ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৩ জুন ২০২৫, ৯ আষাঢ় ১৪৩২

আমিনুর রহমান সুলতান

বাউল ঐতিহ্য ও খোদা বক্স সাঁই

প্রকাশিত: ২২:০৮, ৮ জানুয়ারি ২০২১

বাউল ঐতিহ্য ও খোদা বক্স সাঁই

বাংলাদেশের লোক সংস্কৃতির সমৃদ্ধ অঞ্চল বাউল গান। লোকায়ত সাধনার ভেতর বাউলের যে গোপন সাধনা তা বাউল গানের ভেতর দিয়ে অস্তিত্বশীল হয়ে উঠেছে। লোকায়ত এই সাধনা মরমী সাধনার কথা মনে করিয়ে দেয়। আর লালন সাঁই এই ধারার পথিকৃৎ। গুরুবাদী এই পথে আবুল আহসান চৌধুরীর ভাষায় বলা যায়, লালন সাঁইয়ের যে ‘মরমী সাধনার নম্রধারা ও দ্রোহের আগুন’ তার উত্তরাধিকার বহন করেছেন যাঁরা তাদের মধ্যে অন্যতম খোদা বক্স সাঁই। লালন সাঁইয়ের চতুর্থ প্রজন্মের উত্তরসূরি খোদা বক্স সাঁই। লালনের প্রথম প্রজন্মের উত্তরসূরি ছিলেন লালন-শিষ্য মনিরুদ্দিন শাহ। তিনি লালনের গানের প্রচার-প্রসারে নিবেদিত ছিলেন। তিনি নিজে গান রচনা করেননি কিন্তু লালনের গানকে লিপিবদ্ধ করে সঙ্গ্রহে রেখেছেন। আর লালনের প্রয়াণের পর তিনি লালনের ছেউড়িয়ার আখড়া ছেড়ে নিজের বাড়িতে থেকেই লালনের গানের প্রচার করেছেন। তাঁর শিষ্য ছিলেন বর্তমান ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুণ্ডু উপজেলার হরিয়ারঘাটের খোদা বক্স শাহ। তিনি ছিলেন লালনের দ্বিতীয় প্রজন্মের উত্তরাধিকার। যদিও তিনি নিজে গান লিখতেন এবং গাইতেন তারপরেও ‘বিভিন্ন সাধু সেবায় অর্থাৎ ফকিরি মজলিসে গায়ক-গায়িকাদের বেশি বেশি করে লালন-গীতি গাওয়ার জন্য প্রেরণা দিতেন। আগ্রহী শিল্পীদের হাতে লালনের গান পৌঁছে দিতেন। আগ্রহী শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন অমূল্য শাহ। খোদা বকস্ সাঁই হরিয়ারঘাটের খোদা বক্স শাহের শিষ্য ছিলেন শুকচাঁদ শাহ। তবে প্রথম জীবনে লালনের গানে মুগ্ধ হয়ে লালনের গান শেখার জন্য সঙ্গীত শিক্ষার গুরু হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন অমূল্য শাহকে। শুকচাঁদ শাহ ও অমূল্য শাহ ছিলেন লালনের তৃতীয় প্রজন্মের উত্তরাধিকার। আলোচ্য জাঁহাপুরের খোদা বক্স সাঁই শুকচাঁদ শাহর কাছে শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তবে তিনি লালনের ভাবসঙ্গীতের তালিম নিয়েছিলেন অমূল্য শাহর কাছ থেকে। অমূল্য শাহ ছিলেন উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের বিশেষজ্ঞ শিল্পী। লালন ভক্ত হওয়ার পর তিনি একতারা ও বায়া হাতে লালনের গান করতেন। খোন্দকার রিয়াজুল হক তাঁর একটি গ্রন্থে যথার্থই বলেছেন- ‘একতারা-বায়া সহযোগে লালন-সঙ্গীত পরিবেশনের যে ধারা অমূল্য কর্তৃক প্রবর্তিত হয় খোদা বক্স সাঁই সে ধারারই পূর্ণতাপ্রাপ্ত শিল্পী।’ মনিরুদ্দিন শাহ্, হরিয়ারঘাটের খোদা বক্স শাহ, শুকচাঁদ ও অমূল্য শাহর মতো ধারাবাহিকতা বজায় রেখে জাঁহাপুরের খোদা বক্স সাঁই লালনের চতুর্থ প্রজন্মের উত্তরাধিকার। অমূল্য শাহ শুকচাঁদ শাহর ভাবসঙ্গীতের গুরু ছিলেন। শুকচাঁদ শাহই তাঁর শিষ্যকে অমূল্য শাহের আখড়ায় পাঠিয়েছিলেন সঙ্গীতে তালিম নেয়ার জন্য। শুকচাঁদ খোদা বক্স সাঁইয়ের দীক্ষাগুরু এবং অমূল্য শাহ ভাবসঙ্গীতের শিক্ষাগুরু। খোদা বক্স সাঁইয়ের প্রকৃত নাম মোহাম্মদ খোদা বক্স বিশ্বাস। ১৯৭৬ সালে গুরুর কাছ থেকে খেরকা খেলাফত (ফকিরি পোশাক) গ্রহণ করার পর থেকে বংশগত পদবি ‘বিশ্বাস’ এর পরিবর্তে সাঁই বা শাহ যুক্ত করেন তাঁর নামের শেষে। তাঁর জন্ম ১৩৩৪ সালের ৩০ চৈত্র (চৈত্র সংক্রান্তিতে) জাঁহাপুর গ্রামে। গ্রামটি চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার অন্তর্গত। তাঁর বাবার নাম কফিল উদ্দিন বিশ্বাস, মায়ের নাম ব্যাশোরণ নিছা। চার ভাই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। বড় ভাইয়ের নাম নছর উদ্দিন বিশ্বাস, মেজো ভাইয়ের নাম আরশাদ আলী বিশ্বাস, ছোটো বোনের নাম দৌলাতন নেছা। তাঁর সাধন সঙ্গিনী ছিলেন রাহেলা খাতুন। দুই সন্তানের জনক তিনি। একছেলে আবদুল লতিফ বিশ্বাস ও এক মেয়ে মালঞ্চ। খোদা বক্স সাঁই ১৯৮৬ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হন এবং ১৯৯০ সালের ১৪ জানুয়ারি, ১৩৯৭ সালের ১ মাঘ মৃত্যুবরণ করেন। খোদা বক্স সাঁই প্রথমত বাউলশিল্পী। তিনি চর্চা করতেন ভাবসঙ্গীতের। বিশেষ করে লালন সঙ্গীত। লালন সাঁইয়ের গান ছাড়াও তিনি গানের অনুশীলন করেছেন দুদ্দু শাহ্, পাঞ্জু শাহ, রামকৃষ্ণ ক্ষ্যাপা, রাম পাল, রামচন্দ্র, রাধাশ্যাম, গুরুচাঁদ গোসাই, গোপাল, কাশেম শাহ্, একরাম শাহ, মফিজ উদ্দিন শাহ প্রমুখসহ আরও ৭৪ জন বাউল ফকিরের গান। শুধু লালন ফকিরেরই ৫০০ (পাঁচ শত) গান দক্ষতার সঙ্গে গেয়েছেন, অন্যান্য বাউল সাধকদেরও প্রচুর গান তিনি পরিবেশন করেছেন। বাউল গানের সঙ্গ্রহের ভাণ্ডার ছিল তাঁর কাছে। তাঁর কাছে যে প্রচুর গান সংগ্রহ ছিল এবং দেশী-বিদেশী বাউল গানের সঙ্গ্রাহক ও গবেষকদের সহযোগিতা করেছেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় জাপানি গবেষক মাসাইয়ুকি ওনিশির এক পত্রে। ১৯৮৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারিতে খোদা বক্স সাঁইয়ের কাছে পাঠানো পত্রে তিনি লিখেছেন, ‘আপনি যেদিন ঢাকাতে এসেছিলেন তখন আমি কুষ্টিয়াতে। তারপরে আবার ঢাকাতে ফিরে এসে দেখলাম, আপনি আলমডাঙ্গাতে চলে গেছেন। তাঁর ফলে আপনার সঙ্গে দেখা এবারে আর সম্ভব হলো না। আমি আগামীকাল জাপান রওনা হব। এবং আগস্ট মাসের দিকে আবার ঢাকাতে চলে আসব। সেই সময় আশা করি আপনার সঙ্গে দেখা হবে। আমি মধু সাহেবের কাছে আমাদের গান-সঙ্গ্রহের কাজের সমস্ত দায়িত্ব দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের কাজ যাতে সুস্থ এবং সুন্দরভাবে চলবে, সেই দিকে আপনি লক্ষ্য রাখলে আমি খুব খুশি হব। কেননা আপনার কাছে যেসব গানের সংগ্রহ আছে, সেগুলো চিরদিন বিশ্বের কাছে রাখার যোগ্য বলে আমি মনে করি।’ খোদা বক্স সাঁইয়ের কাছে বাউল গান সঙ্গ্রহের জন্য তাঁর বাড়িতে থেকেছেন আমেরিকান গবেষক ক্যারল সলমন। লালনসহ অন্যান্য বাউল সাধক ও কবিদের সঙ্গৃহীত গানের ভাণ্ডার তাঁর সমৃদ্ধ থাকায় এবং লালনসহ অন্যদের গানের সুর আয়ত্তে এনে পরিবেশনায় সুরের মুন্সিয়ানা দেখানোর জন্য লালন পরিষদ কেন্দ্রীয় সংসদ তাঁকে ‘সঙ্গীত সাগর’ উপাধিতে ভূষিত করেন। লালনের গান পরিবেশনার ক্ষেত্রে তাঁর যে দক্ষতা এবং কৃতিত্ব এ ব্যাপারে ফোকলোরবিদসহ অনেক সুধীজন মূল্যায়ন করেছেন। লালন সঙ্গীত তাঁর কণ্ঠে গাওয়ার বিষয়ে মূল্যায়ন করেছেন সুধীন দাশ। খোন্দকার রিয়াজুল হককে দেয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেছেন- ‘একতারার রিনি-ঝিনি আওয়াজ এবং বায়ার (ডুগির) ওস্তাদী বোলবাণী আমাকে অভিভূত করেছিল। আমি সম্মোহিত হয়েছিলাম। গ্রামের একজন সাধক-ফকিরের গান এতো ওস্তাদী কায়দায় গাওয়া যায়, আগে আমার তা জানা ছিল না। অন্তরা-শেষ করে মুখ গেয়ে তেহাই দেয়ার অপূর্ব ভঙ্গি, অন্তরার মাঝেও তাই দেয়ার কৌশল এতই বিস্ময়কর ছিল; যা আমি ভাবতেই পারি না।’ খোন্দকার রিয়াজুল হককে দেয়া সাক্ষাতকারে ফোকলোরের ‘এ্যাকটিভ ট্র্যাডিশন বিয়ারার’ বা ‘সক্রিয় ঐতিহ্যবাহক’ হিসেবে খোদা বক্স সাঁইয়ের মূল্যায়ন করেছেন লোকবিজ্ঞানী শামসুজ্জামান খান। তাঁর মন্তব্য উল্লেখ করছি- ‘খোদা বক্স শাহ এ্যাকটিভ ট্র্যাডিশন বিয়ারার হিসেবে খুবই সার্থক ছিলেন। তিনি লালন-সঙ্গীত এবং অন্যান্য বাউল গান গাইতেন, এর ব্যাখ্যা ও তত্ত্ববস্তু জানতেন, নিজস্ব শিষ্যদের মধ্যে প্রচার করতেন। সেদিক থেকে তাঁকে বাউলতত্ত্ব বা ফকিরিতত্ত্ব এর যথার্থ ঐতিহ্যবাহক বলা যায়। ফোকলোরের সঙ্গীত প্রকরণের তিনি প্রকৃত এ্যাকটিভ ট্র্যাডিশন বিয়ারার ছিলেন।’ ফোকলোর চর্চার দৃষ্টিভঙ্গিতে খোদা বক্স সাঁইকে মূল্যায়ন করা হলে- তাঁর লালনগীতি ঐতিহ্যবাহকের পরিচয় দিয়েছেন তা তাঁর সমকালের অন্য কোন লালনের গানের শিষ্যদের মাঝে পাওয়া দুর্লভ। মৌলিকত্ব একারণে যে, তিনি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত আয়ত্তে থাকায় মনিরুদ্দিন শাহ, খোদা বক্স শাহ্ হয়ে অমূল্য শাহ লালনের গানকে যেভাবে মূল ধরে নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন- সে ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য খুবই মেধাবী ও পরিশ্রমী ছিলেন। তার সঙ্গীত শিক্ষার গুরুর কাছ থেকে যখন গান কণ্ঠে নিয়েছেন তখন গানের মর্মার্থ ও সুরকে উপলব্ধি করেছেন। আর এ জন্য তাঁর কাছ থেকে লালনের গানের মর্মার্থ ও গূঢ়রহস্যে উন্মোচনের জন্য ক্যারল সলমন ও ওশিনির মতো আমেরিকান ও জামার্নির গবেষককে তাঁর বাড়িতে অবস্থান করতে হয়েছে। সম্পর্ক স্থাপন করে তাদের লক্ষ্যে পৌঁছার চেষ্টা করেছেন। এ বিষয়ে শামসুজ্জামান খানের মূল্যায়ন স্মর্তব্য- ‘ফোকলোরের মরমী সঙ্গীতধারা অনুসরণে খোদা বক্স শাহ আন্তর্জাতিক ফোকলোর গবেষকগণের মানস-জগতে স্থান করে নিয়েছিলেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, আমেরিকার প্রখ্যাত ফোকলোর গবেষক ডক্টর ক্যারল সলমন লালন-সঙ্গীত নিয়ে গবেষণা করার সময় বাংলাদেশে আসেন। তিনি লালন-সঙ্গীতে বিধৃত গুহ্য সাধন-প্রণালীর ব্যাখ্যা পেয়েছিলেন খোদা বকসের কাছে। খোদা বকসের নিকট প্রাপ্ত তত্ত্বকথা লাভের ফলেই ক্যারল সলমন আজ আন্তর্জাতিক লালনতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ বলে বিবেচিত। এর মূল কৃতিত্ব খোদা বকস শাহেরই প্রাপ্য। এ অতি বড় গৌরবের কথা। এ গৌরব সমগ্র বাংলাদেশের গৌরব, বাঙালী জাতির গৌরব। খোদা বকস শাহ সেই জাতীয় গৌরব সৃষ্টিকারী সাধক ছিলেন। আন্তর্জাতিক ফোকলোর চর্চার বাউল-ঐতিহ্য ধারার অমর শিল্পী খোদা বকস শাহ।’ সাইমন জাকারিয়ার সঙ্গে কথা হয় খোদা বক্স সাঁই সম্পর্কে। তার মূল্যায়ন উল্লেখ করছি-‘লালন সাঁইয়ের গানের প্রামাণ্য পাঠ, আদি সুর ও গায়কী ধারণ করতেন খোদা বক্স সাঁই। এমনকি লালনের গানের গূঢ় অর্থ তাঁর জানা ছিল। তাই আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের গবেষকেরা লালনের গান নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে ও অনুবাদ করতে গিয়ে খোদা বক্স সাঁইয়ের আশ্রয় নিতেন। আমেরিকান গবেষক ও ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির বাংলা বিভাগের শিক্ষক ড. ক্যারোল সলোমন দীর্ঘদিন ধরে খোদা বক্স সাঁইয়ের সঙ্গ নিয়ে লালন সাঁইয়ের ১৩৭টি গানের প্রামাণ্য পাঠ ও ইংরেজী অনুবাদ সম্পন্ন করেন। যা ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, নিউইয়র্ক থেকে সিটি অব মিরোরস : সংস অব লালন সাঁই (আরশিনগর : লালন সাঁইয়ের গান) নামে প্রকাশিত হয়েছে। এই গ্রন্থে খোদা বক্স সাঁইকে যথার্থভাবে স্বীকৃতিও দেয়া হয়েছে।’ দুই খোদা বক্স সাঁই দ্বিতীয়ত বাউল গানের সাধক কবি। তিনি ১০০০-এর ওপর বাউল গান লিখেছেন। তিনি বাউল সাধনার বিভিন্ন স্তর ও সাধুসঙ্গের পর্যায়ের বিভিন্ন ধারার গান লিখেছেন যেগুলো হৃদয়গ্রাহী ও বাউল সাধনার গূঢ় রহস্যকে ধারণ করে আছে। বাউল সাধনার ৪টি স্তরের মধ্যে রয়েছে (১) স্থূল (শরিয়ত সাধনার শিক্ষা), (২) প্রবর্ত (তরিকত সাধনার শিক্ষা), (৩) সাধক (হকিকত সাধনার শিক্ষা), (৪) সিদ্ধি (মারফতে সাধনার শিক্ষা)। সাধুসঙ্গের পর্যায়ের গানের মধ্যে রয়েছে আবাহনী বা আগমনী গান, গোষ্ঠ গান, দৈন্য গান, মনঃশিক্ষা, তত্ত্বকথার মধ্যে দেহতত্ত্ব, বিচ্ছেদ, মাধুকরী করার লক্ষ্যে ভিক্ষাপর্বের গান প্রভৃতি। বিশ্ববিখ্যাত সাধকশিল্পী পূর্ণ দাস বাউল ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারির ২৫ তারিখে খোদা বক্স সাঁইয়ের পুত্র আবদুল লতিফ শাহ্র কাছে একটি পত্রে তাঁর যে-গুণগান করেছেন তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। পূর্ণ দাস বাউলের চিঠির অংশ বিশেষ থেকে যথার্থ মূল্যায়ন পাওয়া যাবে। তিনি লিখেছেন, ‘তোমার পিতা শ্রদ্ধেয় খোদা বক্স সাঁই-জী ছিলেন আমার মিত্র স্থানীয়। সাঈ-জীর সঙ্গে বহুবার নানা মহোৎসব, আখড়ায় সাক্ষাত ঘটেছিল এবং বহু তত্ত্ব আলোচনা সুযোগ হয়েছিল। সাঈ-জী ছিলেন অত্যন্ত উচ্চ মার্গের সাধক আবার ছিলেন সমঝদার এবং কৃতী বাউল ও ফকির সুর সাধক তথা রচয়িতা। সাঈ-জীর রচিত বহু গান আজ বহুল চর্চিত, ওই মরমী বাউল সুর সাধক-এর প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালবাসা জ্ঞাপন করি।’ খোদা বক্স সাঁই নিজেকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন নিষ্ঠার সঙ্গে, পরিশ্রমী হয়ে মেধাকে শাণিত করে। তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না বললেই চলে। ঘোলদাড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছিলেন। তার কণ্ঠ ছিল সুরে ভরা। পাশের গ্রামের যাত্রা দলে যোগ দেন ওই বয়সেই। ষোলো বছর পর্যন্ত যাত্রা দলে পেশাদারিত্বের সঙ্গে চাকরি করেছেন বিবেকের ভূমিকায়। সতেরো বছর বয়স থেকে ভাবসঙ্গীতের প্রতি আকৃষ্ট হন। ১৯৭৩ সালে তিনি বাংলাদেশ বেতার ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস আয়োজিত প্রথম জাতীয় লোকসংস্কৃতি সপ্তাহের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। তখনকার সময়ে বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালক এম আর আখতার (মুকুল) স্বাক্ষরিত একটি প্রশংসাপত্রও পেয়েছিলেন। নিয়মিত গান পরিবেশন করেছেন বেতার ও টেলিভিশনে। বাংলাদেশের বাইরেও বিভিন্ন সম্মেলনে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন। বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের আমন্ত্রণে ১৯৮২ সালে শান্তি নিকেতনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে লালনগীতি পরিবেশন করেছেন। লালনগীতির প্রচার, পরিবেশন ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা অপরিসীম। তিনি শিল্পকলা একডেমির শিক্ষা বিভাগের ১৯৮৩ সালের ৯ জুন থেকে ১৯৮৭ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত লালনগীতির প্রভাষক ছিলেন। তাঁর কাছ থেকে লালনগীতি শিক্ষা গ্রহণ করেছেন মোকছেদ আলী সাঁই, ফরিদা পারভীন, ঢাকায় বসবাসরত চন্দনা মজুমদার, দিল আফরোজ রেবা, দীপ্তি রাজবংশী, মনোয়ারা বেগম, কাননবালা সরকার, আজমল শাহ, পাগলা বাবলু প্রমুখ খ্যাতিমান বাউল-সাধক ও লোকশিল্পীবৃন্দ। বাউলশিল্পী ও সাধকের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৯৮৫ সালে বাংলা একাডেমি থেকে সম্মানসূচক ফেলোশিপ অর্জন করেন। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ একুশে পদক ১৯৯০ (মরণোত্তর) লাভ করেন তিনি। উল্লেখ্য, বাউল সাধকশিল্পী হিসেবে খোদা বক্স সাঁই-ই প্রথম ব্যক্তি যিনি একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন। প্রসঙ্গক্রমে ফোকলোর সাধক খোন্দকার রিয়াজুল হকের কথা উল্লেখ করতেই হয়। মরমী কবি খোদা বক্স শাহ : জীবন ও সঙ্গীত গ্রন্থটি তাঁরই প্রণীত। ফোকলোর সাধক হিসেবে তিনি এই গ্রন্থে অনন্য কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। আধুনিক ফোকলোর চর্চার অন্যতম দিক হচ্ছে ফিল্ডওয়ার্ক। যথার্থ ফিল্ডওয়ার্কের জন্য খোন্দকার রিয়াজুল হককে ফোকলোর সাধক হিসেবে আমরা অভিহিত করতে পারি। তিনি যে একই জায়গায় বার বার গিয়ে সঠিক তথ্যকে ধারণ করেছেন তার প্রমাণ পাওয়া যায়-খোদা বক্স সাঁই লালনের গানের সাধকশিল্পী ও বাউল গানের সাধক কবি হিসেবে তুলে ধরার ক্ষেত্রে। খোদা বক্স বিশ্বাস থেকে কীভাবে খোদা বক্স সাঁই হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন তাঁর নিখুঁত চিত্র এঁকেছেন মাঠ পর্যায়ের তথ্যভিত্তিক। যেমন : লালনের গান থেকে শুরু করে পাঞ্জু শাহসহ অনেকের গান গাওয়ার ক্ষেত্রে তিনি যাদের নাম উল্লেখ করেছেন তা মাঠপর্যায়ের সমীক্ষা না থাকলে সম্ভব হতো না। তিনি যে লালন সাঁইয়ের গানের ধারার চতুর্থ প্রজন্মের উত্তরাধিকার তাও মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতার ফসল হিসেবেই আমরা বিবেচনা করবো। খোদা বক্স সাঁইয়ের গান, এবং তাঁকে বুঝাবার জন্য একাধিক ফোকলোর সাধক, গবেষকের সাক্ষাতকার পরিকল্পনা ও প্রকৃত গবেষকের পরিচয় বহন করে। সাধুবাদ খোন্দকার রিয়াজুল হক-কে। তবে যে পরিমাণ তথ্য তিনি সংগ্রহ করেছিলেন সেসব যুক্ত হলে খোদা বক্স সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানা যেত। বর্তমানের বা আগামীর যাঁরাই খোদা বক্সকে নিয়ে গবেষণা করবেন-তাদের জন্য গ্রন্থটি খুবই সহায়ক হবে। তিনি খোদা বক্স সাঁইয়ের ১০০টি গানও সংগ্রহ করেছেন। সাঁইয়ের পুত্র আবদুল লতিফ বিশ্বাস ও তাঁর শিষ্যদের কাছে। অনেক গানের শ্রেণিবিন্যাস করে সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। তিন চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার জাঁহাপুর গ্রামে খোদা বক্স সাঁইয়ের আখড়া বাড়িতে রয়েছে তাঁর সমাধি। প্রতিবছর ১৪ জানুয়ারি তাঁর তিরোধান দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠিত হয় সাধুসঙ্গ। বাউলের পাঁচ ঘর খ্যাত গুরু ও বাউল সাধকরা ১৪ জানুয়ারি বিকেলে আখড়া বাড়িতে এসে যার যার আসন পেতে বাউলের কৃত্যাচার সম্পন্ন করে পরের দিন চলে যান। কৃত্যাচারে লালন ও অন্যান্য বাউল সাধকদের গান ছাড়াও খোদা বক্স সাঁইয়ের গান পরিবেশন করেন তাঁর শিষ্য ও ভক্তবৃন্দ। কৃত্যাচারে পরিবেশিত তাঁর কয়েকটি গানের আলোচনা করা হলো। সাধুসঙ্গে প্রথম পর্যায়ে গাওয়া হয় আগমনী বা আবহনী গান। খোদা বক্স সাঁই লিখেছেন এ-ধরনের প্রচুর গান। সেসব গানের মধ্যে অন্যতম শ্যামাসঙ্গীত। দেশাত্মবোধ থেকেই শক্তি দেবীর মহিমা কীর্তন করেই শ্যামা সঙ্গীতের সৃষ্টি হয়েছে। দুর্গা ও চণ্ডির আরেক রূপ কালী। মা কালীকে সম্বোধন করে রচিত গানগুলোতে ভক্তির প্রাধান্য রয়েছে। রাগ্রাশ্রয়ী এবং সরলভক্তিভাব উভয় ধারার শ্যামাসঙ্গীত রচিত হয়েছে। এক্ষেত্রে নিধুবাবু, দাসরণী, রাম প্রসাদ, গিরিশ ঘোষ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য শ্যামসঙ্গীত রচনা করেছেন। কাজী নজরুল ইসলাম বিশ শতকে শ্যামাকে সর্বধর্মের উপযোগী করে শ্যামাসঙ্গীত রচনা করেছেন। খোদা বক্স সাঁইও রচনা করেছেন এ শীর্ষক উল্লেখযোগ্য শ্যামাসঙ্গীত। আমিত্ব বিনাশী শ্যামাকে খোদা বক্স সাঁই গ্রহণ করেছেন তার আত্মদর্শনের গানগুলোর মধ্য দিয়ে। শ্যামাসঙ্গীতে মাতৃভক্তি ও মাতৃবন্ধনা মায়ের আবাহন সৃষ্টি করেছে। খোদা বক্স সাঁইও ভাবসঙ্গীতের ধারায় একাধিক শ্যামাসঙ্গীত রচনা করেছেন। গানগুলো সহজ সরল ভাষার হলেও ভাবের গভীরতা রয়েছে- এসো মা আনন্দময়ী নিরানন্দ দিয়ে বিদায়/সদানন্দ হও মা উদয়, মান-অভিমান কারো না তায়/যে আনন্দ লাগি মা গো করিয়েছ এ সৃজন/সেই আনন্দে আনন্দিত রাখো সদা ভক্তের মন/কৃপানন্দ বারি দিয়ে, তম-অন্ধ দাও মা ধুয়ে/থাকি আমি তোমায় লয়ে, যাতে সন্দ নাহিক রয়/সদানন্দ রূপে তুমি থাক এই ভূমণ্ডলে/মহানন্দ হয়ে মাগো সৃষ্টি পালন করিলে/থাক এ মহীমণ্ডলে জলেস্থলে মন-কমলে/কেহ শুধু মুখে বলে, স্বচক্ষে দেখে নাই তোমায়/প্রেমানন্দ রূপে তুমি দিও দেখা অজ্ঞানে/তোমার মহিমা মাগো বিজনে আর বিপিনে/এসেছি তোমার সন্দানে দীনহীন এই বকস ভনে/তোমা বই অন্য জানিনে, সর্বানন্দে হয়ো সহায়॥ সাধুসঙ্গের একটি গানের কিছু অংশ তুলে ধরছি- শুভ সাধুসঙ্গ লয়ে সঙ্গপঙ্গ/বনবিহঙ্গ প্রসন্ন করিলে/জলে ফুটেছে কমল হলো সরোবর উজ্জ্বল/নবপল্লব তরুতল ছায়া সুশীতল/নবনিত্য ফুলে ভরিল ডালা/কুড়াইয়া কেহ গাঁথিল মালা/তাই হয়েছে উজালা, মুখে যায় না বলা/যেমন তারার মালা চাঁদের গলে॥ সাধুসঙ্গের গোষ্ঠ পর্যায়ের গানও লিখেছেন খোদা বক্স সাঁই। এই পর্যায়ের গানগুলো শ্রীকৃষ্ণ গোষ্ঠে অর্থাৎ গোচারণ ভূমিতে যাবার কথা বলা হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণকে বলরাম গোচারণে যাবার আহ্বান করছেন তাতে শ্রীকৃষ্ণের মা ঘোর আপত্তি জানান। তাঁর গানের কয়েকটি পঙ্ক্তি উল্লেখ করছি-ও ভাই কানাই তোর কি মানায়/মায়ের কোলে শুয়ে হা-রে/আমাদের কি মা নাই বলে/তুই মনে ভাবিস তাইরে/তুই আমাদের প্রাণের কানাই/মাকে ডেকে হওরে বিদায়/যদি কৃপা করে গুরু দয়াময়/দীনহীন এই বকসর পরে॥ সাধুসঙ্গের গোষ্ঠ পর্বের গান শেষে গাওয়া হয় দৈন্যগান। খোদা বক্স সাঁই লিখেছেন দৈন্যগান। দৈন্যগান গুরু শিষ্যের সম্পর্কের বিষয় থাকে। গুরুর কৃপা প্রার্থনা করা হয়। যেমন- পড়েছি ঘোর সঙ্কটে একলা বটে/কেউ নাই আজ আর মোর নিকটে/বেড়াচ্ছি ছুটে-ছেটে মাঠে-ঘাটে/কখনও যাই নদীর তটে/তুমি দীনবন্ধু বটে পাই শটে/মন্দির মঠে গির্জা পাঠে/থাকো তুমি সর্বঘটে জানি বটে/কারও দূরে আর কারো নিকটে॥... বৈষ্ণব সাধনার যুগ থেকে রাধা কৃষ্ণের প্রেমের মধ্যে যে বিরহ বিচ্ছেদ তা ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়ায়। আর সে ঐহিত্যকে ধারণ করেছে বাউল সাধকরাও। রাধার বিচ্ছেদ নিয়ে প্রচুর গান রয়েছে। খোদা বক্স সাঁইও লিখেছেন রাধার বিচ্ছেদ-মন আগুনে বন পুড়ে যায়/কে দেখবে আসিয়া/জলে তো নেভে না আগুন/দ্বিগুণ ওঠে জ্বলিয়া/তীরবিঁধা হরিণের মতো/ছুটে বেড়াই অবিরত গো/বিষে অঙ্গ জ্বরজ্বর/কারে কই বুঝাইয়া/দংশিল গোক্ষুরা ফনী/নামে না বিষ প্রাণ সজনী গো/প্রাণ যাইবার আগে যেন/একবার যাইও দেখা দিয়া/কি করিব কোথা যাব/কোথা যেয়ে প্রাণ জুড়াবো গো/ব্যথায় ব্যথিত না হউলে/কারে কইব কথা খুলিয়া ॥ বাউল সাধনার দেহ হচ্ছে অন্যতম প্রধান উপকরণ। তাই দেহকে কেন্দ্র করে তত্ত্বকথা লালন থেকে শুরু করে তার অনুসারীরাও প্রচুর গান লিখেছেন। দেহতাত্ত্বিক গান লিখেছেন খোদা বকস্ সাঁইও। যেমন- বন্ধুর আমার পূব দুয়ারি ঘর/কেমন করে করব প্রবেশ ভাবি যে তায় নিরন্তর ॥/বারামখানা শুনি এই ঘরে/ঝড় বাদলে জল পড়ে না বলব আর কারে/কল বেতে নড়েচড়ে যুক্ত আছে তিনটি তার ॥/মন পবনে চলে সে বেড়ায়/রাজা প্রজা আছে সব সেথায়/চন্দ্র সূর্য হয় যে উদয়, সেই যে ঘরের ভিতর ॥/সেই ঘরের ঘরামি কোথায়/তার সন্ধান করে দেশ দেশান্তর ঘুরিয়া বেড়ায়/দীন বক্স কয় ঘরে বেহাত সদায়/চাবি ছোড়াল নাই আমার ॥ খোদা বক্স সাঁই ফকিরি ঘরানার বিভিন্ন পর্যায়ের গান রচনা করেছেন। চার খোদা বকস্ সাঁই লালন সাঁইয়ের গানের শিল্পী ও লালনের গানের গূঢ় অর্থের ব্যাখ্যা দাতা হিসেবে দেশে বিদেশের সাধারণ থেকে শুরু করে গবেষকদের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছেন। আবার ভাবসঙ্গীতের সাধনায় নিজেও একজন সাধক গায়ক। তাঁর গানেও যে প্রতীক ব্যবহার করেছেন- সে প্রতীকে আত্মদর্শনের ধারণা গভীর রহস্য নিয়ে শিল্পময় হয়ে ফকিরি ঘরানায় ধরা দেয়। তাঁর গানের শব্দের ভেতর এক ধরনের গোপনীয়তা ও রহস্য প্রতীক রূপে প্রতিভাত। যেমন- ‘মনপোড়া’, ‘বনপোড়া’, ‘নবীন মেঘ’, ‘ফুলের আঘাত’, ‘ঊর্মিলার রাজ্য’ প্রভৃতি। প্রতীকের এসব শব্দের ভেতর গভীর দ্যোতনা ও অর্থের ব্যঞ্জনার প্রসারতাকে উপলব্ধি করা যায়। লালন কিংবা তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের অনুসারী যখন ভাবসঙ্গীত লিখেছেন তখন ভাবের ব্যাপ্তিকে আবেগের উচ্ছলতায় প্রকাশের জন্য যে চিত্র এঁকেছেন-তা যে চিত্রকল্প, এ বিষয়ে তাদের ধারণা ছিল না। কারণ, ‘চিত্রকল্প’ নামক ধারণাটি আধুনিক কালের। খোদা বকস্ সাঁইয়ের অনেক গানে নতুন নতুন চিত্রকল্পের ব্যবহার লক্ষ করা যায়- যা গানের ভেতর আবেগ সঞ্চারি হয়ে ফুটে উঠেছে। যেমন- ‘কুসুমের হার কণ্ঠে দিলাম তার’, ‘নীলাম্বরী শাড়ি করে পরিধান’, ‘তোমার সরল বদন স্নেহের কিরণ’, ‘ঘন-সৌদামিনী যেমন খেলে তেমন’, ‘দীঘি এক ঘোড়ার দৌড়ের দৈর্ঘ্য যে তাহার’ প্রভৃতি। ব্যক্তি মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন বন্ধু বৎসল, মানবিক গুণে গুণান্বিত, ছলচাতুরি পছন্দ করতেন না। গুরুভক্তিতে তাঁর তুলনা অতুলনীয়। শুকচাঁদ তাঁর দীক্ষাগুরু। তিনি যে তাঁর পথের দিশারি এবং দরবেশ নিজের লেখা গানেও প্রকাশ করেছেন। যেমন- দীঘি এক ঘোড়ার দৌড়ের দৈর্ঘ্য যে তাহার/যাত্রীরা পানি নিয়ে যায় দেশ-দেশান্তর/দরবেশ শুকচাঁদ সাঁই আমার করিবেন উদ্ধার/বকস ভাব ঐরূপ তব হৃদয় আজ ॥ লালনের কাছেও যে তার অপরিসীম ঋণ এবং তার মতো ভক্তরা ডাকলে লালন সাঁই সাড়া দেন- এবিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে পৃথিবীব্যাপী লালনের যে মহিমা তাঁর গুণকীর্তন করছেন একটি গানে। যেমন- আদি তীর্থধাম ছেঁউড়িয়া এই গ্রাম/করিলাম বিশ্রাম মহত-আঙিনায়॥/সমাধি-মন্দির দেখে মন হয় অস্থির/দুই নয়নে নীর বহিছে সদায়॥/অন্তিম শয্যায় শুয়ে আছে যে সবায়/ভক্তিভাবে ভেবে ডাকলে সাড়া দেয়/অভক্তের সেজন না দেয় দরশন/হলে এক মন ডাকলে পাওয়া যায় ॥/কাঁচে ঢাকা বহ্নি আছয়ে যেমন/মন্দিরে নিদ্রা যায়, সাঁই দরবেশ লালন/তাহারি কিরণ ভক্তবৃন্দগণ/চারদিকে তারা করিছে রশনায় /পৃথিবী ব্যাপিয়া তোমারি মহিমা/ক্ষুদ্র জীব আমি দিতে নারি সীমা/অধীর বকস কয় যেন যুগে যুগে/এ দেহ-মনপ্রাণ দিলাম তব পায় ॥ খোদা বক্স সাঁইয়ের লালনের ও অন্যান্য বাউল সাধকদের গানের সাধনা এবং তাঁর নিজের রচিত এবং কণ্ঠে প্রচারিত গানের যে সাধনা তা নিয়ে গবেষণা হতে পারে, যাÑ বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করবে। তাঁর আখড়া বাড়িতেই গড়ে উঠতে পারে ‘খোদা বক্স সাঁই গবেষণা কেন্দ্র’।
×