তার সহচর, সহকর্মী, সহপাঠীরা এই দিনটি স্মরণীয় করে তুলতে অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে আনুষ্ঠানিকতার আয়োজন করে। পারিবারিক, সাংসারিক জীবনে সাময়িক বিদায়ে হয়ত এমনটি হয় না। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে বিদায়ী আনুষ্ঠানিকতার রেওয়াজ মেনে চলতে হয়। সহকর্মী, উর্ধতন, অধস্তন যেই চলে যায় তাকে আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে বিদায় দিয়ে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে হয়। বিদায় অনুষ্ঠান আয়োজনে কোন প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত নিয়মের সঙ্গে নিজেদের উদার মনোভাবের বহির্প্রকাশ ঘটিয়ে বিদায়ী ব্যক্তিকে আরও বেশি সম্মানিত করা যায়। কোন প্রতিষ্ঠানে নিয়ম না থাকলেও নিজেরাই মিলেমিশে বিদায়ের আনুষ্ঠানিকতার রেওয়াজ গড়ে তুলতে দেখা যায়। যিনি বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছেন তিনি হয়ত আর কখনও ফিরবেন না। তাই তাকে সম্মান দেয়ার জন্য সহকর্মীরা উদ্যোগী হবেন এটাই প্রত্যাশিত।
কর্মক্ষেত্রে একত্রে কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে, কারও সঙ্গে মনোমালিন্য থাকতে পারে। বিদায়ের দিন এসব বিভেদ ভুলে আনুষ্ঠানিকতায় সকলকে শামিল হতে হয়। বিদায়ী ব্যক্তি কিন্তু অন্যদের না খুঁজলেও যার সঙ্গে তার হৃদ্যতা ছিল না বিদায় বেলা তার চোখ তাকেই খুঁজবে, পাশে পেতে চাইবে। আবার এমনও অনেকে আছেন যারা বিদায় মুহূর্তের আবেগ বুঝতে পারেন না। গুরুত্বপূর্ণ কাজ না থাকলেও ঠুনকো কাজের দোহাই দিয়ে অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত থাকেন। বিদায়ের দিনে যদি সত্যিই কোন জরুরী কাজ থাকে কিংবা একান্তই অনুপস্থিত থাকতে হয় তাহলে যাওয়ার পূর্বে বিদায়ী ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করে সৌজন্যস্বরূপ কিছু বলে গেলে তার ভাল লাগবে। বিদায় মুহূর্তে যদি সকলে মিলে একটু গাড়ি/গেট পর্যন্ত এগিয়ে দেয় এই আন্তরিকতা তাকে মুগ্ধ করবে। চেনা মানুষদের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দেখতে পেলে তিনি ভালবাসায় সিক্ত হবেন।
আন্তরিকতা ও সৌজন্যতার দৈন্য আজকাল হয়ত কিছুটা থাকতে পারে। তবে যাদের মাঝে সেই অভাব রয়েছে তাদের শেখানোর দায়িত্ব পরিবার, শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠানের। আন্তরিকতা, আতিথেয়তা ও সৌজন্যতা এই তিনটি গুণ একজন ভাল মনের মানুষের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যদি শিক্ষক কর্তৃক স্কুলের সহপাঠী বন্ধুদের বিদায় আয়োজনে শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করা হয়, তাদের সুন্দর ও পবিত্র অনুভূতিগুলো জাগিয়ে তুলা হয়, সুপ্ত প্রতিভা বিকাশে সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের মর্ম বোঝানো সম্ভব হয় তবে এই শিক্ষাই পরবর্তীতে তারা তাদের কর্মময় জীবনে চলমান রাখবে। প্রায় সব প্রতিষ্ঠানেই সহকর্মীদের মাঝে কমবেশি বিদায় আনুষ্ঠানিকতার রেওয়াজ রয়েছে। প্রতিষ্ঠান প্রধানের নির্দেশেই মূলত আয়োজন করা হয়। কোথাও সীমাবদ্ধতা থাকলে সহকর্মীদের আন্তরিকতায় তা দূর করা যায়। একজন বিদায়ী ব্যক্তি প্রত্যাশা করেন না কে তাকে কি উপহার দিল, কত ফুল দিল। কিন্তু কতটুকু আন্তরিকতা এবং সম্মান দেখানো হলো তা তার কাছে বিবেচ্য। সমাজে অনেকে আছেন যাদের কাছে এই বিদায় পর্বটি শুধুই আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। কিন্তু আন্তরিকতা না থাকলে এই আনুষ্ঠানিকতায় তৃপ্তি নেই। যারা আজ একজনকে বিদায় দিলেন তারাও একদিন বিদায় নেবেন। আজ হয়ত বিদায়ী ব্যক্তির অনুভূতি বুঝতে পারলেন না, কিন্তু যেদিন নিজের বিদায়লগ্ন আসবে সেদিন ঠিকই উপলব্ধি করবেন। বিদায়ের আয়োজন হওয়া উচিত নিঃস্বার্থ, স্বতঃস্ফূর্ততা এবং আন্তরিকতায় ভরপুর। তবে শুধু বিদায় দিয়েই যেন সব শেষ না হয়। যিনি বিদায় নিলেন, তিনি চলে যাওয়ার পর তাকে স্মরণ করুন, শুভেচ্ছা পাঠান, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করুন। এর মধ্যেই তিনি খুঁজে পাবেন অনাবিল আনন্দ।
হাসিমুখে যাকে বিদায় জানালেন তার স্থলাভিষিক্ত যিনি হবেন তিনি যেন ওই পদে অধিষ্ঠিত হয়েই তার ব্যর্থতাকে তুলে না ধরেন। সমাজে অনেকেই পূর্বসূরিদের কাজকে সামনে আনতে চান না, তাদের স্বীকৃতি দিতে চান না, তারা ভুল করেছেন এবং তিনিই সব করছেন, সব সামলাচ্ছেন, তার অবদান সর্বোচ্চ- এই কদর্য মানসিকতা পরিহার করা উচিত। সকলের অবদানে একটি প্রতিষ্ঠান পরিপূর্ণতা পায়। পূর্বের কর্মরত ব্যক্তি যতটুকু কাজ করেছেন পরবর্তীজন তা আরও এগিয়ে নিয়ে যাবেন। এভাবে প্রতিষ্ঠান ধাপে ধাপে পরিপূর্ণ হয়, পরিপক্ব হয়, উন্নতির সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছায়। আজ যদি কেউ পূর্বসূরিদের অবদান অস্বীকার করে নিজেই সকল কৃতিত্ব দাবি করেন তাহলে তার চলে যাওয়ার পর পরবর্তীজন তার অবদানকেও অস্বীকার করবেন এবং তার ভুলগুলোকে সকলের সামনে তুলে ধরবেন। তাই চলে যাওয়া ব্যক্তির প্রশংসা করুন। ভুল থাকলেও তাকে সমালোচনার উর্ধে রাখুন। নিজের মহানুভবতার পরিচয় দিন। বিদায়বেলা এবং তারপরের কয়েকটা দিন বিদায়ী ব্যক্তির মধ্যে কিছুটা বিষণœতা কাজ করে। এই এতদিন যে মানুষগুলো আশপাশে ছিল, কাজে-আড্ডায় তার চারদিকে ঘোরাঘুরি করত, আজ তারা কেউ নেই পাশে। এ রীতিমতো বিয়োগান্তক। যারা বদলি হয়ে চলে যান তারা হয়ত নতুন কাজের, নতুন মানুষের সঙ্গে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, দ্রুত খাপ খাইয়ে নেন। কিন্তু যে ব্যক্তি দীর্ঘকালের কর্মব্যস্ত জীবন শেষে অবসর নিলেন, কাজ নেই, ব্যস্ততা নেই, অলস সময়ে বারবার স্মৃতিতে ভেসে আসে তার জীবনের জমা হওয়া বর্ণাঢ্য ও স্মৃতিময় নানা ঘটনা, সুদীর্ঘ কর্মময় জীবন এবং শেষ বিদায়ের মুহূর্ত। তাই বিদায়ের দিনে বিদায়ী ব্যক্তি যেন সিক্ত হয় সকলের আন্তরিক ভালবাসায়। স্মৃতিকে যেন গেঁথে থাকে এই বিদায় মুহূর্ত।
লেখক : প্রাক্তন অধ্যক্ষ, ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এ্যান্ড কলেজ, জাহানাবাদ, খুলনা