ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর অভিনন্দন ২৩ রানের জয়ে ম্যাচসেরা নাসুম

অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক টি২০ জয়

প্রকাশিত: ২২:১১, ৪ আগস্ট ২০২১

অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক টি২০ জয়

মোঃ মামুন রশীদ ॥ চার টি২০ বিশ্বকাপে ৪ বার মুখোমুখি হয়ে বাংলাদেশ দল হেরেছে অস্ট্রেলিয়ার কাছে। তবে তাদের প্রথমবার দ্বিপাক্ষিক সিরিজে পেয়েই জয় দিয়ে শুরু করেছে টাইগাররা। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে দুর্বিনীত অস্ট্রেলিয়াকে স্পিনে নাকাল করে ২৩ রানে হারিয়েছে বাংলাদেশ দল। ফলে ৫ ম্যাচের সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে গেছে টাইগাররা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মাত্র তৃতীয়বার বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম পরাশক্তি অস্ট্রেলিয়াকে হারাল বাংলাদেশ। এর আগে ২০০৫ সালে কার্ডিফে ওয়ানডেতে এবং ২০১৭ সালে মিরপুরে টেস্টে জয় এসেছিল। এবার সফরে আসার আগে জৈব সুরক্ষা বলয়, করোনা প্রটোকল নিয়ে নানাবিধ কঠিন শর্ত এবং অদ্ভুত কিছু দাবি জানায় ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া (সিএ)। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) সবকিছু মেনে নিলেও দেশের ক্রিকেটাঙ্গনে এর তীব্র সমালোচনা হয় এবং কোটি কোটি ক্রিকেটপ্রেমী মনেপ্রাণেই চেয়েছে অসিদের বিপক্ষে টাইগারদের বিজয়। সেটি অসম্ভব মনে হয়েছিল আগে ব্যাট করে বাংলাদেশ ৭ উইকেটে মাত্র ১৩১ রান তোলার কারণে। বাঁহাতি স্পিনার নাসুম আহমেদের ক্যারিয়ারসেরা বোলিংয়ে শেষ পর্যন্ত অসিদের ২০ ওভারে ১০৮ রানেই গুটিয়ে দেয় বাংলাদেশ। আজ সিরিজের দ্বিতীয় টি২০ ম্যাচ একই ভেন্যুতে, একই সময় সন্ধ্যা ৬টায়। টস হেরে আগে ব্যাটিংয়ে নামে বাংলাদেশ। অসিরা ৩ পেসার ও ২ স্পিনার নিয়ে একাদশ সাজায়। আর বাংলাদেশ দল একাদশে ২ পেসার ও ৩ স্পিনার নেয় (সাকিব, মাহেদি, নাসুম)। কারণ মিরপুরের ধীরগতির উইকেটে বরাবরই বাংলাদেশের মূল অস্ত্র এই স্পিনাররা। শুরুটা বেশ ভালই করেছিলেন নাইম, ইনিংসের দ্বিতীয় বলেই গতিধর স্টার্ককে ছক্কা হাঁকিয়ে ভীতি কাটিয়েছেন। গত ২ দিনের অনুশীলনে বোলিং মেশিনে প্রায় ১৪৫ কিলোমিটার গতির বলে ব্যাটিং প্র্যাকটিস করেছেন বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানরা, এটি হয়তো তারই ফল। কিন্তু এরপরও পাওয়ার প্লের ৬ ওভারে মাত্র ৩৩ রান করে বাংলাদেশ ১ উইকেটে। সৌম্য সরকারকে (২) বোল্ড করেছেন হ্যাজলউড ইনিংসের চতুর্থ ওভারে। পঞ্চম ওভারে স্টার্কের করা দ্বিতীয় বল মিড উইকেট দিয়ে গ্যালারিতে পাঠিয়েছেন নাইম- সিরিজের নিয়ম অনুসারে সেই বলটি আর ব্যবহারযোগ্য থাকেনি। অন্য বল আনতে হয়েছে। কিন্তু হ্যাজলউড-টাইয়ের পেস ও বাউন্সে বাকি ব্যাটসম্যানরা দ্রুত রান তুলতে পারেননি। শুধু নাইম ২৯ বলে ২ চার, ২ ছক্কায় ৩০ এবং সাকিব আল হাসান ৩৩ বলে ৩ চারে ৩৬ রানের দুটি ভাল ইনিংস খেলেছেন। অধিনায়ক মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ২০ বলে ১ ছক্কায় ২০ রান করেন। কেউ বড় ইনিংস খেলতে পারেননি এবং বড় জুটিও হয়নি। সৌম্যকে বোল্ড করা হ্যাজলউড সাকিবকেও বোল্ড করেন এবং মাহমুদুল্লাহও তার শিকার হয়েছেন। আর এতেই বড় সংগ্রহ গড়া সম্ভব হয়নি বাংলাদেশের জন্য। শেষদিকে আফিফ হোসেন ধ্রুব ১৭ বলে ৩ চারে ২৩ রান করে দলের রানকে একটি সম্মানজনক অবস্থানে নিয়ে গেছেন। তার ব্যাটিংয়ে শেষ ৫ ওভারে ৪২ রান যোগ করে বাংলাদেশ ৩ উইকেটে। সবমিলিয়ে ৪৭টি ডট বল করেছেন অসি বোলাররা। মাত্র ৮টি চার ও ৩টি ছক্কা হাঁকাতে পেরেছে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। আর এ কারণেই রান বেশি আসেনি। হ্যাজলউড ৪ ওভারে মাত্র ২৪ রানে ৩ উইকেট নেন। তিনি ১১টি ডট বল করেন। শুরুতে স্টার্ক সুবিধা করতে না পারলেও পরে দারুণ বোলিং করেছেন। তিনি ৪ ওভারে অবশ্য সবচেয়ে খরুচে বোলিং করে ৩৩ রানে নিয়েছেন ২ উইকেট। যদিও সবচেয়ে বেশি ১৩টি ডট বল তিনিই করেছেন। আর বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের সবচেয়ে ভুগিয়েছেন এ্যাগার ও টাই। বাঁহাতি স্পিনার এ্যাগার ৪ ওভারে মাত্র ২২ রান দিয়ে উইকেটশূন্য থাকেন। আর পেসার টাই ৪ ওভারে ২২ রানে নেন ১ উইকেট। জাম্পাকে নিয়ে ভয় থাকলেও ৪ ওভারে ২৮ রান দিয়ে নাইমকে বোল্ড করেছেন শুধু। এরপর বাংলাদেশী স্পিনারদের দুর্দান্ত বোলিংয়ের সামনে লড়াইটা করেছেন মিচেল মার্শ একাই। নাসুমের বাঁহাতি স্পিনে ধসে পড়ে অসি ব্যাটিং লাইনআপ। প্রথম ওভারের প্রথম বলে শুরুটা হয়েছিল শেখ মাহেদির অফস্পিনে। বোল্ড হয়ে যান এ্যালেক্স ক্যারি। পরের ওভারে নাসুম ৯ রান দিলেও তুলে নেন জশ ফিলিপেকে (৯)। তিনি স্টাম্পিং হয়ে যান। তৃতীয় ওভারের প্রথম বলেই সাকিব বোল্ড করে ফিরিয়ে দেন ময়সেস হেনরিকসকে (১)। শুরুর এই ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করেছেন মার্শ ও অধিনায়ক ম্যাথু ওয়েড। তারা ৩৮ রানের জুটি গড়েছেন। তবে ততক্ষণে দশম ওভার চলছিল। ওয়েড রান তোলার তাড়াহুড়ায় নাসুমকে তুলে মারতে গিয়ে মুস্তাফিজের ক্যাচে পরিণত হন। তিনি ২৩ বলে ১৩ রান করেছেন। এরপর এ্যাশটন এ্যাগার (৭) হিট উইকেট হয়েছেন ত্রাস হয়ে ওঠা নাসুমের বলে। ওয়ানডাউনে নেমে মার্শ ৪৫ বলে ৪ চার, ১ ছক্কায় ৪৫ রান করে নাসুমকে তুলে মারতে গিয়ে শরীফুল ইসলামের দারুণ ক্যাচে সাজঘরে ফিরে যান। এরপর আর তারা জিততে পারেনি। প্রথম ওভারে ৯ রান দেয়া নাসুম পরের ৩ ওভারে মাত্র ১০ রান দিয়ে আরও ৩ উইকেট নিয়েছেন। ফলে ১৯ রানে ৪ উইকেট নিয়ে ক্যারিয়ারসেরা বোলিং নৈপুণ্য দেখান এ তরুণ। আগের ৪ টি২০ ম্যাচে মাত্র ২ উইকেট নিয়েছিলেন তিনি। এছাড়া মাহেদি ৪ ওভারে ২২, সাকিব ৪ ওভারে মাত্র ২৪ রান দিয়ে ১টি করে উইকেট নেন। মাঝের ওভারগুলোয় দুর্দান্ত বোলিং করেন মুস্তাফিজ। এ বাঁহাতি পেসার ধীরগতির উইকেটে বরাবরই সফল। স্পিনারদের দাপটে বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে পড়ে অসি ব্যাটসম্যানরা। ১৫ ওভার শেষে বাংলাদেশ ছিল ৪ উইকেটে ৮৯, অস্ট্রেলিয়া ৫ উইকেটে ৮২। পাওয়ার প্লের ৬ ওভারে অসিরা তোলে ৩ উইকেটে ২৮, বাংলাদেশ ছিল ১ উইকেটে ৩৩। আর এই চাপের মুহূর্তে ডেথ ওভারে ভয়ঙ্কর মুস্তাফিজ সাঁড়াশির মতো হয়ে ওঠেন। তুলে নেন আরও ২ উইকেট। ৪ ওভারে মাত্র ১৬ রান দিয়েছেন মুস্তাফিজ। আরেক বাঁহাতি পেসার শরিফুল শুরুতে ভাল না করলেও শেষ পর্যন্ত ৩ ওভারে ১৯ রান দিয়ে নিয়েছেন ২ উইকেট। সবমিলিয়ে ৫৬টি ডট বল করেছে বাংলাদেশের বোলাররা। মাত্র ৬টি চার ও ২টি ছক্কা হজম করেছেন তারা। এখান থেকেও স্পষ্ট হয়েছে কত দুর্দান্ত বোলিং করেছে টাইগাররা। তাই শেষ পর্যন্ত নির্ধারিত ২০ ওভারে ১০৮ রানেই গুটিয়ে গেছে অসিরা। এটি টি২০ ক্রিকেটে অসিদের পঞ্চম সর্বনিম্ন সংগ্রহ এবং মিরপুরে এটি তাদের দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। ২০১৪ বিশ^কাপে এই মাঠে তারা ভারতের বিপক্ষে ৮৬ রানে গুটিয়ে গিয়েছিল। ২৩ রানের দারুণ এক জয়ে প্রতিপক্ষের দর্প চূর্ণ করল টাইগাররা। এর আগে ২০১৬ সালে আরব আমিরাতের বিপক্ষে ১৩৩ রান করেও জিতেছিল বাংলাদেশ। এবার তারচেয়েও কম রান করে জিতেছে। এটিই এখন টি২০ ম্যাচে বাংলাদেশের সবচেয়ে কম রান করে জয় তুলে নেয়ার রেকর্ড। জৈব সুরক্ষা বলয়, কোয়ারেন্টাইন ইস্যু, করোনা প্রতিরোধে বিভিন্ন অযৌক্তিক দাবি করে বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে সমালোচিত অসিরা শেষ পর্যন্ত প্রথম ম্যাচেই হেরে যাওয়ায় স্বস্তি নেমেছে দেশের ক্রিকেটাঙ্গনে। ২০০৫ সালে কার্ডিফে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথমবার জয় আসে। আশরাফুল-আফতাবের ব্যাটিংয়ে ৫ উইকেটে জয় পায় বাংলাদেশ। ১২ বছর পর মিরপুরে শক্তিশালী অসিদের টেস্টে হারিয়ে দেয় সাকিব-মিরাজদের স্পিনে। এবার নাসুম-সাকিবের কাছে টি২০ ক্রিকেটে হারল তারা। ৩ ফরমেটেই দুর্বিনীত অসিদের হারিয়ে দেয়ার গৌরব অর্জন করল টাইগাররা। স্কোর ॥ বাংলাদেশ ইনিংস- ১৩১/৭; ২০ ওভার (সাকিব ৩৬, নাইম ৩০, আফিফ ২৩, মাহমুদুল্লাহ ২০; হ্যাজলউড ৩/২৪, স্টার্ক ২/৩৩)। অস্ট্রেলিয়া ইনিংস- ১০৮/১০; ২০ ওভার (মার্শ ৪৫, স্টার্ক ১৪, ওয়েড ১৩; নাসুম ৪/১৯, মুস্তাফিজ ২/১৬, শরিফুল ২/১৯)। ফল ॥ বাংলাদেশ ২৩ রানে জয়ী। ম্যাচসেরা ॥ নাসুম আহমেদ (বাংলাদেশ)। সিরিজ ॥ ৫ ম্যাচের সিরিজে বাংলাদেশ ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর অভিনন্দন ॥ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টি-২০তে দুর্দান্ত জয়ে টাইগারদের অভিনন্দন জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ৫ ম্যাচের টি-২০ সিরিজে প্রথম ম্যাচে জয়লাভে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলকে আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়েছেন। মঙ্গলবার এক বার্তায় প্রধানমন্ত্রী অস্ট্রেলিয়াকে পরাজিত করার জন্য খেলোয়াড়, কোচ এবং জাতীয় ক্রিকেট দলের সকল কর্মকর্তা ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে (বিসিবি) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অভিনন্দন জানান। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল বিজয়ের এই ধারা ভবিষ্যতেও অব্যাহত রাখবে বলে শেখ হাসিনা আশা প্রকাশ করেন।
×