
মার্কিন দেশ থেকে নিজ জন্মভূমিতে প্রথম যখন বেড়াতে গেলাম, তখনও সময়টা অতটা শাড়ি বৈরী হয়ে ওঠেনি। নব্বইয়ের দশকে সেটা ছিল মধ্যবর্তী সময়। কিন্তু এরপর থেকে ক্রমশ প্রবাসে শাড়ি পরা আমি দেশের মাটিতে এক সময় অনুভব করলাম আমার একাকিত্ব বহু স্থানেই। এ যেন ‘সবার মাঝে আমি ফিরি একেলা।’ প্রায় সংখ্যাগরিষ্ঠ আত্মীয়-পরিজন সব নারীরই পরনে হয় বোরকা অথবা পরিধান হিসেবে রয়েছে হিজাব। এই হিজাব আমার সময়কালে বাংলাদেশে দেখা যায়নি। কিন্তু আমেরিকায় এসে অর্থডক্স ইহুদী নারীদের মাথায় হিজাব দেখেছি, যেমন তাদের পুরুষদের রয়েছে দাড়িও।
প্রসঙ্গক্রমে কিছুদিন আগের ছোট্ট অভিজ্ঞতাটি প্রকাশের উদ্দেশ্যে উসখুস করে উঠছে মনের ভেতর। বাড়ির নিকটবর্তী সাধারণ এক চাইনিজ গ্রোসারিতে আমি ও আমার মতো আরও কিছু ক্রেতা, যারা নানা বর্ণের মানুষ কেনাকাটা করছিলেন ফলমূল ইত্যাদি। কাছাকাছি এক ক্রেতা দম্পতির একজন হচ্ছেন শ্বেতশুভ্র দাড়িওয়ালা পুরুষ, মাথায় রুশী কালো টুপি, পরনের পোশাকটি আমাদের দেশের মাওলানাদের আচকানের মতো। স্ত্রী লোকটির পরনে যথেষ্ট লম্বা স্কার্ট। মাথায় হিজাবের মতো একটি মস্তকাবরণ। আমার আর এক পাশের দুজনকে শোনা গেল বাংলায় কথা বলতে, মনে হলো ওরা পিতা-পুত্র। পিতাটি সম্ভবত একজন নবাগত এবং ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি। কারণ, তিনি একদৃষ্টে ‘বুজর্গ’ ব্যক্তি দর্শনের মতো কৃতার্থভাবে তাকিয়ে আছেন দাড়িওয়ালা ভদ্রলোকের দিকে। এক সময় দেখলাম তিনি পায়ে পায়ে চললেন সেই ব্যক্তির পাশে।
-আর ইউ মুসলিম?
জিজ্ঞাসাটি যার উদ্দেশে তিনি সামান্য একটু তাকিয়ে উত্তর দিলেন- নো নো আই এম জুইশ। অর্থাৎ আমি একজন ইহুদী।
প্রকৃতপক্ষে আমাদের এলাকায় নানা দেশের জুইশ সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করেন। বঙ্গভাষীদের বসবাস তেমন নেই। নিজ অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝতে পারি ‘বুজর্গ’ ব্যক্তিদের মতো দেখতে ইহুদী ইমিগ্র্যান্ট মানুষটি এসেছেন প্রাক্তন সোভিয়েত ব্লকের কোন এক দেশ থেকে। তিনি তার পোশাক, মুখের দাড়ি, মাথার টুপি সব নিয়ে একজন অর্থডক্স জুইশ। এলাকার জার্মান জুইশদের দাড়ি ছুঁচালো ধরনের লম্বা, পোশাক প্রায় পা পর্যন্ত, লম্বা কোট এবং মাথায় জুলফিওয়ালা চুলের ওপর লম্বাটে জার্মান হ্যাট। কট্টর সম্প্রদায়ের এসব জার্মান জুইশ পুরনো সময় থেকে অনুসরণ করে আসছেন এই সমস্ত বেশবাস ও দাড়ি নিজ দেশের ঐতিহ্য অনুসারে।
বালিকা বয়সের সেই কবিতা ‘গোঁফের আমি গোঁফের তুমি গোঁফ দিয়ে যায় চেনা’র মতো পোশাক দিয়ে ধর্ম চেনার উপায় আছে কি? বাংলাদেশের জোব্বা পরা ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিবর্গ হয়ত খোঁজও রাখেন না এখনও আরব ভূমিতে ইহুদী, খ্রীস্টান ও মুসলিম নানা ধর্মের মানুষের একত্রে বসবাস। তাদের পরিধেয় বস্ত্রটি ধর্ম নির্বিশেষে আরবের হাজার বছরের পুরনো ঐতিহ্য।
আমার পরিচিত একজন ইজিপশিয়ান খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বী ডাক্তারের ‘শরীফ লতিফ’ নাম শুনে আমার বিস্ময়ের সীমা ছিল না। এর প্রেক্ষিতে তিনি বলেছিলেন যে, মাতৃভাষা আরবী বলে তার এই নাম। পিতৃপুরুষের ঐতিহ্য অনুসারে তারা আরবী ভাষায় কথা বলেন, লম্বা পোশাক পরেন। মিসরীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী ডাঃ শরীফ লতিফ আরও বললেন, একজন মুসলিম যেমন আরব, তেমনি খ্রীস্টান ও ইহুদীরাও আরব জাতির অংশ- নিজেদের ভাষা সংস্কৃতি নিয়ে সমানভাবে আমরা গর্বিত।
বছর চারেক আগে দেশে গিয়ে পাবলিক লাইব্রেরির অঙ্গনে বড়সড় এক সাহিত্য অনুষ্ঠানে যাওয়া হয়েছিল। আর সেখানে গিয়ে অবিশ্বাস্যভাবে অধিকাংশ মেয়েকে দেখা গিয়েছিল সালোয়ার কামিজে। পরবর্তীতে পরিচিতদের কাছে এ বিষয়ে প্রশ্ন তুললে শোনা গেল সালোয়ার কামিজ যেমন সৌন্দর্যমণ্ডিত, তেমনি স্বচ্ছন্দ পোশাক। অথচ এই পাবলিক লাইব্রেরির অঙ্গনেই ঝলমলে সব অনুষ্ঠানে আমরা পরেছি কপালে টিপ ও পরনে শাড়ি। বিনুনির ফুলে আমাদের সৌন্দর্য স্বচ্ছন্দতা কিছু কম পড়েছিল কি!
একবার নিউইয়র্ক নগরীর এক পার্টিতে সুপরিচিতকে দেখলাম সালোয়ার কামিজ পরে এসেছেন। অভ্যাসদোষে বলে ফেললাম- আপনাকে কিন্তু শাড়িতেই বেশি মানায়। শাড়ি পরতেই চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার স্বামী বললেন, বাইরের পুরুষ মানুষের ভিড়ে ইসলামী পোশাক পরে যাওয়াই ভাল। মহিলার এই জবাবের পর বলার কিছু ছিল না আমার।
রেস্টুরেন্টের কোনার দেয়ালে রাখা টিভিটা খোলা রয়েছে। আমরা দুজনে পাশাপাশি বসা। হঠাৎ করে একই সঙ্গে দুজনের চোখ গিয়েছে সেদিকে। টেলিভিশনের পর্দায় আশি-নব্বই দশকের একটি মুম্বাই সিনেমা চলছে। এক সময়ের দর্শক নন্দিত নায়িকা জুহি চাওলা ওড়না উড়িয়ে ধুম ধাড়াক্কা নেচে যাচ্ছেন এবং তার অঙ্গে-অঙ্গে ভাব-তরঙ্গ ফুটিয়ে তুলছে পরনের সালোয়ার কামিজ। যদিও অভিনীত চরিত্রে তিনি কোন মুসলিম কন্যা নন। দুষ্টুমির ছলে মন্তব্য করলাম জুহি চাওলা তো দেখি আপনারই মতো ইসলামী পোশাক পরেছেন?
ভাল মানুষ পরিচিতা চুপ করে রইলেন অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে। কিন্তু আগ বাড়িয়ে পেছনের সারিতে বসা অপরিচিতা গলা তুললেন- পাকিস্তানসহ সকল মুসলিম মেয়েদের এটাই ড্রেস। হতে পারে। কিন্তু ভারতে নানা ধর্মের মেয়েরাও এই ড্রেস পরে বৈকি! ইতিহাস ঘাটলে দেখবেন সালোয়ার কামিজ ছিল পাঞ্জাবী শিখ মেয়েদের পোশাক। একে ইসলামী ড্রেস হিসেবে মেনে নেয়া যাবে কি? একটি সমাবেশের ভেতর বিব্রতকর হয়ে যাবে বলে কথা বাড়ালাম না। মনে মনে বললাম পাকিস্তানের কায়েদে আযম অর্থাৎ জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর পার্সী স্ত্রী দিনার পোশাক ছিল স্কার্ট। আর সেই স্কার্টের খাটো ঝুলের জন্য জিন্নাহকে সমালোচনা শুনতে হয়েছিল খোদ বিলেতেই।
আরও বলার ইচ্ছে ছিল ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, মিসর, তুরস্ক- এসব দেশের মেয়েদেরও কি মুসলিম হওয়ার জন্য আমাদের কারও কারও মতো ধরতে হবে পাকিস্তানী সালোয়ার কামিজের তরিকা?
দূরের একটা আসনে সরে যাই। এসব অজ্ঞানের সঙ্গে কথা বলা আমার রুচির বাইরে। তারপর গিয়ে বসলাম বন্ধু স্থানীয় মহিলার পাশে। ভেতরের ক্রোধটা কোনমতেই সামলাতে পারছি না। ওকে একটু খামচে দিয়ে গরগর করে বলে উঠলাম নিচু গলাতেই। কারণ, ওর পাশে বসে আছে গম্ভীর মুখের বর। -তুমি কি জানো সৌদি আরবের আধুনিক মেয়েরা কি পোশাক পরে?
-কি পরে জানি না তো। কিন্তু তুমিও তো সেখানে কখনও যাওনি।
-যাইনি, তবে খবরটা দিয়েছেন নিউজার্সির শেফালী আপা। তিনি তো কূটনীতিক পিতার কর্মসূত্রে কিশোরী বয়স থেকে কয়েক বছরব্যাপী বসবাস করেছিলেন সেখানে। ওখানকার কিছু মেয়ে তার বান্ধবীও হয়ে উঠেছিল। আমার বান্ধবী আগ্রহী হয়ে উঠে জিজ্ঞেস করল, তা ওরা কি পরে বোরকার অন্তরালে? ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম, বিকিনি বিকিনি।
শেফালী আপার মাকে আমরা ডাকতাম খালাম্মা বলে। অত্যন্ত ধমপ্রাণ ভদ্রমহিলা বছর কয়েক আগে প্রয়াত হয়েছেন। কূটনীতিবিদ স্বামীর সঙ্গে নানা দেশ ঘুরেছেন। অনেক অনেক অভিজ্ঞতা, দেখাশোনা ছিল তার ঝুলিতে। একদিন আরব দেশের কথা বলতে গিয়ে তিনি ওদের সংস্কৃতি- তার ভাষায় অনৈসলামিক নানা দিক নিয়ে দুঃখ করেছিলেন। যেগুলো তাদের প্রাচীন সংস্কৃতির অঙ্গ। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় আশ্চর্যের কথা ছিল উলুধ্বনি। যে উলুধ্বনি আমি শুনেছিলাম শৈশবে প্রতিবেশী হিন্দু সম্প্রদায়ের পুজো কিংবা উৎসব উপলক্ষে। আরবরা তাদের উৎসবে আনন্দে একই রকমভাবে উলুধ্বনি দিয়ে থাকে আনন্দে।
পরবর্তীতে সোমালিয়ার মুসলিম সমাজেও বিবাহ উৎসবে উলুধ্বনি দেয়ার ব্যাপারটি বলেছিল কানাডা প্রবাসী এক বন্ধুপত্নী। সেই ধ্বনির কথা লিখে কলেবর বৃদ্ধি করতে চাই না। সেটা পরবর্তী কোন লেখায় জানাবার ইচ্ছে রইল।
ফেব্রুয়ারি আমাদের ভাষা সংস্কৃতির বিজয়ের মাস। কিন্তু বর্তমান সময়ের দিকে তাকিয়ে ভাবি স্বাধীন বাংলাদেশে পাকিস্তানী প্রভুদের রেখে যাওয়া পরম্পরার কাছে আমরা কি ক্রমশ পরাজিত হতে যাচ্ছি! প্রতিদিনের প্রতি মুহূর্তে মূর্খতা এবং বিজাতীয় ভাবধারার স্রোতে এ রকম ভাবেই ভেসে যাচ্ছে নাকি বাংলা সংস্কৃতি। আর এর বিরুদ্ধে সমগ্র সমাজ যেন চেতনাহীন-নির্ভার।
লেখক : নিউইয়র্ক প্রবাসী, কথাসাহিত্যিক