ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

উজ্জ্বল ভবিষ্যত বিনির্মাণে চাই আর্থিক সমৃদ্ধি

প্রকাশিত: ২০:০৪, ২২ অক্টোবর ২০২১

উজ্জ্বল ভবিষ্যত বিনির্মাণে চাই আর্থিক সমৃদ্ধি

গতকাল ছিল ৭৩তম আন্তর্জাতিক ক্রেডিট ইউনিয়ন দিবস। ১৯৬৪ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর অক্টোবর মাসের তৃতীয় বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক ক্রেডিট ইউনিয়ন দিবস উদযাপিত হয়ে আসছে। ক্রেডিট ইউনিয়নের বিশ্ব সংগঠন ওয়ার্ল্ড কাউন্সিল অব ক্রেডিট ইউনিয়ন (উকু) এ আন্দোলনের সার্বিক অবস্থা ও প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে প্রতিবছর দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে থাকে। চলতি বছর আন্তর্জাতিক ক্রেডিট ইউনিয়ন দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে- ‘Building financial health for a brighter tomorrow’ যা বাংলায় ‘ক্রেডিট ইউনিয়নের উজ্জ্বল ভবিষ্যত বিনির্মাণে আর্থিক সমৃদ্ধি নিশ্চিতকরণ।’ বর্তমানে বিশ্বের ৬টি মহাদেশের ১১৮টি দেশে ৮৬ হাজার ৮৫টি ক্রেডিট ইউনিয়নের মাধ্যমে ২৯ কোটি ১৪ লাখ ৩৩ হাজার সাধারণ মানুষ ক্রেডিট ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিশ্বের সব ক্রেডিট ইউনিয়নের সম্মিলিত সঞ্চয় আমানতের পরিমাণ ২ লাখ ১৬ হাজার ৮৫২ কোটি ইউএস ডলার। ক্রেডিট ইউনিয়নসমূহের ঋণ স্থিতির পরিমাণ ১ লাখ ৮৬ হাজার কোটি ইউএস ডলার। সংরক্ষিত ও অন্যান্য তহবিলের পরিমাণ ২২ হাজার ৬৭৭ কোটি ইউএস ডলার এবং বিশ্বের সব ক্রেডিট ইউনিয়নের মোট সম্পদের পরিমাণ ২ লাখ ৬২ হাজার ৭৩৯ কোটি ইউএস ডলার। তা ছাড়া প্রতিবছরই বিশ্বের নতুন কোন দেশে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ক্রেডিট ইউনিয়নের সঙ্গে জনগণ সম্পৃক্ত হচ্ছে। এশিয়া মহাদেশের দেশগুলোতে প্রতিষ্ঠিত ক্রেডিট ইউনিয়নের জাতীয় ফেডারেশনগুলো একত্রিত হয়ে ১৯৭১ সালে এশিয়ান কন্ফেডারেশন অব ক্রেডিট ইউনিয়নস (আকু) গঠন করে। আকুর প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এশিয়া মহাদেশে আকুভুক্ত ২৩টি দেশের ২৮টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ সকল প্রতিষ্ঠানের সদস্য সমিতির সংখ্যা ৩১ হাজার ৭৫২টি। এ প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যবস্থাপনা কমিটি ও অন্যান্য উপ-কমিটিসমূহের বিভিন্ন পদে ৩ লাখ ৫০ হাজার স্বেচ্ছাসেবক দায়িত্ব পালন করছেন। একই সঙ্গে ৭ লাখ ৫ হাজার কর্মী-কর্মকর্তা বিভিন্ন পদে ক্রেডিট ইউনিয়নসমূহে কাজ করছেন। সদস্যগণ এসব ক্রেডিট ইউনিয়নের মাধ্যমে তাদের অর্থনৈতিক ও জীবনমানের উন্নয়ন সাধন করছেন। ক্রেডিট ইউনিয়নের ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, ফ্রেডরিক উইলহেম রাফাইসেন (১৮১৮-১৮৮৮) ক্রেডিট ইউনিয়ন আন্দোলনের একটি ঐতিহাসিক নাম। ১৮৪৬-৪৭ সালের খরা দুর্ভিক্ষে জার্মানির মানুষের জীবনে দুর্বিষহ দুর্দশা ডেকে আনে। তিনি দরিদ্র জনগণের দুঃখ-দুর্দশা, অন্ন, বস্ত্র ও আশ্রয়ের দুরবস্থা দেখে মর্মাহত হন এবং ধর্মযাজক হিসেবে বাইবেলের ন্যায্যতার কথা, সহযোগিতার যুক্তি, দয়ার কাজ, ভ্রাতৃত্ববোধ, প্রতিবেশীর প্রেম প্রভৃতি নীতি বাক্যগুলো তার জীবনকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। তিনি দরিদ্র জনগণের সঙ্গে আলাপ আলোচনা শুরু করেন এবং দুস্থ ও ভবঘুরে লোকদের ভাগ্য পরিবর্তনে ১৮৪৪ সালে ইংল্যান্ডের রঁচডেলের তাঁতি ও শ্রমিকদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রতিষ্ঠিত ভোক্তা সমবায় পদ্ধতির চিন্তা-চেতনাকে সামনে রেখে জার্মানির দারিদ্র্যপীড়িত সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মানবিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৮৫২ সালে ফ্রেডরিক উইলহেম রাফাইসেন ক্রেডিট ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে ক্রেডিট ইউনিয়নের মাধ্যমে দারিদ্র্যবিমোচন একটি অতি কার্যকর প্রক্রিয়া প্রমাণিত হওয়ায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এর ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটতে থাকে। ৩ জুলাই, ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে লক্ষ্মীবাজারে ৫০ জন খ্রীস্টান বাঙালী ভাই-বোনদের নিয়ে ‘দি খ্রীস্টান কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লিঃ, ঢাকা’ প্রতিষ্ঠা হয়। ষাট থেকে সত্তর দশকের ঢাকার প্রায় প্রতিটি খ্রীস্টান ধর্মপল্লীতে ক্রেডিট ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা হয়। এসব ক্রেডিট ইউনিয়নের মাধ্যমে সাধারণ খ্রীস্টভক্তদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত হওয়ায় ক্রমান্বয়ে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, পাবনা, রাজশাহী এবং নাটোর জেলার খ্রীস্টান ধর্মপল্লীগুলোতেও পঞ্চাশ হতে ষাট দশকের মধ্যে ক্রেডিট ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করা হয়। ক্রেডিট ইউনিয়নের আন্তঃব্যবস্থাপনা অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশ ও সংরক্ষণে-প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বর্তমান প্রজন্মের অনেক ক্রেডিট ইউনিয়ন এখনও মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের মানুষের মিলনমেলা। ক্রেডিট ইউনিয়নের সদস্যরা একে অপরের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রতিটি সিদ্ধান্ত গ্রহণে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি এবং সমবায় সমিতির বিদ্যমান আইন বিধি অনুসরণ করা হয়। ক্রেডিট ইউনিয়ন পরিচালনায় ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রেখে সদস্যদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে চলেছে। কাল্বের আওতাভুক্ত বাংলাদেশে ১ হাজার ১৩৮টি সমিতির মধ্যে শ’ দেড়েক সমিতি হিন্দু, খ্রীস্টান ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বাকি সবই মুসলিম। এ সকল সমবায় সমিতির মধ্যে আন্তঃসমবায় সম্পর্ক নিবিড় ও বন্ধুত্বপূর্ণ। ক্রেডিট ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পৃক্তজন হিসেবে আমরা বিশ্বাস করি, করোনা মহামারীর দুর্যোগকালীন সময়ে এ আন্দোলন বিকাশ এবং সদস্যদের আর্থসামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে এবারের নির্ধারিত প্রতিপাদ্য বিশ্বের ক্রেডিট ইউনিয়নসমূহকে আরও টেকসই এবং উজ্জীবিত করতে সহায়ক হবে। সর্বোপরি বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল ক্রেডিট ইউনিয়ন আন্দোলন বিকাশে যারা মেধা ও শ্রম দিয়ে ভূমিকা রেখে গেছেন এবং যাচ্ছেন তাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। একই সঙ্গে সদস্যদের মধ্যে যারা কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন তাদের প্রত্যেকের আত্মার চিরশান্তি ও সদ্গতি কামনা করছি। লেখক : সম্প্রীতি কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লিঃ-এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী এবং কাল্বের সাবেক সেক্রেটারি
×