ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২

নাজনীন বেগম

নারী নেত্রী আয়েশা খানম ও কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুনের বিদায়

প্রকাশিত: ২০:৪৩, ১৩ জানুয়ারি ২০২১

নারী নেত্রী আয়েশা খানম ও কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুনের বিদায়

নারীর অধিকার আদায়ের অতন্দ্র প্রহরীই শুধু নন, গণমানুষের লড়াইয়ের সম্মুখ সারির যোদ্ধা দুঃসাহসী আয়েশা খানম চিরতরে সবাইকে ছেড়ে অন্য জগতের বাসিন্দা হয়ে যান। মৃত্যু অমোঘ সত্য, প্রচলিত নিয়মের এক অনিবার্য বিধি ক্ষণস্থায়ী জগত থেকে চিরস্থায়ী বিদায় নেয়া, তারপরেও সব মৃত্যু সম্মান-মর্যাদায় অভিষিক্ত হয় না। বর্ণাঢ্য কর্মজীবনপ্রবাহই শুধু নয়, দেশপ্রেম, গণমানুষের প্রতি সচেতন দায়বদ্ধতা ছাড়াও অর্ধাংশ পিছিয়ে পড়া অবহেলিত নারী সমাজের জন্য অনুক্ষণ নিজের মূল্যবান সময়কে উজাড় করে দেয়া সেও যেন এক অধিকতর মহিমান্বিত জীবনবোধ। যে নিষ্ঠার সঞ্চালক নিজেই, আপন গতিতে নিরন্তর তৈরি হওয়া এমন বহুল আলোচিত কর্মশক্তি অর্জন করা তাও সংগ্রামী জীবনের নিরবচ্ছিন্ন গতিপ্রবাহের অনন্য দলিল। ১৯৪৭ সালের অনাকাক্সিক্ষত অবিভক্ত ভারত কর্তনের চরম দুঃসময়ে জন্ম নেয়া এই লড়াকু ব্যক্তিত্ব পৃথিবীর আলো দেখেন বিপ্লবী কবি সুকান্তের মতোই- ‘জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশ ভূমি।’ তেমন স্বাদেশিকতার বিক্ষুব্ধ তাড়নায় শৈশব-কৈশোর অতিক্রান্ত করা এক লড়াকু উদীয়মান কিশোরী আন্দোলনের দুঃসাহসিক অভিযাত্রায় যে মাত্রায় নিজেকে সমর্পণ করেন সেখান থেকেই শুরু হয়ে যায় আগামী দিনের ভবিষ্যত পরিকল্পনাও। পঞ্চাশের দশকের ভাষা আন্দোলনের নির্মম গতিপ্রবাহে বাঙালীর অস্তিত্ব সঙ্কটের যে নিদারুণ পালাক্রম তার পূর্ণতার অভিগমন ষাটের দশকের প্রতিটি অধিকার আদায়ের উত্তাল, উত্তেজক ঘটনাপ্রবাহ। আর আয়েশা খানম ছিলেন সেই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পথযাত্রার এক নির্ভীক সৈনিক। সংগ্রামী অভিযাত্রায় নিজেকে উৎসর্গ করার শ্রান্তিহীন দুঃসাহসী পথিক। সেই আদর্শিক বোধে ১৫ বছরের এক লড়াকু তরুণী শামিল হলেন ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলনের বিপ্লবী অভিগমনে। সেই যে শুরু করলেন অমিত তেজ আর অভাবনীয় দেশাত্মবোধের চেতনায় সেখান থেকে আমৃত্যু লড়ে যাওয়া এই নেত্রী সর্বমানুষের অধিকার সুরক্ষার অন্তহীন পথপরিক্রমারও ক্লান্তিহীন যাত্রী। ষাটের দশকের নির্মম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর কঠোর বেড়াজালে বাংলার আপামর মানুষ যখন এক চরম ক্রান্তিকাল পার করছিল সেই দুর্বিষহ আন্দোলন-সংগ্রামের সম্মুখ সারিতে নিজের অবস্থান জানান দিতে কখনও কার্পণ্য করতেন না। সেই সময়ের আর এক পথিকৃৎ নারী নেত্রী ও সৃজন ব্যক্তিত্ব কবি সুফিয়া কামালের সঙ্গে আয়েশা খানমের পথ চলা জীবনের এক অবিস্মরণীয় যোগসাজশ। সঙ্গত কারণ ১৯৭০ সালে মহিলা পরিষদের অভুদ্যয়ে আয়েশা খানমের ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন এই সাহসী কর্মযোদ্ধার অনন্য কীর্তি। সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে মহিলা পরিষদের নেতৃত্বের আসন অলঙ্কৃত করা এক অভাবনীয় মহান কর্তব্য সম্পাদন। নারীদের প্রতি অকৃত্রিম দায়বদ্ধতায় তাদের সম্মুখ সারির লড়াইয়ে অগ্রগামী নেতৃত্বে যে অনমনীয় বোধ তাকে তাড়িত করে সেখানে সর্বমানুষের প্রতিও সমান সচেতন সতর্কতায় আমজনতার পাশে দুঃসময়ে তাদের সহযোদ্ধা বনে যেতেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ’৭০-এর নির্বাচন ছাড়াও যে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় উপকূলীয় জনপদকে বিপন্ন তাণ্ডবের শিকার করে সেখানেও আয়েশা খানমের জনহিতকর কর্মযোগ আজও তাকে স্মরণ করিয়ে দিতে এতটুকু ভাবতে হয় না। কর্মবীর এই অসাধারণ নেত্রী শুধু নারী বলেই নয়, মানুষ হিসেবেও নিজের মর্যাদাকে বরাবরই অক্ষুণ্ন রাখতে অকুণ্ঠিত ছিলেন। জলোচ্ছ্বাস উপদ্রুত এলাকায় তার অবর্ণনীয় কর্মযোগ সে সময়ের এক অনবদ্য কার্যক্রম, যা তাকে চিরস্থায়ী নেতৃত্বের আসনে অনন্য করে তোলে। ৭৪ বছরে অনন্ত যাত্রায় চলে যাওয়া এই অসাধারণ নেত্রী ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী ছিলেন। করোনার বহুল সংক্রমণের দুর্যোগকালেও তিনি এই ছড়িয়ে পড়া রোগটি থেকে নিরাপদ দূরত্বে ছিলেন বলা যায়। দেশে বারবার মাথাচাড়া দেয়া মৌলবাদ আর সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পের বিরুদ্ধে তার সজাগ সতর্ক কঠোর অবস্থান প্রতিপক্ষ শক্তিকে বিদ্ধ করতে নিয়ামকের ভূমিকা পালন করত। ’৬০-এর দশকের উন্মত্ত সময়ের ধারাবাহিকতায় ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেয়া এই উদ্দীপ্ত ব্যক্তিত্ব মুক্তিযুদ্ধেও তার প্রাসঙ্গিক ভূমিকা পালনেও নিজেকে নিঃশর্ত নিবেদন করেছিলেন। ১৯৭২ সালে মহিলা পরিষদের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগ তৈরি হলে তিনি শুরুতে সাংগঠনিক সম্পাদক থেকে সহ-সম্পাদক, সাধারণ সম্পাদক, পর্যায়ক্রমে সভাপতির আসনটিতেও নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করেন। এমন ধারাবাহিক উজ্জ্বল নেতৃত্বে এটাই অবিস্মরণীয় দ্যোতনার আদর্শিক বোধের পরম নিষ্ঠা। শুধু তাই নয়, জীবনের শেষ দিন অবধি এই আদর্শনিষ্ঠতার কোন ব্যত্যয়ই ঘটেনি। যে অনন্য উচ্চতায় সংগ্রামী অভিগমনকে নিরন্তর গতিপ্রবাহে চলমান রেখেছিলেন সেটাই শেষ অবধি সারা জীবনের অসাধারণ কর্মধারার এক অবধারিত সফলতায় উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠে। এমন অক্লান্ত কর্মবীরের শেষ বিদায় কখনও হয় না। তাই চমৎকার ও সর্বজনীন কর্মদ্যোতনা তাকে সাধারণ মানুষের মধ্যে চিরস্থায়ী আসনে বাঁচিয়ে রাখবে। আদর্শের মাপকাঠিতে ভাঙ্গা-গড়ার বিতর্কিত অবস্থানের সঙ্গে তার কোন পরিচয়ই ছিল না। এটাই বোধ হয় কোন অকুতোভয় সংগ্রামী নেতৃত্বের অভাবনীয় প্রাপ্তি। যে আদর্শিক চেতনায় ছাত্র ইউনিয়ন এবং মহিলা পরিষদের নেতৃত্বে নিজেকে দৃঢ় করেছিলেন তেমন মর্যাদায় নিজের শক্ত অবস্থানকে ধরে রেখেই আলোকিত কর্ম ও জীবনের ইতি টানেন। অন্যদিকে বরণ্য মনন ও সৃজন ব্যক্তিত্ব বলিষ্ঠ কথাশিল্পী রাবেয়া খাতুনও আর আমাদের মাঝে নেই। চিরস্থায়ী গমনের পথে তার শেষ যাত্রা এক বেদনাবিধুর অধ্যায়। বাংলা সাহিত্যের আকাশের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র খসে পড়লেও তার অনির্বাণ দীপ্তি আমাদের আলোর দিশারী হয়ে পথ দেখিয়ে যাবে। চিরস্মরণীয় এই সৃজন যোদ্ধা তার অভাবনীয় সম্ভারে বাংলা সাহিত্যের নিবেদিত পাঠকদের হৃদয়ে যে স্থায়ী আসন মজবুত করেন সেখানে তার মর্যাদা এক অনন্য উচ্চতায়, যা তার সার্বিক সৃজন ও মনন বোধকে সব সময় পাঠক সমাজের জন্য এক অনুকরণীয় চেতনা হিসেবে মর্যাদা দিয়ে যাবে। আসলে সৃষ্টিশীল মানুষ তার অনুরাগী-ভক্তদের কাছ থেকে কখনও বিদায় নিতে পারেন না। তার সৃজন শৌর্য তাকে চিরস্মরণীয় আসনে অম্লান করে রাখে। তার দীপ্তিমান শৈল্পিক আবেদনে তিনি বেঁচে থাকবেন কাল থেকে কালান্তরে অগণিত সময়ের পাঠকের কাছে। অসংখ্য প্রজন্মের উজ্জ্বল দ্যুতির চির সাথী হয়ে পাঠকপ্রিয় রাবেয়া খাতুন চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন। ১৯৩৫ সালে ২৭ অক্টোবর জন্ম নেয়া এই বিদগ্ধ কথাশিল্পী ঢাকার বিক্রমপুরের মাতুলালয়ে পৃথিবীর আলো দেখেন। ৮৬ বছরের বর্ণাঢ্য জীবনের যবনিকাপাত টেনে জাগতিক সমস্ত বন্ধনকে ছিন্ন করে চলে যান অসীমের পানে। করোনার মহাদুর্বিপাকও তাকে ছুঁতে পারেনি। বরং বার্ধক্যজনিত হরেকরকম জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হিমশীতল স্পর্শে পরপারে চলে যান। শিল্প শৌর্যের অনন্য মর্যাদায় অভিষিক্ত এই পরম শ্রদ্ধেয় বোদ্ধা তার ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে পাঠক সমাজকে আবিষ্ট করে রাখতেন। শুধু তাই নয়, ছাত্রছাত্রীদের আলোকিত জীবনদর্শন তৈরিতেও তার ভূমিকা ছিল অনবদ্য। শিক্ষকতার মহান পেশায় সমর্পিত হয়ে অসংখ্য শিক্ষার্থীর জ্ঞান প্রদীপ জ্বালানো ছাড়াও জীবনবোধের অনন্য আদর্শেও তাদের উদ্দীপ্ত করে যান এই মানুষ গড়ার মহান শিল্পী। মনন জগতের আর এক সমৃদ্ধ আঙিনা আলোকের ঝর্ণাধারায় ভরিয়ে দিতে তিনি ছিলেন এক অনবদ্য কলম যোদ্ধা। সঙ্গত কারণে সাংবাদিক হিসেবে তার অভাবনীয় দক্ষতা তাঁকে এক মহান কলম লেখকের মর্যাদায়ও সমাসীন করে। শুধু তাই নয় বাংলা একাডেমির সঙ্গে তার নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ প্রতিষ্ঠানটির এক উল্লেখযোগ্য পর্ব। বাংলা সংস্কৃতির বিচিত্র আঙিনায় পথচলা এই শৈল্পিকযোদ্ধা সাহিত্যের ভাণ্ডারকে যে মাত্রায় পরিপূর্ণ করেন সেটাও সমৃদ্ধ জীবনের অনন্য কর্মসাফল্য। মূলত ঔপন্যাসিক হিসেবেই তার সৃজন জগতে চমৎকার অভিনবত্ব। অর্ধশতকেরও অধিক উপন্যাস পাঠকপ্রিয়তার অনন্য উপহারে নন্দিত হয়েছে। পাশাপাশি ছোট গল্পের ঐতিহ্যিক আঙিনাও হরেক রকম সৃজনকল্পের অনন্য উপস্থাপন। ৪০০টি ছোট গল্প পাঠক সমাজকে উপহার দিয়ে এই কীর্তিমান লেখক আপন শৈল্পিক সত্তাকে বিভিন্নভাবে পরিশীলিত করেছেন। এই খ্যাতিমান সাহিত্যিকের গল্পসম্ভারের আলোকে নির্মিত চলচ্চিত্রও দর্শক-শ্রোতার আকর্ষণ তৈরি করতে সময় নেয়নি। সাহিত্যের বহুমাত্রিক আঙিনায় সদর্পে বিচরণ করা এই অনন্য মনন কারিগর গবেষণাধর্মী রচনায়ও নিজের ক্ষমতাকে উজ্জ্বল করেছেন। এছাড়া এই মহান শিল্পীর সম্পাদনায় প্রচারিত হতো ‘অঙ্গনা’ নামে নারীদের জন্য একটি সাময়িকী। প্রতি মাসে প্রকাশ পাওয়া এই ‘অঙ্গনা’ নারী লেখক তৈরিতেও বিশেষ ভূমিকা রাখে। আধুনিক মননের এই বিরাট কলমসৈনিক সমকালীন সমস্ত উত্তাল প্রেক্ষাপটকে সদম্ভে অতিক্রম করে যুগের অগ্রগামী চিন্তায়ও নিজেকে শাণিত করেছেন। পঞ্চাশের দশক মানেই দেশ বিভাজনের অবর্ণনীয় দুর্দশায় নিপতিত বাঙালীর অস্তিত্ব সঙ্কটের নানামাত্রিক লড়াই আর নির্যাতনের ইতিবৃত্ত। তেমন দুঃসময়ে একজন নারী লেখক নিজেকে যুগের উপযোগী করে তৈরি ছাড়াও সময়ের দুর্দান্ত পর্বকে পাড়ি দেয়ার যে নির্ভীক মনোবৃত্তি সেটাই এই অনন্য কলমযোদ্ধার অনির্বাণ দীপ্তি। পরাধীন ভারতে শৈশব-কৈশোর কাটানো এই সাহসী শিল্পী দেশাত্মবোধের অনন্য নিষ্ঠায় নিজেকে উৎসারিত করতেও ভাবতে হয়নি। যুগের প্রয়োজনে অনন্য সৃজন আর মনন দক্ষতায় আপন মহিমায় তৈরি হওয়া এই বিপ্লবী কলমসৈনিক বহু ক্রান্তিকাল অতিক্রম করেছেন আদর্শিক বোধ আর সময়ের নির্ভীক কাণ্ডারির ভূমিকায়। সঙ্গত কারণে পাকিস্তান সৃষ্টির দুঃসহ যাত্রাপথেও তার উদ্দীপ্ত সৃজন ক্ষমতা তাকে আধুনিক ও সময়ের নির্মাতা তৈরিতে অনবদ্য ভূমিকা রেখেছে। কল্লোল যুগকে অতিক্রম করা এই দুঃসাহসী শিল্পী বাংলা সাহিত্যের নবতর আঙিনারও একজন সফল দিশারী ছিলেন। জীবনের বহু সময় ’৬০-এর দশকের নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের সঙ্গে একাত্মতায় ’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ তার চেতনায় নতুন আলোকোদয়ের কিরণ ছড়াতে কিছুমাত্র সময় নেয়নি। বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের আধুনিকতার অভিগমনে তার কলম বরাবরই সময়ের নির্ভীক শক্তি ছিল। বিভিন্ন সম্মান আর মর্যাদায় নিজেকে অভিষিক্ত করেছেন বহুবার। মহান একুশে পদক এবং সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব স্বাধীনতার পদকও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই অনন্য কথাশিল্পীর হাতে তুলে দেন ২০১৭ সালে। শত সম্মাননাকে ছাপিয়ে তার অসম সাহসী কলম যে মাত্রায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের কথা বলেছে সেখানেই তার সর্বোচ্চ আসনটি চিরস্থায়ী মর্যাদায় অভিষিক্ত। এমন অনন্য কথাসাহিত্যিক চিরঅম্লান এবং শাশ^ত দ্যুতিময়। লেখক : সাংবাদিক
×