ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাগেরহাটে ডাকরা গণহত্যা দিবসে স্মরণসভা

প্রকাশিত: ২১:১৯, ২১ মে ২০২২

বাগেরহাটে ডাকরা গণহত্যা দিবসে স্মরণসভা

স্টাফ রিপোর্টার, বাগেরহাট ॥ “কখনো পৃথিবীর কোথাও আর গণহত্যা সংগঠিত না হয় এজন্য গণহত্যা নিয়ে আমাদের গবেষণা, শোকসভা, স্মরণসভা পালন করতে হবে। ঘৃণ্য সেই হত্যার রাজনীতিকে ঘৃণা করতে হবে। প্রতিবাদ প্রতিরোধের মাধ্যমে হত্যার রাজনীতি, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ইতিহাসের আস্তাকুঁড়েই নিক্ষেপ করতে হব। সবাইকে সজাগ থাকতে হবে, কারণ কুচক্রীরা, হত্যাকারীরা, সম্রাজ্যবাদীরা, ধর্মব্যবসায়ীরা এখনো থেমে নেই। তারা সুযোগের অপেক্ষায় আছে। তাদেরকে সুযোগ দেওয়া যাবে না। হত্যাকারীদের বিচার নিশ্চিত করতে হবেই।” ডাকরা গণহত্যা’ দিবসের স্মরণ সভায় শনিবার (২১ মে) বক্তারা এ কথা বলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১-সালের এদিনে রাজাকার কমান্ডার রজ্জব আলী ফকিরের নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার পেড়িখালী ইউনিয়নের ডাকরা গ্রামে নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে ৬’শ মানুষ হত্যা করেছিল। নিহতদের স্মরণে ডাকরা বধ্যভূমিতে প্রতি বছরের ন্যায় এবারও স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ, স্মৃতিচারণ, শোক র‌্যালী, আলোচনা সভা ও সন্ধ্যায় মোমবাতি প্রজ্বলন করে শহীদদের স্মরণ ও তাঁদের আত্মার শান্তি কামনা করা হয়। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার অতীন্দ্রনাথ হালদার দুলাল এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় স্বাগত বক্তব্য দেন পিসি রায়। অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন, সাবেক প্রধান শিক্ষক বিষ্ণুপদ বাকচী, সাবেক রবীন্দ্র নাথ মন্ডল প্রমুখ। এ সময় ডাকরা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী এ এলাকাবাসী উপস্থিত ছিলেন। সন্ধায় রামপাল উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. কবীর হোসেন শহীদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভে মোমবাতি প্রজ্বলন ও তাদের আত্মার শান্তি কামনা করেন। এ সময় তার সাথে ছিলেন বাঁশতলী ইউপি চেয়ারম্যান মো. মোস্তাফিজুর রহমান সোহেল। এ বিষয়ে ডাকরা বধ্যভূমির স্মৃতিস্তম্ভের জমিদাতা পিসি রায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দীর্ঘ ৫০ বছর পার হলেও শহীদদের তাকিকা করা হয়নি। তিনি দ্রুত তালিকা করে শহীদদের পরিবারের সদস্যদের পুনর্বাসনের জোর দাবী জানান। সেদিনের ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে ডাকরা বধ্যভূমির স্মৃতিস্তম্ভের জমিদাতা পিসি রায় ও মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা অতীন্দ্রনাথ হালদার দুলাল বলেন, বাগেরহাট, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশালসহ উপকুলীয় এলাকা থেকে নৌকা ও লঞ্চযোগে নির্যাতিত মানুষ ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা পথে এখানে আশ্রয় নেন। সেদিন রামপালের নিভৃত পল্লী কালীগঞ্জ-ডাকরা এলাকায় প্রায় ৪ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন। পরদিন সকালে এখান থেকে রামপাল-খূলনা হয়ে সাতক্ষীরার সোজা রাস্তা ধরে সহজেই পশ্চিমবঙ্গে যাওয়াও প্রস্তুতি ছিল তাদের। এ সময় হানাদার বাহিনীর নেতা রজব আলী ফকিরের নেতৃত্বে আকস্মিক তাদের উপর হামলা চালানো হয়। নৃশংস পৈশাচিক উল্লাসে ৬’শ মানুষকে হত্যা করে। গুলি লাগার পরেও যারা মৃত্যুযন্ত্রনায় ছটফট করছিলের তাদের পুণ:রায় বেয়নেট চার্জ করে হত্যা নিশ্চিত করা হয়। মাত্র ২ ঘন্টার মধ্যে এত মানুষ হত্যা ইতিহাসে নজিরবিহীন।’ সেদিন স্বামী হারা আশালতা বলেন, “ তোমরা আমার প্রাণ নেও, শুধু আমার স্বামীর প্রাটা ভিক্ষা দাও বলে পায়ে ধরে কত কান্নকাটি, আকুতি মিনতি করেছি -তার শেষ নেই। কিন্তু ওরা আমার কোন কথাই শুলন না। উল্টো আমারে লাথি দিয়ে ফেলে দিল। লাঠি দিয়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত করল। কোন কান্না- কোন আত্মনাদেই ওই জল্লাদদের মনে এতটুকু মায়া হল না। ওরা আমার স্বামীকে গুলি করে তার ক্ষত-বিক্ষত নিথর দেহ খানা আবার আমার কোলের ওপর ফেলে দিয়ে বলল, এই নে তোর স্বামীর প্রাণ ভিক্ষা দিলাম। তখন স্বামীর দেহ জড়িয়ে একমাত্র শিশু পূত্রকে নিয়ে আমি রক্তের মাঝে লুটোপুটি খেতে থাকি। সেই নি:ষ্টুরতা সেই পৈশাচিকতা প্রকাশের কোন ভাষা নেই। বুঝিনা ভগবানের সৃষ্টি জীব কেমন করে এত পিচাশ হয়।’ এটুকু বলার পরে ৬০ বছরের বৃদ্ধা আশালতা হালদার বাঁধ ভাঙ্গা কান্নায় মঞ্চের ওপরেই লুটিয়ে পড়েন।
×