ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

দুর্বলতা যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে

করোনাপরবর্তী স্বাভাবিক জীবনে ছন্দপতন

প্রকাশিত: ২৩:১০, ১৭ অক্টোবর ২০২১

করোনাপরবর্তী স্বাভাবিক জীবনে ছন্দপতন

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ জুবায়ের আল মেহেদী। দেশে করোনা সংক্রমণের শুরুতেই স্ত্রীসহ আক্রান্ত হন। প্রায় এক মাস হাসপাতাল-বাসায় থেকে চিকিৎসা নিয়ে ভাইরাসমুক্ত হলেও এখনও কাটছে না শারীরিক অন্যান্য জটিলতা। করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার পর থেকেই দুর্বলতা যেন তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। নিয়মিত অফিস করা দূরে থাক নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজার নিয়েও ঘরে পৌঁছাতে হাঁপিয়ে উঠতেন তিনি। এক পর্যায়ে চাকরি ছেড়ে দিয়ে কিছুদিন বিশ্রাম নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি মেহেদী। একই অবস্থা কামরুজ্জামান নয়নেরও। করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার পর ৬ মাস কেটে গেলেও এখনও সিঁড়ি ভেঙ্গে ওপরে উঠতে গেলে হাঁপিয়ে ওঠেন। শ্বাসকষ্ট হয়ে গেছে নিত্যসঙ্গী। মাথার চুল পড়ে গিয়ে প্রায় টাক হওয়ার অবস্থা তার। চিকিৎসকের পরামর্শে দিনের পর দিন পুষ্টিকর খাবার খেয়ে শরীরের ওজন দ্বিগুণ হয়ে গেলেও সুস্থভাবে দিন পার করতে পারছেন না তিনি। শুধু মেহেদী বা কামরুজ্জামান নন করোনা সংক্রমণ থেকে সুস্থ হওয়ার পরও এরকম নানা জটিলতায় দিন পার করছেন অনেকেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেশিরভাগ কোভিড-১৯ সংক্রমিতরাই ২-৪ সপ্তাহের মধ্যে সুস্থ হয়ে যান। তবে কোন কোন রোগীর ৪ সপ্তাহ পরেও বিভিন্ন শারীরিক জটিলতা থাকে। একে এ্যাকিউট পোস্ট কোভিড সিনড্রম বলা হয়। যদি এই লক্ষণগুলো এক বছর পরেও দেখা দেয় তাহলে তাকে পোস্ট কোভিড সিনড্রম বলা হয়। এর প্রধান প্রধান লক্ষণগুলো হলো- দুর্বলতা, শ্বাসকষ্ট, বিরক্তিভাব, অনবরত ঘাম হওয়া, পেশিতে এবং শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্যথা, স্বাদ ও গন্ধ না পাওয়া, অনিদ্রা। কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে বিষণœতা ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ার মতো মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা দেখা দেয়। তাদের মতে, এর কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম এই ভাইরাসের সংক্রমণ। তারা বলেন, করোনাভাইরাস শুধু আমাদের ফুসফুসকেই প্রভাবিত করে না যকৃৎ, স্নায়ু এবং কিডনিকেও প্রভাবিত করে। ফলে এই সংক্রমণ থেকে সেরে উঠতে আমাদের শরীরের সময় লাগে। এই ভাইরাস শরীরে ঢুকলে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সক্রিয় হয়ে ওঠে। শরীরে সেই সময় বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ নিঃসৃত হয়। এর ফলে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে নানা বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, যা দীর্ঘ সময় ধরে থাকে। করোনা গবেষক এবং ঢাকা মেডিক্যালের চিকিৎসক ডাঃ তুষার মাহমুদ পোস্ট কোভিড জটিলতা সম্পর্কে বলেন, কোভিড-১৯ পরবর্তী কিছু লক্ষণের মধ্যে অন্যতম হলো থ্রম্বোএমবলিজম। ধমনিতে রক্ত জমাট বেঁধে এর ফলে হার্ট এ্যাটাক বা স্ট্রোক হতে পারে। তবে কোভিড-১৯ থেকে আরোগ্য লাভ করা ৫ শতাংশেরও কম রোগীর মধ্যে এই লক্ষণ দেখা যায়। পালমোনারি এমবলিজম আর একটি লক্ষণ যেটি কোভিড-১৯ থেকে সেরে ওঠা মানুষদের মধ্যে দেখা যায়। এখানে ফুসফুসে রক্ত জমাট বাঁধার ফলে শ্বাসকষ্ট হয় এবং রক্তচাপ কমে যায়। এই ধরনের রোগীদের দ্রুত হাসপাতালে চিকিৎসার প্রয়োজন। আর একটি কোভিড-১৯ পরবর্তী লক্ষণ হলো হাই ডি-ডিমার লেভেল। এক্ষেত্রে রক্ত জমাট বাঁধায় রোগীকে ২-৪ সপ্তাহ পর্যন্ত হাসপাতালে থাকতে হতে পারে। অনেক সময় সেরে ওঠার পর শুকনো কাশি হয়। যার ফলে ফুসফুসের ওপর চাপ পড়ে। এক্ষেত্রে জোরে জোরে শ্বাস নেয়ার মতো ব্যায়ামের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। প্রচ- কাশি হলে বুকের ওপর চাপ সৃষ্টি হয় এবং বুকের খাঁচায় ব্যথা করে। তিনি বলেন, কোভিড-১৯ থেকে মুক্তির পর অনেক সময় পালমোনারি ফাইব্রোসিস হয়। এর জন্য রোগীকে দীর্ঘদিন ধরে অক্সিজেন নিতে হয়। অনেক সংক্রমিতের ৭০ শতাংশ ফুসফুস ক্ষতি হওয়ার কারণে এই সমস্যা দেখা দেয়। তবে মোট সংক্রমিতের মাত্র ১ শতাংশের ক্ষেত্রেই এই সমস্যা নজরে আসে। যাদের সংক্রমণের সময় অক্সিজেন থেরাপি করতে হয়েছে তাদের সুস্থ হওয়ার এক মাস পর ফুসফুসের ক্ষমতার বিষয়ে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করা প্রয়োজন। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য খাদ্যাভাস পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরী বলে মন্তব্য করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডাঃ লেনিন চৌধুরী। তিনি বলেন, এক্ষেত্রে সঠিক খাবার খেয়ে আমাদের শরীরকে সুস্থ রেখে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বজায় রাখতে হবে। খাবারের মধ্যে প্রোটিন জাতীয় উপাদান বেশি থাকা প্রয়োজন। তবে শাক-সবজিও থাকতে হবে যাতে খাবার যথাযথভাবে হজম হয়। জিঙ্ক, ভিটামিন-সি, ভিটামিন-ডি, ভিটামিন-বি কমপ্লেক্স এই সময় জরুরী হলেও বেশি বেশি খাওয়া উচিত নয়। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে তন্তুযুক্ত খাবার এবং পুষ্টিকর শাক-সবজি খাওয়া প্রয়োজন। আমাদের শরীরে যে সমস্ত উপাকারী মাইক্রোব থাকে সেগুলো যাতে ঠিকঠাকভাবে কাজ করতে পারে তার জন্য তন্তু জাতীয় খাবার খাওয়া প্রয়োজন। বিভিন্ন রঙের খাবার খেতে হবে যা আমাদের শরীরে এ্যান্টি অক্সিডেন্টের চাহিদা মেটায়। এর জন্য হলুদ, আদা, চা ইত্যাদি খাওয়া প্রয়োজন। প্রচুর পরিমাণ জল খেতে হবে যাতে সংক্রমণের সময় এবং সুস্থ হয়ে ওঠার পর শরীরে জলের পরিমাণ যথাযথ থাকে। এই সময় মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর রাখা অত্যন্ত জরুরী বলে জানান জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডাঃ শাহানা পারভীন। তিনি বলেন, আমারা যে খাবার খাই তা যদি শরীরের পক্ষে ভাল না হয় তাহলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যেমন কমে যায়, একইসঙ্গে মনের ওপরেও চাপ পরে। আর তাই পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে এবং মৌসুমি ফলমূল, শাক-সবজি খাওয়া জরুরী। এ সময় এক প্রকার বিষণœতা ভর করে মনে। প্রয়োজন হলে কাউন্সিলিং করারও পরামর্শ দেন তিনি।
×