ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অভিযুক্তরাই বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টির চেষ্টা করছে

হেফাজতের তাণ্ডব ॥ ৬২ মামলার তদন্ত নতুন করে শুরু হচ্ছে

প্রকাশিত: ২২:১৮, ১ ডিসেম্বর ২০২০

হেফাজতের তাণ্ডব ॥ ৬২ মামলার তদন্ত নতুন করে শুরু হচ্ছে

শংকর কুমার দে ॥ হেফাজতে ইসলামের সন্ত্রাসের তাণ্ডবলীলা চালানোর ৬২ মামলার তদন্ত নতুন করে সচল ও সক্রিয় করার উদ্যোগ নিচ্ছে পুলিশ। রাজধানী ঢাকাসহ সাত জেলায় সন্ত্রাসের তাণ্ডবলীলা চালানোর অভিযোগে ৮৩ মামলা হয়। সাত বছর আগে ২০১৩ সালে রাজধানী ঢাকাসহ পাঁচ জেলায় ৮৩টি মামলায় আসামি করা হয় ৩ হাজার ৪১৬ জনের নামসহ ৮৪ হাজার ৯৭৬ জনকে। এর মধ্যে রাজধানীতে ৫৩টি মামলা হয়। এসব মামলায় হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী ঐক্যজোট, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবির, নেজামে ইসলাম, খেলাফত মজলিশ, খেলাফত আন্দোলন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতা-কর্মীদের আসামি করা হয়। এর মধ্যে ১৫ মামলায় অভিযোগপত্র (চার্জশীট) দিয়েছে পুলিশ। এসব মামলার আসামিরা হয় খালাস নয়তো জামিনে মুক্ত হয়ে আবার নতুন করে প্রকাশ্যে তৎপরতা শুরু করেছে। আসামিদের কেউ কেউ জামিনও নেয়নি। মামলায় অভিযুক্তরাই এখন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে মূর্তি আখ্যায়িত করে উস্কানিমূলক বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে, মিছিল-সমাবেশ করে মানুষজনকে ভুল বুঝিয়ে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টির মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানোর পাঁয়তার করছে-এমন অভিযোগের ভিত্তিতেই হেফাজাতের মামলাগুলো সচল ও সক্রিয় করার উদ্যোগ নিচ্ছে পুলিশ। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে এ খবর জানা গেছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন চলাকালে কথিত নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তিসহ ১৩ দফা দাবিতে হঠাৎ সক্রিয় হয়ে ওঠে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। এসব দাবিতে ওই বছরের ৫ মে ঢাকার ছয়টি প্রবেশমুখে অবরোধ কর্মসূচী শেষে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান নেন হেফাজতের বিপুলসংখ্যক কর্মী-সমর্থক। এর আগে দিনভর পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। এ সময় মতিঝিল, পল্টন ও আশপাশ এলাকায় ফুটপাথের শত শত দোকান, ফুটপাথের পাশের লোহার বেষ্টনী এবং আশপাশের অনেক সরকারী-বেসরকারী স্থাপনা, যানবাহনে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। ওই দিন রাতে পুলিশ, র্যা ব ও বিজিবির যৌথ অভিযানের মুখে হেফাজতের নেতা-কর্মীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। এ ঘটনায় রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে হেফাজতের ২২ কর্মীসহ ৩৯ জন নিহত হন বলে পুলিশ সদর দফতর অভিযোগ পায়। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ৮৩টি মামলার মধ্যে রাজধানী ঢাকার কলাবাগান থানায় দুটি, রমনায় একটি, শেরেবাংলা নগর থানায় একটি, বাগেরহাটে ছয়টি, নারায়ণগঞ্জে পাঁচটিসহ মোট ১৫টি মামলায় ২০১৪ সালে হেফাজতে ইসলাম, জামায়াত ও বিএনপির স্থানীয় নেতা-কর্মীদের আসামি করে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। এরপর হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটির মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মুফতি ওয়াক্কাস, বিএনপি-জামায়াতসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতাসহ ৮৮ জনকে গ্রেফতারও করা হয়। অবশ্য পরে তারা জামিনে মুক্তি পান। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীতে করা ৫৩টি মামলার মধ্যে চারটি মামলার অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে। বাকি ৪৯টি মামলার তদন্ত চলছে। ২০১৩ সালের ৫ মে ঘটনার পর হেফাজতের কেন্দ্রীয় নেতা জুনায়েদ বাবুনগরী, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মুফতি ওয়াক্কাসসহ কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তারা ওই সহিংসতার জন্য হেফাজতের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, নেজামে ইসলাম, খেলাফত মজলিশ, খেলাফত আন্দোলন, ইসলামী ঐক্যজোটসহ কয়েকটি দলের নেতাদের দায়ী করে বক্তব্য দেন। একজন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দীও দেন। ৫ মে এক পুলিশ সদস্য নিহতের ঘটনায় বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতা মওদুদ আহমদ, এম কে আনোয়ার, রফিকুল ইসলাম মিয়াকেও গ্রেফতার করা হয়েছিল। ঢাকার বাইরে আরও যেসব মামলা হয় তার মধ্যে ঢাকার ঘটনার পরদিন ৬ মে হেফাজতে ইসলামের ডাকা সড়ক অবরোধে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে ছয়জন নিহত হন। এ ঘটনায় হাটহাজারী থানার পুলিশ হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে একটি মামলা করেন। ওই মামলায় ৫৩ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা ৪-৫ হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। আসামিরা সবাই স্থানীয় বিএনপির নেতা-কর্মী এবং হেফাজতের সমর্থক। এই মামলার তদন্ত শেষ হয়নি। ঢাকার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওই দিন ও পরদিন বাগেরহাটে হেফাজতের কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে হেফাজতের দুজন কর্মী নিহত হন। এ ঘটনায় ফকিরহাটে চারটি ও বাগেরহাট সদর থানায় দুটি মামলা করে পুলিশ। এতে হেফাজত, জামায়াত ও স্থানীয় বিএনপির ৮৮ জন নেতা-কর্মীসহ ১০-১২ হাজার অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। বাগেরহাটের হেফাজত, জামায়াত ও বিএনপির স্থানীয় নেতা-কর্মীদের আসামি করে ছয়টি মামলায় ইতোপূর্বে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়া হয়েছে। ফকিরহাট থানায় করা একটি মামলার রায়ে প্রায় ৪০০ আসামি খালাস পান। সাক্ষীর অভাবে তাঁরা খালাস পান বলে আদালত সূত্রে জানা গেছে। নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর-শিমরাইল এলাকায় হেফাজতের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশ-বিজিবির সংঘর্ষ ও নিহতের ঘটনায় সোনারগাঁ ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় সাতটি মামলা হয়। এসব ঘটনায় পুলিশ সোনারগাঁ ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় ছয়টি মামলা করে। সহিংস ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত এক বাসমালিকও আরেকটি মামলা করেন। ইতোমধ্যে পাঁচ মামলার অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে। বাকি দুই মামলার তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। হেফাজতে ইসলামের সন্ত্রাসের তাণ্ডবলীলা চালানোর পর গত সাত বছরেও এ-সংক্রান্ত মামলাগুলোর সুরাহা হয়নি। উপরন্তু হেফাজতের আস্ফালন আবারও বেড়ে গেছে। মামলায় যাদের আসামি করা হয় তাদের মধ্যে আছেন হেফাজতের মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী, চট্টগ্রাম মহানগর সভাপতি মাওলানা মইনুদ্দিন রুহী, যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা ফরিদ উল্লাহ, মাওলানা শামসুল আলম, মাওলানা মহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী, মাওলানা তাজুল ইসলাম, মাওলানা জুলফিকার জহুর, জামায়াত নেতা মাওলানা হাফিজুর রহমান, হাজী জালাল উদ্দিন, এম এ কাসেম ফারুকী, হেফাজত নেতা মাওলানা জাফরুল্লাহ খান, মুফতি ফখরুল ইসলাম, মাওলানা মহিউদ্দিন, মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদী, জামায়াত নেতা হাফেজ মাহমুদুল হক শাহীন, বিএনপি নেতা মোঃ শাহজাহান, আল্লামা শাহ আহমদ শফীর ছেলে ও হেফাজত নেতা মাওলানা আনাস মাদানী, আবদুল মালেক হালিম, মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী, কারি ফজলুল করীম, মুফতি হারুন ইজহার, মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামী, মাওলানা ইলিয়াস ওসমানী, মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী, মাওলানা মুফতি ফয়জুল্লাহ, মাওলানা মাহফুজুল হক, আবদুল কুদ্দুস, নুরুল ইসলাম, আবুল হাসনাত আমিনী, মোস্তফা আযাদ, মুফতি নুরুল আমিন, মাওলানা শাখাওয়াত হোসেন, মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব, মাওলানা আতাউল্লাহ তামিম, মাওলানা গোলাম মহিউদ্দিন ইকরাম, শেখ লোকমান হোসেন, মুফতি সাইদুল ইসলাম, রফিকুল ইসলাম মাদানী, মুফতি শামসুল হক, মুফতি মনির হোসেন, মাওলানা আবদুল কাদের, জামায়াত নেতা মাওলানা রফিকুল ইসলাম, আবদুল জাব্বার, ডাক্তার শফিকুল ইসলাম মাসুদ, মাওলানা হেলাল হাসেমী, মাওলানা আবদুর রহমান, মাওলানা গিয়াস উদ্দিন, মাওলানা আবদুস সামাদ, মুফতি তৈয়বুর রহমান, মাওলানা জামাল উদ্দিন, মাওলানা আবদুল করিম, মাওলানা আনাস, মাওলানা আবদুর রহমান খান তালুকদার, মাওলানা মফিজুল ইসলাম, মাওলানা আলী আহমদ, মাওলানা আবদুল কাদের, মুফতি গোলাম মাওলা, মাওলানা আবদুর রহিম, কারি বেলায়েত হোসেন, ওবায়দুর রহমান মাহাবুব, মাওলানা রুহুল আমিন খান, মাওলানা হেমায়েত উদ্দিন, হাফেজ সাইদুর রহমান, মাওলানা কাজী জাবের, মাওলানা মহিব্বুল্লাহ, মাওলানা খুবায়ের আহমদ, মুফতি আরিফ বিল্লাহ, ওসমান গনি, একরামুল হক, মাওলানা রেজাউল করিম প্রমুখ। আসামিদের মধ্যে কয়েকজন মারা গেছেন বলে জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশ সদর দফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, হেফাজতে ইসলামের বিভিন্ন দাবির ব্যাপারে এতদিন সরকারের নমনীয়তার কারণে সম্প্রতি কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চস্তরে দাওরায়ে হাদিসকে স্নাতকোত্তর (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) সমমান বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। সুপ্রীমকোর্টের সামনের ভাস্কর্য সরাতে হেফাজতের দাবির সঙ্গেও একমত হয়ে ভাস্কর্য সরানো হয়েছে। হেফাজতের দাবি অনুযায়ী পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তন আনা হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। সরকারের আস্কারা পেয়েই এখন আবার একই চক্র বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে ভুল ব্যাখা করে মূর্তি আখ্যা দিয়ে দেশে অস্থিতিশীল ও নৈরাজ্যকর অবস্থা সৃষ্টির জন্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর ছক কষে মাঠে নেমেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাসহ বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী হেফাজতে ইসলামের সমাবেশের পেছনে বিএনপি-জামায়াতের বড় ইন্ধন ছিল। এখনও আবার ইন্দন দিয়েই হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্বে উগ্র মৌলবাদী ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে মাঠে নামানো হয়েছে। কোথায় ভাস্কর্য আর কোথায় মূর্তি ? মানুষজনকে ভুল বুঝিয়ে ধর্মানুভূতিতে আঘাতের কথা বলে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার ষড়যন্ত্র করার বিষয়ে গোয়েন্দা প্রতিবেদন পাওয়া গেছে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা দাবি করেছেন।
×